কিছুতেই নেভানো যাচ্ছেনা বিশ্বজিৎ আগুন। মিডিয়ার সবকটা মাধ্যমে তুষের মত জ্বলছে এ দাবানল। সাথে সরকারও পুড়ছে তিলে তিলে। অপরাধীর সন্ধান না করে যারা ছাত্রলীগের গঙ্গা স্নানে ব্যস্ত ছিল তাদের গ্রহণযোগ্যতাও হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। ঘটনার কদিন আগে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাত্রলীগকে মাঠে নামতে বলেছিলেন। এ ধরণের সরকারী দাওয়াতের আসল অর্থ কি তা আমাদের সবার জানা। ওরা দাওয়াত কবুল করে মাঠে নেমেছে এবং ছাত্রলীগ হিসাবে যা করার তাই করেছে। এ সমীকরণ পানির মত সহজ। অতীতের সব ক্ষমতাসীন সরকারই এ কাজে প্রফেশনালিজম দেখিয়ে গেছে। কিন্তু এ সরকারের জন্যে সমস্যাটা অন্য জায়গায়।
প্রথমত, হতভাগ্য বিশ্বজিতের ভুল সময়ে ভুল জায়গায় অবস্থান; দ্বিতীয়ত, প্রবাসী একজন ’বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিকের’ বদৌলতে দেশে এখন ডিজিটাল রাজত্ব। পাশাপাশি ক্ষমতার রাজনীতি দেশের অনেক যদু মধুকে উপহার দিয়েছে টিভি চ্যানেল সহ মিডিয়া বাণিজ্যের হরেক রকম উপাদান। এসব প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে পেটের ধান্ধায় দেশের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে গাদাগাদা সাংবাদিক। তাই প্রকাশ্য রাজপথে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে জজ মিয়াদের জন্ম দেয়া এখন আর সহজ কাজ নয়। দেশের কোটি কোটি বেকারদের অনেকে বানের স্রোতের মত যত্রতত্র ভেসে বেড়ায় এবং বিশ্বজিতদের সাথে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় হাজির থেকে স্বাক্ষী হয় ডিজিটাল নিধনের। হাতে মোবাইল আর অবসরে নুয়ে পরা দুটি চোখ নিয়ে প্রতিনিয়ত ওরা খুজে বেড়ায় বৈচিত্র্য। ছাত্রলীগ নামের দানবীয় শক্তির পৈশাচিকতা সাংবাদিকদের চোখ ফাঁকি দিতে সক্ষম হলেও ফাঁকি দেয় না এসব আদমদের চোখ। ওরা শুধু দেখেই ক্ষান্ত থাকেনা, অনেক সময় মোবাইলে ধারণ করে নেয় পশুদের পশুত্ব। বিশ্বজিৎ খুন নিয়ে সরকারী বেকায়দার মূলেও আছে সাংবাদিকদের পাশাপাশি এসব প্রত্যক্ষদর্শী। এদের কারণেই মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের গৃহপালিত সেবাদাস পুলিশের ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। ছাত্রলীগ নামক নরপশুদের রক্ষা হয়ত বঙ্গবন্ধুর দেখা স্বপ্নেরই অংশ, তাই এর বাস্তবায়ন জাতি হিসাবে আমাদের জন্যে বাধ্যতামূলক। খোলা তরবারি হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে তিলে তিলে খুন করল একদল কসাই আর তাদের বাঁচানোর দায়িত্ব নিল বিপুল ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। বিশ্ব শাসনব্যবস্থায় এর চাইতে ন্যাক্কারজনক, নিকৃষ্ট ও পশুসুলভ ক্ষমাহীন অপরাধ বিশ্বের দ্বিতীয় কোন গণতান্ত্রিক দেশে সংঘটিত হয়েছিল বলে মনে হয়না। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে। কেবল বিশ্বজিৎ হত্যায় এ ধরণের অপরাধ সীমাবদ্ধ ছিল বললে অন্যায় বলা হবে। বাংলাদেশের অলিগলিতে প্রতিদিন ঘটছে এসব নারকীয় হত্যাকাণ্ড। কেবল মাত্র রাজনৈতিক পরিচয়ে খুনিরা পার পাচ্ছে এবং রক্ত নেশায় উজ্জীবিত হয়ে হায়েনার মত ধাওয়া করছে নতুন নতুন শিকার।
বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের রায় আদৌ কি কোনদিন লেখা হবে? রাজনৈতিক খুনের বিচার বাংলাদেশে বলতে গেলে অবৈধ। হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট সহ বাংলাদেশের কোন কোর্টই এত ক্ষমতা রাখেনা যা নিশ্চিত করতে পারে খুনিদের শাস্তি। কোন জেলই এত শক্ত নয় যা আটকে রাখতে পারে শাওন, রাশেদ আর ইউনূস-টিপু গংদের। হৈ চৈ কিছুদিন প্রলম্বিত হবে, এ ফাঁকে ঘটে যাবে নতুন কোন ঘটনা যা বিশ্বজিত অধ্যায়ের উপর এঁটে দেবে শেষ পেরেক। মাস না ঘুরতে আমরা ভুলে যাব বিশ্বজিত নামের কোন এক দরিদ্র দর্জিকে। দেশের আইন, বিচার ও শাসনব্যবস্থার কাঠামোটা এভাবেই তৈরী। যেহেতু ক্ষমতার আশির্বাদ ছাড়া প্রধান বিচারপতি হওয়া যায়না তাই এমন একটা পদের অলিখিত বাধ্যবাধ্যকতা থাকে বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের পদসেবা করা। খুনিরা খুশি থাকলে দল খুশি, দল খুশি তো মন্ত্রী খুশি, মন্ত্রী খুশি তো নেত্রী খুশি। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি সহ সবই তো নেত্রীর দয়া। তাই নেত্রী খুশি মানে দেশ খুশি। আমরা খুশি। খুশি দেশের আইন-আদালত। নেত্রীদের খুশির জন্যেই তো আমাদের স্বাধীনতা। এবং এ স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছিলশ ত্রিশ লাখ মানুষ।
"...তখন আমার হাতে একটি চাপাতি ছিল আর রাজনের হাতে ড্যাগার। অন্যদের হাতে রড ও লাঠি। ইউনুছ, টিপু ও ওবায়দুর রড দিয়ে মারতে থাকলে ছেলেটি চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘আমার নাম বিশ্বজিৎ দাস, আমারে মাইরেন না।‘ এ সময় বিশ্বজিৎ দোতালায় উঠে গেলে রাজন বিশ্বজিৎকে ঘাই দেয়। আর আমি চাপাতি দিয়া বিশ্বজিতের হাত-পা ও পিঠসহ বিভিন্ন জায়গায় কোপালে বিশ্বজিৎ ফ্লোরে লুটিয়ে পরে..."। ঠান্ডা মাথায় বিশ্বজিতকে এভাবেই খুন করেছিল ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা। আহত বিশ্বজিতকে সাংবাদিকরা মরতে দেখেছে এবং কেবল ছবি তোলার মাঝেই সীমাবদ্ধ রেখেছে প্রফেশনাল ও মানবিক দায়বদ্ধতা। একজন রিক্সাচালক মৃত্যুপথযাত্রী বিশ্বজিতকে তুলে দিয়েছিল ডাক্তারদের হাতে। কিন্তু ডাক্তারদের হাতও ছিল বাঁধা। কারণ ছাত্রলীগ যাকে কুপিয়েছে তাকে বাঁচানো মানে দেশ, জাতি তথা নেত্রীর সাথে বেইমানি করা। তারও হাত গুটিয়ে নেয় এবং মরতে দেয় অসহায় একজন মানুষকে। ডাক্তার হিসাবে তাদেরও দরকার চাকরির নিশ্চয়তা, প্রয়োজন প্রমোশন। ছাত্রলীগকে নাখোশ করলে এ প্রাপ্তি অধরা থেকে যাবে এ সত্য এখন দেশের শাসনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ। আমার এ বক্তব্যের প্রমাণ মেলবে বিশ্বজিৎ খুনের ময়নাতদন্তে। ডাক্তাররা বিশ্বজিতের শরীর কেবল একটা একটা মাত্র ছুরিকাঘাতের চিহ্ন খুজে পেয়েছে এবং পুলিশের সুরে গলা মিলিয়ে একই ভাষায় জমা দিয়েছে ময়নাতদন্ত। নিজেদের আমরা কি ভাবে মূল্যায়ন করবো? পাথর যুগের বর্বর পশু হিসাবে, নাকি একবিংশ শতাব্দীর বিকাশমান মানব সভ্যতার উচ্ছিষ্ট হিসাবে?
