সময় কেন জানি ৭৩-৭৪ সালের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঢাকা কলেজের পড়ি তখন। স্কলারশিপের সামান্য টাকার জন্য মাসের পর মাস স্বপ্ন দেখি। হরেক রকম বাজেট করে অপেক্ষায় থাকি। মেট্রিক পরীক্ষায় ভাল ফল করার কারণে সরকার মহাশয় মাসিক একটা অংক দিচ্ছেন। পরিমানে যৎসামান্য। পরিবারের উপর নির্ভরশীল কৈশোর উত্তীর্ণ একজন যুবকের কাছে এ অংক ছিল স্বপ্নের মত। ছয় মাসের পাওনা ব্যাংক হতে উঠিয়ে কলেজের দিকে রওয়ানা হয়েছি মাত্র। তলোয়ারের মত চকচক করা কিছু একটা নিয়ে সামনে দাঁড়ালো। ভেবেছিলাম হয়ত একজন। কিন্তু ভুল ভাঙ্গতেই দেখলাম ওরা বেশ কজন। কেবল ছুড়ি নয়, চাদর সরিয়ে একজন সাব-মেশিনগান দেখাল এবং হুমকি দিল খুলি উড়িয়ে দেয়ার। দিতে হল টাকা গুলো। এতদিনের লালিত স্বপ্ন মুহূর্তে মাটিতে মিশে গেল। চোখের পানি গোপন করে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে গেলাম কলেজে। শোকের উপর ভর করে শরীরের উপর আছর করল ভয়। সে রাতেই গা কাঁপিয়ে জ্বর এল। মায়ের কোলে ফিরে যেতে বাধ্য হলাম। প্রায় এক মাস শরীর ও মনের সাথে যুদ্ধ করে ফিরে এলাম ঢাকা শহরে। কেবল ঢাকা শহর নয়, গোটা দেশের জন্যই সময়টা ছিল ভয়াবহ। চারদিকে হরেক রকম বাহিনীর রাজত্ব। লাল বাহিনী, নীল বাহিনী, রক্ষী বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় ভাবে আমাদের শহরে ষ্টীম রোলার চালাচ্ছিল গুরু পার্টি নামের একদল হিংস্র হায়েনা। বলাই বাহুল্য ওরা ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাতে অস্ত্র, মগজে মন্ত্র আর ডানে বায়ে বিগ ড্যাডিদের নিশ্চিদ্র ডানা, এভাবেই রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠছিল নতুন এক প্রজন্ম, রাজনীতির নষ্ট সন্তান।
৭১’এর মুক্তিযুদ্ধ তথা মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিশ্চিতভাবে বদলে দিয়েছিল জাতি হিসাবে আমাদের যাত্রা। আমার মত যারা রাস্তার সামান্য দুর্ঘটনায় মুষড়ে যেত তারা অবাক হয়ে দেখতে শুরু করল নতুন এক অভ্যুদয়, হত্যা। একটার পর একটা লাশ নাভিশ্বাস উঠিয়ে দিত স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর প্রতি মানুষের আস্থায়। হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর মত ওরা আসতো। গভীর রাতে খুব হাল্কা ভাবে দরজায় নক করতো। পালানোর রাস্তা নিশ্চিদ্র করেই নিজদের উপস্থিতি জানান দিত। এর পরের ইতিহাস খুব সংক্ষিপ্ত, নতুন একটা লাশের জন্য জায়গা করে দিত জননী জন্মভূমি। এভাবেই শুরু আমাদের। অর্চনার অঞ্জলি সরিয়ে রক্ত-মাংসের কাউকে সামনে দাঁড় করানো আজ প্রায় অসম্ভব। কারণ ওরা দেবতা, আর আমরা পুজারী। অথচ এই দেবতারাই আজরাইল পাঠাতেন। ক্ষমতার মসনদ পোক্ত রাখার বলি হিসাবে বেছে নিতেন অবাধ্য পূজারিদের। এবং হাটে, মাঠে, ঘাটে তাদের বলি হত। ৪২ বছর বয়স আমাদের, অথচ জাতি হিসাবে কোনোদিনই মুখ খুলতে পারিনি। খাচায় বন্দী তোতা পাখির বুলি কপচাতে গিয়ে আমরা বোধহয় ভুলে গেছি স্বাধীনতার অর্থ কেবল দেবতার বেদিতে অঞ্জলী নিবেদন নয়, বরং স্বাধীন ভাবে বেচে থাকা, অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা সহ স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর নিশ্চয়তা পাওয়া।
ভেবেছিলাম হয়ত শাহবাগ চত্ব্বর দিয়েই শুরু হতে যাচ্ছে আমাদের নতুন অধ্যায়। ইদানিং কালের আরব স্প্রীং’এর শুরুটাও ছিল একই রকম। ভার্চুয়াল দুনিয়ার কিছু সমমনা মানুষ চিন্তা ভাবনার মিলন মেলা হিসাবে বেছে নিয়েছিল একটা নির্দিষ্ট জায়গা। ডাক দিয়েছিল পুরোনোকে ছুড়ে ফেলে নতুন কিছু গ্রহন করার। সে ডাক শহর বন্দর পেরিয়ে ছড়িয়ে পরেছিল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভে তুসের আগুন জ্বালিয়েছিল ভার্চুয়াল স্ফুলিঙ্গ। আগুনে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছিল তিউনেসিয়া আর মিশরের একনায়কেরা। তখত তাউস কেঁপে উঠেছিল মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচারী রাজা বাদশাহদের। মুহূর্তের জন্য হলেও স্বপ্ন দেখেছিলাম ৭১’এর কসাইদের বিচার দাবি হয়ত উপলক্ষ মাত্র। তার পেছনেই হয়ত ধেয়ে আসছে আসল সুনামী। আশা করেছিলাম ৪২ বছর ধরে সাড়ে সাত কোটি হয়ে পনের কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে যারা জুয়া খেলেছে তাদের দিন ফুরাতে যাচ্ছে। কিন্তু হায়, বিচারে আমার বোধহয় কিছুটা ভুল ছিল। ভুলেই গিয়েছিলাম এ বাংলাদেশ। এখানে বসন্ত কেবল হলুদ শাড়ি, কোকিলের কুহুতান আর কবিতার মেলা।
