শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন ‘এল্ কমানডান্তে’। গোটা দক্ষিন আমেরিকা জয় করতে সক্ষম হলেও এ যাত্রায় মরণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে পরাস্ত হয়েছেন। হুগো রাফায়েল শ্যাভেজের উত্থানকে যারা কাছ হতে দেখেছেন তাদের জন্য এ ছিল অপ্রত্যাশিত। স্বদেশবাসীর মত বাইরের দুনিয়ার অনেকে বিশ্বাস করত শত লড়াইয়ের মত এ লড়াইয়েও তিনি বেরিয়ে আসবেন বীরের বেশে। কিন্তু তা ঘটেনি। ২০১১ সালে প্রথম ধরা পরে অসুখটা। থেমে থেমে চিকিৎসা করছিলেন বন্ধু দেশ কিউবায়। প্রথম সার্জারীর পর বলা হয়েছিল ক্যান্সার ঠেকানো গেছে। কিন্তু ১৮ মাস পর ফিরে যেতে বাধ্য হন হাভানায়। শ্যাভেজ বিশেষজ্ঞদের অনেকে ধরে নিয়েছিল এ যাত্রাই হয়ত শেষ যাত্রা। অবশ্য সবাইকে ভুল প্রমাণ করে তিনি ফিরে এসেছিলেন ভেনিজুয়েলায়। এবং এ ছিল তার শেষ ফেরা। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেলেন দক্ষিন আমেরিকার এই বিতর্কিত নায়ক।
ইউরোপ ও এশিয়ায় সমাজতন্ত্রের সূর্য তখন ডুবি ডুবি করছে। এক কালের শক্ত মানব ফিদেল কাস্ট্রোও বয়সের ভারে জর্জরিত। ঠিক এমন এক সময়ে অনেকটা মধ্যরাতের অশ্বারোহীর মত দিগন্তরেখায় আবির্ভূত হন হুগো শ্যাভেজ। শক্ত হাতে হাল ধরেন সমাজতান্ত্রিক ডুবন্ত জাহাজের। তেল সমৃদ্ধ ভেনিজুয়েলার বঞ্চিত মানুষের জন্য বয়ে আনেন আশার আলো। বদলে দেন দেশটার সামাজিক কাঠামো। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান সহ বেচে থাকার নূণ্যতম চাহিদার অনেক কিছুই পৌছে দেন দেশটার গরীব মানুষের ঘরে। স্বভাবতই এ ধরণের পরিবর্তন ক্রোধান্বিত করে সমাজের উঁচুতলার মানুষদের। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে সরকার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি পশ্চিমাদের পুরানো ক্ষতের নতুন সংস্করণ। হুগো শ্যাভেজ ছিলেন এই ধারার নতুন কাণ্ডারি। যুগ যুগ ধরে তেল বিক্রির অর্থে লালিত ভেনেজুয়েলান এলিট সোসাইটি তাদের পোষ্যদের নিয়ে শ্যাভেজের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হয়। যার প্রতিফলন ঘটে সামাজিক বিভক্তির মাধ্যমে। ২০০৬ সালের বসন্তের শুরু কেবল। ছুটি কাটাতে আমি তখন দক্ষিন আমেরিকার দেশ কলোম্বিয়ায়। ক্যারাবিয়ান সাগর পারের শহর কার্তাখেনা দ্যা ইন্ডিয়ায় পরিচয় হয় একদল ভেনেজুয়েলান ট্যুরিস্টদের সাথে। হুগো শ্যাভেজকে নিয়ে দেশটার বিভক্তি এত ছোট পরিসরেও প্রকট হয়ে ফুটে উঠতে সময় লাগেনি। কেউ একজন নেতার নাম মুখে আনতে একদল ’ভিভা শ্যাভেজ’ ও অন্যদল ’ডাউন উইথ শ্যাভেজ’ চীৎকারে জানান দেয় নিজদের বিভক্তির কথা। অবশ্য গোটা এপিজোডে কোথাও বাংলাদেশের কলুষিত বিভক্তি প্রতিফলিত হয়েছে বললে বাড়িয়ে বলা হবে। তাই বলে অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ দাবিয়ে রাখতে পারেনি হুগো শ্যভেজ তত্ত্বের দক্ষিন আমেরিকান প্রভাব। প্রতিবেশি ইকুইয়ডরের এভো মরালেস, পেরুরু অইলান্তা ওমালা সহ দক্ষিন আমেরিকার প্রায় প্রতিটি দেশে হুগো শ্যাভেজ এখন পলিটিক্যাল ফ্যাক্টর।
রাজনৈতিক পণ্ডিতদের অনেকে ভেবেছিলেন শ্যাভেজের বিদায় হয়ত ভেনিজুয়েলাকে ফিরিয়ে আনবে মার্কিন ক্যাম্পে। কিন্তু সে আশায় অকালে কালি লেপ্টে দিলেন দেশটার ভাইস প্রেসিডেন্ট। আজই কারাকাস হতে দুজন মার্কিন কূটনীতিবিদকে বহিষ্কার করেছে ভেনেজুয়েলান সরকার। নতুন প্রশাসন শ্যাভেজের ক্যান্সারের জন্য দায়ী করছে পশ্চিমাদের। তারা বলছে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের প্রিয় নেতাকে। এ নিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে নতুন ক্রাইসিস, যার ভিলেন হিসাবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি গুলো। ঘটনা যেদিকেই গড়াক না কেন হুগো শ্যাভেজ আপন মহিমার টিকে থাকবেন লাখ লাখ লাতিনদের হৃদয়ে। সায়মন বলিভারের স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়ন করে গেছেন এই নেতা সময়ই তা প্রমাণ করবে। কিন্তু ক্ষুধা ও দরিদ্রের সাথে লড়াই রত কোটি কোটি দক্ষিন আমেরিকানদের হৃদয়ে হুগো শ্যাভেজ একজন সাইমন বলিভার হিসাবেই বেচে থাকবেন আজীবন।