প্রধানমন্ত্রীর মুখ নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। ট্যাক্সবিহীন মুখ হতে লাগামহীন কথাবার্তা উগড়ে ইতিমধ্যে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। নেত্রী চরিত্রের এ দিকটার উপর আলোকপাত করার জন্যে এ লেখা নয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এমন কিছু কথা বলেছেন যা মূল্যায়নের দাবি রাখে। বিরোধী দলীয় নেত্রীর ভারত সফরকে তিনি তেল মারার সফর হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। সাহিত্যের ভাষায় তা হবে ’তৈলমর্দন’। এই তৈলমর্দনের সাথে কমবেশি সবার পরিচয় আছে। বিশেষ করে নাগরিক হিসাবে যারা বাংলাদেশে বাস করেন। বিশ্বজিতের খুনিরা রিমান্ডে স্বীকার করেছে ছাত্রলীগের সামনের কমিটিতে ভাল পদের জন্যে শীর্ষ নেতাদের মনোযোগ আকর্ষনের জন্যেই ছিল এ বর্বরতা। পারফরমেন্স শো'র জন্যে তাদের তাগাদা ছিল। সে জন্যেই হরতালকে কেন্দ্র করে বেছে নিয়েছিল হতভাগা বিশ্বজিতকে। কে কতটা নির্মম হতে পারবে তার উপর নির্ভর করছিল পদের ক্যাটাগরি। একটা ভাল পদ মানে লাখ টাকার চাঁদা, কোটি টাকার টেন্ডার আর নেত্রীর পাশে দাঁড়ানো ছবি। বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে নতুন তারা হয়ে জ্বলতে চাইলে এসব শর্ত পূরণ করেই জ্বলতে হয়। এসব শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ কি কেবল বিশ্বজিতের খুনিরা? ম খা আলমগীর ও মোহম্মদ হানিফ সহ রাজনীতির যে সব ’বাঘা বাঘা’ চরিত্র দিনভর বুলি আওড়াচ্ছেন তা কি নেত্রীর মনোযোগ আকর্ষনের জন্যে নয়? খুনের উপর পুলিশ ও ডাক্তারের মিথ্যা ও বানোয়াট রিপোর্ট কি ক্ষমতার স্বাদ নিতে কারও মন জয় করার জন্যে নয়? হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টের বিচারক সহ দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা যে সব অলৌকিক তেলেসমাতি দেখাচ্ছে তার মূলেও কি তৈলমর্দন নিহিত নয়? গোটা দেশ চলছে এই মর্দন প্রযুক্তির উপর। এখানে কে কাকে মর্দন করবে, কখন করবে তার উপর নির্ভর করে জীবন সাফল্য। বিরোধী দলীয় নেত্রী না হয় তৈলমর্দন করতে প্রতিবেশী দেশে গেলেন; কিন্তু বস্তা ভর্তি ইলিশ, সুটকেস ভর্তি জামদানি আর টাঙ্গাইলের চমচম নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যখন একই দেশ সফর করেন তাকে আমরা কি বলে আখ্যা দেব? এখানে কেউ যদি নোংরা কোন ইঙ্গিত দেয় খুব কি অন্যায় হবে? ক্ষমতার রাজনীতিতে তৈলমর্দন কতটা ভয়াবহ হতে পারে ১৯৭৪-৭৫ সালের ঘটনা হতে প্রধানমন্ত্রী হয়ত শিক্ষা নেননি। হানিফের মত মর্দন দৌড়ে যারা এগিয়ে ক্ষমতার স্থায়ী পতনে তারাই সামনে আসবে এবং নমরূদ খেতাবে নেত্রীকে ঠেলে দেবে ছয় ফুট মাটির নীচে।
বিশ্বজিতের খুনিদেরও প্রয়োজন ছিল নেতামর্দন। মর্দনের তৈলাক্ততাই তাদের পৌছে দিত অভিষ্ট লক্ষ্যে যেমনটা পৌছে দেয় নেত্রীদের ভারতমর্দন।