চারদিকে কেবল খবর আর খবর। দাউ দাউ করছে জ্বলছে খবরের দাবানল। কোনটা রেখে কোনটা পড়ি বুঝতে পারিনা। বিদেশে বসে খবর নামক দেশীয় আগুনে ঝাপ দেয়ার যৌক্তিকতা ভাবতে গেলেও দ্বিধায় পরে যাই। অনেক সময় মনে হয় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর এ সংস্কৃতি হতে বেরিয়ে আসা উচিৎ। দিনান্তে চাওয়া পাওয়ার সমীকরণ মেলাতে গেলে মন হয় কার্যকর ফ্যাক্টর হয়ে দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে এসব খবর। এবং আমি কক্ষচ্যুত হচ্ছি প্রবাসী জীবন হতে। সাত পাচ ভেবে অনেক সময় এড়িয়ে যাই দেশীয় খবরের এসব তেজস্ক্রিয় বিষ। কিন্তু যতক্ষণ জেগে থাকি চোখের সামনে বিস্মৃত থাকে ভার্চুয়াল দুনিয়া। কি এক নিষিদ্ধ তাড়নায় আঙ্গুল আর চোখ চলে যায় হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ বাংলাদেশে। হাতের তাবৎ কাজ ফেলে নিমিষে মজে যাই খবরের মহাসমুদ্রে।
নয় বছর বয়সী গৃহকর্মীকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে গৃহকর্তার ১৮ বছর বয়সী শালা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শিশু মহিলা সহ ৪ যাত্রীকে ট্রেন থেকে ফেলে হত্যা। বগুড়ায় রণক্ষেত্র, নিহত ৩। নাটোরে নারী শ্রমিককে অপহরণ করে পাশবিক নির্যাতন। শিবচরে কিশোরী গণধর্ষণের শিকার, দুলাভাই শ্যালক আটক। সারা দেশে জামাত-শিবিরের তান্ডব, বাণিজ্য মেলা শেষেও ছাত্রলীগ ও পুলিশের চাঁদাবাজি। জুয়ার জন্যে খোঁড়া গর্তে লাশ হলো তিন কিশোর। ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে একজনকে পিটিয়ে হত্যা। টিনশেড ঘরে দুটি লাশ। নিষ্পাপ শিশু বর্ণালীর নিথর দেহ পরে আছে বিছানায়। অদূরে গলায় রশি পেঁচানো অবস্থায় ঝুলছে বাবা রশিদের লাশ। এবং লাশে লাশে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে গ্রাম গঞ্জের জনপদ। মানুষ মরছে এবং মারছে। পাশাপাশি মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ধর্ষনের মহোৎসব। শিক্ষক ধর্ষণ করছে ছাত্রীকে, মালিক ধর্ষণ করছে কর্মচারীকে। ৩ বছরের শিশুও রক্ষা পাচ্ছেনা ধর্ষকদের লালসা হতে। এমনকি পিতাও ঝাঁপিয়ে পরছে আপন কন্যার উপর। পৃথিবীর কোন দেশই হত্যা, গুম আর ধর্ষণের অভিশাপ হতে মুক্ত নয়। কিন্তু অপরাধের সার্বজনীন মহামারিতে আক্রান্ত বাংলাদেশের মত দ্বিতীয় এমন দেশের উদাহরণ আজকের পৃথিবীতে বিরল। এ বিবেচনায় আমরা অন্যন্য। হচ্ছেটা কি দেশটয়? জাতি হিসাবে আমরা কি তাহলে দেশপ্রেমের ঘাটতিতে ভুগছি? বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না। যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে আমাদের আশা নিরাশা, উদ্বেগ আবেগ আর দৃঢ়তার যে বজ্র শপথ তাতে আর যাই হোক দেশপ্রেমের ঘাটতি আছে বলে হয়না। ঘাটতি কি তাহলে কেবল খুনের নির্মমতায়? ধর্ষণের পঙ্কিলতায়? চাঁদাবাজির মহামারিতে? লুটপাটের কার্নিভালে? জাতীয় চরিত্রের এসব হিপোক্রেসি বলতে গেলে শক্ত আসন করে নিয়েছে আমাদের কথায় ও কাজে। এ নিয়ে কোথাও কোন উদ্বেগ নেই, প্রতিবাদ নেই। হয়ত জাতি হিসাবে আমরা মেনে নিয়েছি বাংলাদেশ মানেই চুরি, খুন, গুম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নেত্রী সন্তুষ্টির বলি।
বিরোধী দলীয় নেত্রী বিদেশি পত্রিকায় আর্টিকেল লিখেছেন। গণতন্ত্র রক্ষায় পশ্চিমা দুনিয়ার সহযোগীতা কামনা করে সরকার প্রধানের কিছু কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছেন। তাতে ক্ষমতাসীন দল ও তাদের উদরে লালিত রাষ্ট্রীয় সম্পদের উচ্ছিষ্টভোজী বুদ্ধি ব্যবসায়ীরা মহা অন্যায় আবিস্কার করে ফেলেছেন। রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে নেত্রীর বিচারের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন অনেকে। কেউ আবার বাড়ি ছাড়া করার মত দেশছাড়া করারও হুমকি দিচ্ছেন। এ নিয়ে সংসদে তুলকালাম চালাচ্ছেন সরকার দলীয় সাংসদরা। বিগত শাসনামলের পাপের বোঝায় নেত্রী খালেদা জিয়ার কোমর এমনিতেই ভাঙ্গা। সন্তানরা দেশ ছাড়া। যাদের নিয়ে রাজনীতি করছেন তাদের সবার পেট পূর্ণ। রাস্তায় বের হওয়ার মত ইচ্ছা, আকাঙ্খা ও প্রয়োজনীয়তা এদের কারোরই নেই। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট অনেক দিয়েছে এদের। রাজনীতি নামক হরিলুটের মাঠে নতুন করে চাওয়ার কিছু নেই এসব দুর্বৃত্তদের। এদের নিয়ে মাঠে নামা এবং সরকার পতনের আন্দোলন গড়ে তোলা খালেদা জিয়ার জন্য এখন দিবাস্বপ্ন। বেগম জিয়া হয়ত বুঝে গেছেন হাসিনা সরকারকে সরাতে আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। নির্দলীয় নির্বাচন ও বিদেশিদের প্রভাবই যথেষ্ট সরকার নামের এই দানবের পতন ঘটাতে। হয়ত পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই বেছে নিয়েছিলেন ওয়াশিংটন পোস্ট। বিশ্বায়নের পৃথিবী ও অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে এ ধরণের লেখালেখিকে যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় প্রশ্ন উঠবে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সরকার যখন দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিদেশি পত্রিকায় ক্রোড়পত্র বের করে তাকে কি হিসাবে বিবেচনা করা হবে?
