আজ শনিবার। কাল অফিস নেই, হাতে অফুরন্ত সময়। ঘরে বাইরের কাজ সেরে বিছানায় গা এলিয়ে ভাবছিলাম আজ আর লেখালেখির দিকে যাবো না। প্রচুর লিখেছি এক সপ্তাহে। ক্রিকেট দেখে রাত পার করার ইচ্ছাটা নতুন করে মাথায় চাপলো। গিন্নিকে বলতে সে মুচকি হাসলো। বিশ্বাস করলো না আমার কথা। নিশ্চিত ভাবে ধরে নিল রাত জেগে ব্লগ লিখতে যাচ্ছি এবং ক্রিকেটকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করছি মাত্র। বললেও সে বিশ্বাস করবেনা, তাই তর্কে যেতে মন চাইলোনা। গিন্নিকে নিয়ে এই এক যন্ত্রণা, কিছুতেই বুঝানো যায়না কেন এই লেখালেখি। তার বিচারে ব্লগ নিয়ে আমার এই মাতামাতি এক ধরণের উন্মাদনা। সরল সমীকরণে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত। তার ভাষায় কৃষকদের কাজ যেমন কৃষিকাজ, রাজনীতির জন্যও আছেন রাজনীতিবিদ। সে বিচারে আমার মত একজন প্রকৌশলীর কাজ হওয়া উচিৎ প্রযুক্তি নিয়ে সময় ব্যায় করা। যুক্তি আছে তার কথায়। উদাহরণ হিসাবে নিজ দেশের রাজনীতিকে যখন সামনে আনে চুপসে যেতে হয়। জন্মভূমির সবটুকু ক্লেদ বিদেশি একজনের সামনে খোলাসা করতে কোথায় যেন বাধে। হোক তা নিজ স্ত্রী। দক্ষিন আমেরিকার দেশ পেরুর রাজনীতির চলার পথ কোন কালেই মসৃণ ছিলনা। ধর্মীয় উন্মাদনার মত সে দেশেও রাজত্ব করতো মাওবাদি সন্ত্রাস। সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র কায়েমের নামে আবেমেইল গুজমানের নেত্রীত্বে মাওবাদী গেরিলারা গোটা দেশকে জিম্মি রেখেছিল বছরের পর বছর ধরে। অবস্থা বদলে দেয় দেশটার গণতান্ত্রিক নির্বাচন। জাপানি ইমিগ্র্যান্টদের প্রতিনিধি আলবের্তো ফুজিমোরে ক্ষমতা হাতে নিয়েই মিশনে নামেন। এবং এ মিশন ছিল দেশকে সন্ত্রাস মুক্ত করা। এ কাজে অভাবনীয় সাফল্য পান তিনি। পেরুর দিগন্তরেখায় উদয় হয় নতুন সূর্যের। বদলে যায় মানুষে জীবন। পেরুভিয়ানরা ফুজিমোরেকে ঠাঁই দেন দেবতার আসনে। এবং সমস্যার শুরুটা এখানেই। ধীরে ধীরে দুর্নীতির কালো বিড়াল গ্রাস করে নেয় এই দেবতাকে। দেশটার গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান ভ্লাদিমেরো মন্তেসিনোসের সাথে মিলে শুরু করেন নজিরবিহীন লুটপাট। এক পর্যায়ে মন্তেসিনোস দেশ হতে পালাতে বাধ্য হন। পতন হয় ফুজিমোরে সরকারের। বর্ণিল কাহিনীর শেষে ফুজিমোরে পালিয়ে যান পিতার দেশ জাপানে। কিন্তু পেরুর নতুন সরকারের চাপে জাপান সরকারও বহিষ্কার করতে বাধ্য হন তাকে। চলে আসনে প্রতিবেশী দেশ চিলিতে। চিলি সরকার ফুজিমোরেকে গ্রেফতার করে তুলে দেন পেরুর আলেহান্দ্রো তলেদো সরকারের হাতে। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হন নতুন পেরুর রূপকার জনপ্রিয় এই প্রেসিডেন্ট। শেষ পর্যন্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত হয়ে জীবনের শেষদিন অতিবাহিত করছেন জেলের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। গিন্নীর একটাই কথা, তোমাদের দেশে এতই যদি চুরি, বিচার করছো না কেন চোরদের, যেমনটা পেরুর আদালত করেছিল আলবার্তো ফুজিমোরের বেলায়? তাকে কিছুতেই গেলানো যায়না বাংলাদেশের আইন-আদালত, বিচারক অথবা বিচার ব্যবস্থা সবই সরকার প্রধানের আজ্ঞাবহ দাস।
