তুতসি হুতুদের কাহিনী যাদের জানা নেই তাদের উচিৎ হবে আধুনিক সভ্যতার এই ট্রাজেডি নিয়ে কিছুটা সময় ব্যয় করা। অনেক কিছু শেখার আছে নির্মম এ অধ্যায় হতে। পূর্ব আফ্রিকার ছোট দেশ রুয়ান্ডা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা জাতিগত দাঙ্গার বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৯৪ সালে। ১০০ দিনের চলমান সহিংসতায় প্রাণ হারায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সংখ্যা দেশটার মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। সংখ্যালঘু তুতসিরা শতাব্দি ধরে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল সংখ্যাগুরু হুতুদের। ষাট দশকের শুরুর দিকে বিদ্রোহের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয় হুতুরা। এবং গোলমালের শুরু এখানেই। তুতসি জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় প্রতিবেশী দেশ উগান্ডায়। ১৯৯০ সালে রুয়ান্ডান পেট্রিয়টিক ফ্রন্ট নামের তুতসিদের একটা দল উত্তর রুয়ান্ডায় হামলা চালায়। তাদের অধিকাংশই ছিল শরনার্থী। এই গ্রুপের পেছনে ছিল সমর্থন ছিল উগান্ডা ও ফ্রান্সের। তাদের ছিল স্ব স্ব স্বার্থ। আক্রমনের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন হুতু সরকার দেশটার সংখ্যাগুরুদের বুঝাতে সক্ষম হয় তুতসি নিধন ছাড়া জাতিগত আধিপত্য চিরস্থায়ী করা সম্ভব হবেনা। হুতুরা লুফে নেয় নেতাদের এই আহ্বান। এবং রাষ্ট্রের স্পনসরে পৈশাচিক উন্মত্ততায় ঝাঁপিয়ে পরে তুতসিদের উপর। একই চামড়ার, একই চেহারার স্বদেশিদের কচুকাটা করে ছুড়ে ফেলে বর্য পদার্থের মত। কুকুর আর শকুনের দল খুলে খাবলে খেতে শুরু করে লাশের পাহাড়। হুতুরা নাকি তেলাপোকা। ওরা বলতো আমরা মানুষ মারছি না, মারছি তেলাপোকা।
রুয়ান্ডান হুতুদের সাথে কোথায় যেন মিল পাওয়া যায় বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। হুতুদের মতই প্রতিপক্ষ তাদের কাছে তেলাপোকা। অর্থাৎ রাজাকার। আফ্রিকার হিংস্র দানবদের মত আওয়ামী নেতারাও দেশের যুব সমাজকে উস্কে দিয়েছে রাজাকার নিধনের উন্মাদনায়। গোটা দেশ নাচছে খুনের নেশায়। দলীয় ব্লগার, সংবাদ মাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায় দেশকে চূড়ান্ত ভাবে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছে ক্ষমতাসীন দল। দেশ এখন রক্তাক্ত জনপদ। চারদিকে লাশের মিছিল। যে যেখানে পারছে খুন করছে এবং দুদিনের ব্যবধানে লাশ পরেছে শতাধিক। জাতি উল্লাস করছে এ হত্যায়। আনন্দে নাচছে, মিষ্টি বিতরণ করছে। দলীয় পুলিশ, বিজিবি এমনকি সেনাবাহিনীকেও ব্যবহার করা হচ্ছে ফ্রি লাইসেন্স হত্যাকাণ্ডে। মিডিয়া বলছে মানুষ মরছে না, মরছে রাজাকার। ওরা ’৭১ এর দানব, তাই ওদের মারায় উল্লাস আছে, আছে মাদকতা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যে শিশু পৃথিবীর মুখ দেখেনি তার লাশও ঠাঁই পাচ্ছ রাজাকারের তালিকায়। দেশ এখন চূড়ান্ত ভাবে বিভক্ত; এক পক্ষ আওয়ামী লীগ ও অন্য পক্ষ রাজাকার। খোলা চোখের সাধারণ হিসাবে দেশে এত রাজাকার থাকার কথা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এল কোত্থেকে?