ক্ষমতা স্বাদ বড় মধুর জিনিস। একবার নিলে বার বার নিতে ইচ্ছা করে। তাইতো অনেকে একে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেয়ার স্বপ্ন দেখেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাদেরই একজন। যতদিন বাঁচবো ততদিন ট্রাফিক জ্যামের দেশে মোটর বহর নিয়ে চলবো, ছেলে, মেয়ে, নায়-নাতি, ছেলে বৌ, বোনের সন্তান, তাদের স্ত্রী, সবাইকে নিয়ে সরকারী অর্থে রাশিয়া যাব, ভারত যাব, জাতিসংঘে ভাষন দিতে নিউ ইয়র্ক যাব, কে না চায় এসব বিনোদন! সমস্যা হচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্র অনেক সময় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক চড়ুইভাতিতে। এখানেই প্রয়োজন হয় একদলীয় বাকশাল অথবা এক ব্যক্তির রাজতন্ত্রের। শেখ হাসিনা ভেবে থাকবেন বাংলাদেশের মালিকানা শেখ পরিবারের কাছে লিখে দিতে জাতি বাধ্য, কারণ স্বাধীন বাংলাদেশ পরিবারিক দয়ার ফসল। অবস্থাদৃষ্টে মনেহচ্ছে ৭১ সালে প্রধানমন্ত্রীর পিতা একাই ৯০ হাজার পাকিস্তানিকে পরাজিত করেছিলেন, নিজে এবং পরিবারের সবাই নিয়ে নয় মাস যুদ্ধ করে জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন আজকের স্বাধীনতা। তাই উত্তরাধিকারী সূত্রে বাংলাদেশ তাদের। যতদিন বেঁচে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই বেঁচে থাকবেন, যখন যা চাইবেন তাই হবে, এমনটাই আমাদের শেখ হাসিনা। দরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের, লগি-বৈঠা দিয়ে কুকুর বেড়ালের মত মানুষ মারতে পাঠাবেন, আবার প্রয়োজন শেষে বলবেন এ সরকারের প্রয়োজন কি,আমি তো ক্ষমতায় আছিই? মাঝখানে খালেদা জিয়া ও বিএনপি নামের কিছু ’ভিনদেশি’ উটকো ঝামেলা পাকাবে কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি। তাই সরকারের সবকটা বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন হচ্ছে, শেষপর্যন্ত রক্ষা করতে পারবেন কি স্বঘোষিত রাজত্ব?
মার্কা মারা চোর আবুল হোসেনের কাপড়ের তলায় এমন কিছু লুকিয়ে আছে যা আড়াল করাটা প্রধানমন্ত্রীর জন্য ছিল জরুরি। ১৫ কোটি মানুষের কপালে চোরের ছাপ্পর লাগিয়ে চোরা আবুলকে রক্ষার যে মহান দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি তা সাপ হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য। জামাতিদের গাড়িতে মন্ত্রিত্বের পতাকা উড়িয়ে খালেদা জিয়া যে খপ্পরে পরেছেন তারই কার্বন কপি হতে যাচ্ছে চোরা আবুল পর্ব। এ যাত্রায় কারবালার মাঠে নয়, হাসান-হোসেনের কবর হবে পদ্মার পানিতে এবং সহযাত্রী হবেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। ’আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জনগণ কিছু পায়’- সমস্যাজর্জরিত ১৫ কোটি মানুষের সাথে এ ধরণের মিথ্যাচার অনেকটা জোচ্চুরির সামিল। কিছু যদি পেত তাহলে আর শ্রীলংকার পানিতে ডুবতে শতাধিক স্বদেশিকে ঘর ছাড়তে হতনা। বাস্তবতা হচ্ছে পারলে ১৫ কোটির সবাই দেশ ছেড়ে পালায়। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ হয়ে পালানোর রাস্তা খুজতে গিয়ে বাংলাদেশিরা ডুবে মরছে ভূমধ্য সাগরে, কংকাল হচ্ছে সাহারা মরুভূমিতে, জমে বরফ হচ্ছে ইউরোপীয় কনটেইনারে। অবশ্য এ তালিকায় প্রধানমন্ত্রীর নিজ পরিবারের কেউ আছে তা নয়। সম্পদের অথৈ সাগর পাড়ি দিতে তাদের কাউকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা আর যুক্তরাজ্যে তাদের জীবন নিরাপদ রাখতে আইন পর্যন্ত পাশ করা হচ্ছে সংসদে।
জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতিবিদদের শেষ পরিণতি জানতে আমাদের নিশ্চয় বিদেশ যাওয়ার দরকার হবেনা। দেশেই এর যথেষ্ট উপকরণ আছে। সময় এবং সুযোগ থাকলে প্রধানমন্ত্রী আশাকরি দেশীয় এ অধ্যায়ের পাতা গুলো উলটে দেখবেন।