সঠিক সময়েই ফোনটা বেজে উঠলো যেন। ডালাস হতে রেজা ভাইয়ের ফোন। প্রায়ই করেন এবং দেশের ভাল মন্দ নিয়ে মত বিনিময় করেন। এ যাত্রায় অন্য কোন প্রসঙ্গে না গিয়ে সরাসরি জানতে চাইলেন খবরটা আমি জানি কি-না। না বললেও আন্দাজ করতে পারছিলাম কোন প্রসঙ্গ। মেজাজ বিগড়ে গেল বিষয়টা মনে হতে এবং একই সাথে মাথা হতে নেমে গেল ক্রিকেট ভূত। অনেক ভন্ডামি ইগনোর করা যায়, হিউম্যান এরোর হিসাবে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু এ ধরণের ভন্ডামি কুত্তার গলায় ঘন্টা ঝুলিয়ে শহর বন্দরে ঢোল পেটালেও যথেষ্ট হবে বলে মনে হয়না। ১১০ খুনের রক্তে রঞ্জিত যার হাত তার হাতেই তুলে দিয়েছে মানবাধিকার রক্ষার পুরস্কার। কাজটা করেছে দেশের এক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। তাও এমন এক সময় যখন সব গুলো লাশের সৎকার পর্যন্ত শেষ হয়নি। গুলি করে মানুষ মারার এ পৈশাচিক মহোৎসবে অনেকটা সাইড লাইনে বসে উপভোগ করেছে দেশের সংবাদ মাধ্যম। যে যতটা লাশ ফেলবে ততটাই নাকি তার বোনাস ও পদোন্নতির নিশ্চয়তা। এ ভাবেই প্রস্তুত করা হচ্ছে দলীয় পুলিশ, রেব, বিজিবি, এমনকি সেনা বাহিনী পর্যন্ত। দেখা মাত্র গুলি, অনেকে ঠাট্টা করে বলছে এ গোপালগঞ্জ সিনড্রোম। জনতার জঙ্গী মিছিল দমন করার একটাই নাকি রাস্তা বিশেষ এলাকার বিশেষ কিছু মানুষের জন্যে, পাখির মত গুলি করে মানুষ মারা। তাদের চোখে যারা মরছে তারা মানুষ না, জামাতী। হঠাৎ বোবা ও কালা বনে যাওয়া দেশের সংবাদ মাধ্যমও সূর মেলাচ্ছে সরকারের সাথে। যেন কিছুই হয়নি, জামাতিরা জঙ্গিপনা করছে, তাই পুলিশ তাদের বধ করেছে। রাস্তার হকার, ঘরের গৃহবধু, উৎসুক কিশোর, কেউ বাদ যায়নি এ তালিকা হতে। জাতি হিসাবে আমরা যদি পশুর কাতারে নাম লিখে না থাকি তাহলে জামাতী জঙ্গিপনার পাশাপাশি সরকারি পশুত্বের ও সমান সমালোচনা হওয়া উচিৎ ছিল। অথচ সমালোচনা দূরে থাক, বিকারগ্রস্ত মানবতার উলঙ্গ প্রদর্শনী হিসাবে খুনি মন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া হল মানবাধিকার রক্ষার পুরস্কার। এসব কি ৭১’এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি নয়?
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে না ফেরার শপথ নিয়েছে শাহবাগ চত্বরে অবস্থানরত সরকারের বর্ধিত মন্ত্রীসভা। এখানে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, দাবিটা কি? যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি? চলমান বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে যেখানে মন্তব্য পর্যন্ত বেআইনী সেখানে ঘেরাও, হুমকি দিয়ে রায় আদায় কোনভাবেই আইনী প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়েনা। পৃথিবীর কোন আইনেই তা বৈধতা পাবে না। এ ধরনের কর্মকাণ্ড আদালতের যে কোন রায়ের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে মাত্র। রায়ের আগে জনতার দাবি বিবেচনায় আনার প্রধানমন্ত্রীর আহবান আদালতকে অনেকটা হাসির পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। দাবি আদায় না করে ব্লগারদের ঘরে না ফেরার দাবি এখন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে না জিতিয়ে ঘরে ফেরার দাবিতে পরিনত হয়েছে। আমরা যারা স্বল্প শিক্ষিত তাদেরও এখন বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা। নির্বাচনে বিশেষ কোন দলকে সমর্থন ভোটারদের গণতান্ত্রিক আধিকার। এ অধিকার চর্চা শাহবাগ ব্লগারদের বেলায়ও প্রযোজ্য। তাই জাতিকে বিভ্রান্ত না করে ব্লগ এক্টিভিষ্টদের উচিৎ হবে শাহবাগ চত্ত্বরে নৌকা ঝুলিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করা। তাতে অন্তত নিজামী ও গো আজমদের মত কুখ্যাত খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া্র আইনী বৈধতা নিরাপদ থাকবে।