এ জোয়ারেই ভেসে যেতে হবে তাদের। এবং তা চিরদিনের জন্য। রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী অধ্যায়ের সমাপ্তি টানার এটাই উপযুক্ত সময়। একচল্লিশ বছর ধরে গলায় কাঁটা হয়ে আটকে আছে এ পাপ। গোলাম আজম, আবদুল আলিমদের দুয়ারে আজরাইল হানা দেয়ার সময় হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু এদের স্বাভাবিক মৃত্যু সৃষ্টিকর্তার সম্মুখ ফ্রন্টের এসব জেনারেলদের অস্তিত্বকেই কেবল কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। তাই শাহবাগ মোড়ই হোক এদের শেষ মোড়। এবং এখান হতেই শুরু হোক অনন্ত পথের যাত্রা। একটা অকার্যকর সমাজের যতটুকু ক্লেদ তার সবটা ঝেকে বসেছে আমাদের শরীরে। চার দশক পার হয়ে গেলেও স্বাধীন জাতি হিসাবে মেরুদণ্ড সোজা করার অবকাশ পাইনি আমরা। ৭১’এর পাপ আর বিগত একচল্লিশ বছরের পাপ মিলে আমাদের ভিত্তিকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। খুনী, ধর্ষক ছাড়াও ওদের আরেকটা পরিচয় ছিল, ওরা এদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি। ভুলেও কোনদিন স্বীকার করেনি ৭১’এর ভূমিকা ছিল ভুল। কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়া দুরে থাক সামান্য অনুশোচনা পর্যন্ত করেনি। যুদ্ধাপরাধ নতুন কোন আবিস্কার নয়। সভ্যতার পরতে পরতে ঘাপটি মেরে আছে এই অন্যায়। সব অপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো গেছে এমনটা নয়। কিন্তু গণহত্যা ও গণধর্ষণের ’শাস্তি’ সরূপ কাউকে মন্ত্রিত্ব দেয়া হয়েছে এমন উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল। কিন্তু এমনটাও সম্ভব হয়েছে এ দেশে। ক্ষমতার লোভে খুনিদের গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে দিতেও কার্পণ্য করেনি ক্ষমতালিপ্সু স্বদেশির দল। মুক্তিযুদ্ধের ঠিকাদার দাবিদারদেরও আশীর্বাদ নিতে হয়েছে পদের লোভে। ক্ষমতার সমীকরণ খুনিদের দিয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বীকৃতি। তাই সুঁই হয়ে ঢুকে এখন সাপের মত ছোবল হানছে কাদের মোল্লারা। কে দায়ী এ অবস্থানের জন্য? আমজনতা? খেটে খাওয়া কোটি কোটি মানুষ?
যুদ্ধাপরাধ কোন রাজনৈতিক ইস্যু নয় যা নিয়ে অনন্তকাল ধরে মাঠ গরম রাখা যাবে। অপরাধ ও শাস্তি প্রক্রিয়ার এ অবিচ্ছেদ্য অংশ। সভ্যতা বিকাশের সমান্তরাল পথ এটা। পৃথিবী হেঁটেছে এ পথে। কিন্তু আমরা হাটিনি। কোলে নিয়ে নেচেছি ওদের, অন্ধকারে সহবাস করেছি, প্রয়োজনে লাথি মেরে স্বার্থ উদ্ধার করেছি। কেবল নয় মাস নয়, একচল্লিশটা বছর ধরে ঘুরপাক খাচ্ছি এ খপ্পরে। ’৭১ এর রক্তাক্ত অধ্যায়কে পুঁজি বানিয়ে দাবা খেলার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ব্যস্ত আমাদের রাজনীতি। গল্পের মত লম্বা নাকে রাজাকারের মুলা ঝুলিয়ে জাতিকে গাধা বানিয়ে ওরা সওয়ার হয়েছে অনন্ত যাত্রায়। শাহবাগের গর্জন নাটের গুরু গোলাম আজম খুব কাছ হতে নাকি শুনছেন। ভয়ে বিছানা পর্যন্ত নষ্ট করছেন। হয়ত ইয়া নফসি ইয়া নফসি জপছেন আর মৃত্যু দেবতার সান্নিধ্য খুব কাছ হতে উপলব্ধি করছেন। এক কাদের মোল্লা হয়ত দাবার চালে ফসকে গেছেন, কিন্তু বাকিরা ফস্কে যাবেন এমনটা বোধহয় না। খেলারামদের দরবারে অন্তত এ এলান টুকু পৌছে গেছে, শাহবাগই শেষ বাগ নয়।
হয়ত দিনান্তে দিগন্ত রেখা হতে মুছে যাবে রাজাকার কালিমা, রাজনীতির ঘুঁটি হতে মুক্তি পাবে কলঙ্কিত এ অধ্যায়। কিন্তু তারপর? যারা এ অধ্যায় সৃষ্টি করার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য গড়েছেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ উজাড় করেছেন, জাতির চরিত্রে দুর্নীতির বিষাক্ত পুঁজ ঢুকিয়ে দিয়েছেন তাদের কি হবে? গোলাম আজম অধ্যায়ই আমাদের একমাত্র পাপের অধ্যায় নয়। আমাদের পাপ গোটা শরীরে। এ পাপ নদীর পানিতে, এ পাপ রেলের বগিতে, বিদ্যুতের আলোতে, ব্যাংকে, বীমায়, শিক্ষাঙ্গনের প্রতি বাঁকে। স্বাধীনতার অর্থ কেবল রাজাকারের ফাঁসির দাবি হতে পারেনা। কজন অপরাধীর অপরাধের মাঝে থেমে থাকেনা আমাদের জীবন। আমাদের চলতে হয়। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের নদীতে নামতে হয়, রেলে উঠতে হয়, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়। ৭১’এর হায়েনার মত এসব পথে এখন নব্য হায়েনাদের অবাধ চলাফেরা। ৭১’এর মতই বাংলাদেশ এখন খুন, গুম, ধর্ষণ আর লুটপাটের অভয়ারণ্য। সুস্থ সবল জাতি হিসাবে সভ্যতার যাত্রাপথে পা মেলাতে চাইলে এসব নব্য রাজাকারদের খপ্পর হতে মুক্তি পাওয়াটাও জরুরি। দেশটা কারও পৈত্রিক অথবা স্বামীর সম্পত্তি নয় যাকে নিয়ে আজীবন দাবা খেলা যাবে। কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি মিহি হয়ে উঠার আগেই জন্ম নিতে হবে এ দাবি, মুক্তি চাই হাসিনা-খালেদার স্বৈরতন্ত্র হতে।