কাদের মোল্লার শাস্তি পর্বের গভীরে ঢুকলে কেন জানি সন্দেহ জাগে। গন্ধ পাওয়া যায় পাতানো খেলার। মনে হয় প্রতিভাবান কিছু লোকের নিপুন স্ক্রীপ্টে অভিনয়ের জন্য মাঠে নেমেছিল ভার্চুয়াল দুনিয়ায় কজন দলীয় ক্যাডার। ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধ নিয়ে নতুন প্রজন্মের ক্ষোভ অনেকদিনের। নাটকের কারিগরদেরও তা জানা ছিল। অজগর নিয়ে খেলতে গেলে দংশনের ভয় থাকে। জামাতিরাও অজগর। ৪২ বছর ধরে ওদের নিয়ে অনেক ওঝা খেলে গেছে। বিচারকের আসনে বসা আওয়ামী লীগও খেলেছে। চরিত্রহীন রাজনীতির ধারক, বাহক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হঠাৎ করে এ পথ হতে সরে গেছে বিশ্বাস করতে কেন জানি কষ্ট হয়। পদ্মাসেতু, হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক, শেয়ার মার্কেট, কুইক রেন্টাল ও ছাত্রলীগ নামের প্লেগ ও মহামারিতে আক্রান্ত একটা রাজনৈতিক দলের পতন ঠেকাতে প্রয়োজন ছিল কিসিঞ্জারি কৌশল। কাদের মোল্লার রায় সে কৌশলেরই অংশ কিনা তা হয়ত পরিষ্কার হবে। মোল্লাই একমাত্র আসামী নয়, রায়ের সিঁড়িতে দলবেঁধে অপেক্ষা করছে সাইদী, নিজামী, গোলাম আজমের মত ’বাঘ-ভল্লুকের’ দল। বাংলাদেশের কনটেক্সটে এদের মৃত্যুদণ্ড আমাদের অস্তিত্বকে শক্ত করবে কেবল। পাশাপাশি জাতিও মুক্তি পাব ঝুলে থাকা কলংক হতে । প্রশ্ন উঠবে, বিচারের হিসাব নিকাশ হতে আওয়ামী লীগের প্রাপ্তি কি হবে? - শূন্য! শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে যাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তাদের নিয়ে নতুন কোন রাজনীতি হালে পানি পাওয়ার কথা নয়। গোলাম আজমকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার অপরাধ নিয়ে রাজনীতি করারও অবকাশ থাকবেনা। তাহলে কোন পথে হাঁটবে আওয়ামী রাজনীতি? নতুন প্রজন্মকে কাছে টানায় কি হবে তাদের কৌশল? ‘আমরা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছি’ - এ দাবির প্রতিধ্বনি বেশিদূর গড়াবে বলে মনে হয়না। কাদের মোল্লার রায় নিয়ে সন্দেহটা এখানেই। রাজনীতির হিসাব মতে ক্ষমতাসীন দলের ইশারায় আদালত রায়কে নির্বাচন পর্যন্ত প্রলম্বিত করবে এবং মোল্লার কায়দায় দু একটা রায় দিয়ে তরুন প্রজন্মকে আবারও মাঠে নামাবে। উদ্দেশ্য? - বিরোধী দলকে ঘরকুনো করা। ফলাফল? - নির্বাচনে জেতা।
প্রজন্ম চত্ত্বরে জনগণের অংশগ্রহন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এ নিয়ে তেনা পেঁচানোর কিছু নেই। আস্তিক-নাস্তিক তর্কের অবতারণা ঘটিয়ে জনগণের ইচ্ছাকে ধরাশায়ী করার অপচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। বাস্তবতা হচ্ছে ক্রাইসিস জনগণকে রাস্তায় নামায়। আমাদের ইতিহাসও এ পথে আবর্তিত হয়েছে। এ যাত্রায় খুব কৌশলে জাতিকে গেলানো হয়েছে কাদের মোল্লার রায়ও ছিল ক্রাইসিস। প্রশ্ন উঠবে, কিসের ক্রাইসিস? আর্ন্তজাতিক আদালত সরকারের সৃষ্টি, আদালতের বিচারকও সরকার কর্তৃক নির্বাচিত। এমন একটা আদালতের রায়ের বিরোধীতা মানে সরকারের বিরোধীতা। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে রায়ের প্রতি আস্থা রাখাটাও ছিল জরুরি। কিন্তু এ নিয়ে আদালতের যেমন মাথা ব্যথা নেই, তেমনি আন্দোলনকারীদের মুখেও উচ্চারিত হয়নি সরকারের নাম। উলটো সরকার প্রধান সংহতি প্রকাশ করছেন আন্দোলনের সাথে। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে গোটা ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হবে। সন্দেহের বীজ হতে অংকুর গজায় এখানেই।