শতকরা ৯৯ ভাগ জনসমর্থন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেত্রীত্ব দিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ। অংকের হিসাবে সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার সাত লাখের কিছু বেশি মানুষ সমর্থন করেনি দলটাকে। এখানেও প্রশ্ন উঠবে, সাড়ে সাত কোটির সবাই কি ভোটার ছিল? অথবা, যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি তাদের সবাই কি রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছিল? স্বাধীনতা উত্তর প্রথম দিকের নির্বাচনেও হেরফের হয়নি এ সংখ্যার। ৪২ বছর পর আমাদের জনসংখ্যা এখন দ্বিগুন, ১৫ কোটি। সরল নিয়মে রাজাকার না হোক এন্টি আওয়ামী লীগারদের সংখ্যা হওয়া উচিৎ ছিল ১৫ লাখ। বাস্তবে কি তাই? কোথায় গেল পাহাড় সমান জনসমর্থন? কোথায় গেল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা? হিসাব মতে আজকের বিশ বছর বয়সী রাজাকারের পিতা মাতাও ছিল আওয়ামী লীগের। স্বাধীনতার ৪২ বছরের ভেতর দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, অর্থাৎ, নাম লিখিয়েছে রাজাকারের খাতায়। এখানে কিছুই কি শেখার ছিলনা আওয়ামী লীগের? রাজাকার বিচারের মাদকতায় আজ যারা নেশাগ্রস্ত ৭০ দশকে তাদের অনেকেরই জন্ম হয়নি। ক্ষমতার মসনদে তখনও আওয়ামী লীগ। ৯৯ ভাগ জনসমর্থনও নিয়েও সন্তুষ্ট ছিলেন না সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশটার নেতা শেখ মুজিব। হরেক রকম বাহিনী সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে। শেষ পর্যন্ত বাকশালের পথে পা বাড়িয়ে দেশকে পারিবারিক সম্পত্তি হিসাবে আজীবনের জন্য ইজারা নিতে চেয়েছিলেন। বিপদজনক ছিল সে পথ, এবং তিনি তা জানতেন এবং তার জন্য চরম মূল্য দিয়েছেন। একই পথে কি হাঁটছেন না মুজিব তনয়া?
আজকের জামাতী জঙ্গী তত্ত্বের জন্মও কি আওয়ামী ঔরসে নয়? দেশকে লুটপাটের ভাগার বানিয়ে অপশাসন ও কুশাসনের অভয়ারণ্য বানালে তা হতে বাই-প্রোডাক্ট জন্ম নিতে বাধ্য। আজকের ২০ বছর বয়সী রাজাকারের দল তেমনি কিছু বাই-প্রোডাক্ট। লগি-বৈঠার তান্ডব ও লাশের উপর পৈশাচিক নাচ হতে শিক্ষা নিয়ে ওরা আজ হায়েনার মত হিংস্র। খুব কি অপরিচিত মনে হচ্ছে জামাত-শিবিরের তান্ডব? ভিডিও ক্যামেরার স্লো মোশনে ধারণ করা বিকাশ হত্যার ইতিহাস কি আমরা ভুলে গেছি? উন্মত্ত পশুর মত কলেজ ছাত্রাবাস জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা কি জাদুঘরের স্মৃতি? কজনের বিচার হয়েছে, কজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে? কজন ছাত্রলীগ নামের পশুকে গোয়াল ঘরে ফেরৎ পাঠানো হয়েছে? থাবা বাবার হত্যাকারীদের সপ্তাহ না ঘুরতেই ধরা হল, অথচ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড থেকে গেল তিমিরে। আইনী শাসনের এসব হিপোক্রেসি আজ অজগর হয়ে ছোবল হানছে, দায়ী কি কেবল জামাতিরা?
কথা ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। সে উদ্দেশ্যে ট্রাইবুনাল বসানো হল। বিচারক নিয়োগ দেয়া হল। ঢাক ঢোল পিটিয়ে শুনানির আয়োজন করা হল। মাসের পর মাস চললো সে শুনানি। অথচ রায়ের জন্য বসানো হল শাহবাগী সরকার। আদলতকে জিম্মি করে রায় বের করার নাম আর যাই হোক বিচার হতে পারেনা। এ শ্রেফ ভাওতাবাজি, এক অর্থে রাজনৈতিক ক্রসফায়ার। সাইদী, নিজামীদের আসল ক্রসফায়ারে মারতে চাইলে জনগণ বিরোধীতা করবে এমনটা ভাবার কারণ ছিলনা। তাতে সহজ হয়ে যেত সমীকরণ। প্রয়োজন পরত না পাখির মত গুলি করে মানুষ মারার। এখানেই ফুটে উঠে সরকারের আওয়ামী চরিত্র। কাদের মোল্লার কাধে বন্দুক রেখে বিরোধী দল নিধন করার কুট কৌশলের জন্যই ব্যবহার করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক আদালত। রায় রায় খেলা নির্বাচন পর্যন্ত ঠেলে নিতে পারলে দেশের মাটি হতে নিশ্চিহ্ন করা যাবে বিরোধী দল, এবং বাস্তবায়ন করা যাবে শেখ মুজিবের অবাস্তবায়িত স্বপ্ন, বাকশাল। দেশকে পারিবারিক সম্পত্তি হিসাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিতে চাইলে বাকশাল কায়েম এ মুহূর্তে খুবই জরুরি। বিশেষ করে শেখ হাসিনা ও তার ঔরশদের জন্য।