পরিচিত একজনের প্রসঙ্গ না টানলে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বন্ধু বললে বাড়িয়ে বলা হবে, একই ইউনিতে ডিগ্রী নেয়ার ধান্ধার সূত্রে পরিচয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করা ব্রিলিয়ান্ট একজন বাংলাদেশি। ছাত্র হিসাবে সাফল্য অনেকটা উপকথার মত। হঠাৎ করেই তিনি নিজেকে নাস্তিক ঘোষনা দিলেন। যে দেশের কথা বলছি সে দেশে নাস্তিকতা কোন ঘোষনার বিষয় ছিলনা, এ ছিল বাধ্যবাধকতা। এর অন্যথা ছিল রাষ্ট্রীয় অপরাধ। আমার মত উঠতি বাংলাদেশিদের অনেকেই তখন নিজেকে নাস্তিক পরিচয় দিতে গর্ববোধ করত। যার কথা বলছি তার সাথে পার্থক্যটা ছিল একটু এক্সট্রিম। দেশ ছাড়ার সময় মা-বাবা যত্ন করে হাতে একটা কোরান ধরিয়ে দিয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তার ব্লেসিংয়ের আশায়। এই কোরানের পাতা ছিড়ে হঠাৎ করে সে টয়লেট পেপার হিসাবে ব্যবহার শুরু করে দিল। এবং তা স্বগৌরবে প্রচার করে গেল। এভাবেই সে নিজেকে প্রচার করল, মার্কসিষ্ট। মার্কসিষ্ট হিসাবেই আরও ৫টা বছর কাটিয়ে দিলাম একসাথে। এরপর যে যার পথে হারিয়ে গেলাম ভাগ্যের সন্ধানে। তার সাথে আবারও দেখা হয়েছিল। শরীর হতে ততদিনে বিদায় নিয়েছে ছাত্রজীবনের তারুণ্য। ভদ্রলোককে আবিস্কার করলাম অন্য এক মানুষ হিসাবে। মুখে ইয়া লম্বা দাড়ি, কপালে গভীর গোল দাগ আর পরনে গোড়ালি পর্যন্ত উঠানো পাজামা, সাথে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। অন্য কোন কথাই বললেন না এক ধর্মীয় কথাবার্তা ছাড়া। আরও অনেক পরে জেনেছিলাম পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট। কোলকাতার এক হিন্দু মেয়েকে ভালবাসতেন অন্ধের মত। তাকে স্থায়ী করা যায়নি হরেক কারণে। এক কালের বিখ্যাত ছাত্র দেশে ফিরেও তেমন কিছু করতে পারেননি। ব্যর্থতা আর হতাশার ঘোর অমানিশায় আশার আলো খুজে পান ধর্মেকর্মে।
সমসাময়িক ব্লগারদের অনেকেই বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ঘোর সমর্থক, ঘটা করে প্রচার না করলেও তা বুঝতে অসুবিধা হয়না। ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বর্ণযুগে এ ধরণের পছন্দ মানুষের মৌলিক অধিকার, এর উপর তর্ক বিতর্কের সুযোগ কম। কথার শুরু ধর্মীয় গ্রন্থ কোরান নিয়ে। কোন এক ব্লগে একজন প্রশ্ন তুলেছেন কোরান কি আসলেই নাজিল হওয়া কোন ধর্মগ্রন্থ না নিজের সৃষ্টি উপকাহিনী? কথা গড়িঁয়েছে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মোহম্মদের ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে। উনাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে একজন র্যাপিষ্ট, বহুগামী ও পেডাফেলিয়া হিসাবে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সন্মান করলে এ ধরণের অভিযোগ আর সন্দেহ নিয়ে তেনা পেচানোর সুযোগ নেই। আজ হতে হাজার বছর আগে আরব সমাজে নাবালিকা বিয়ে সহ বহু বিবাহের কতটা সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা অথবা অপরাধ ছিল তার বিচারের মালিক তৎকালিন আরব সমাজ আর তার বাসিন্দারা, আমরা নই। স্কুলের দোড়গোড়ায় পা রেখে আমরা জেনেছি তৎকালীন আরবরা মেয়ে মানুষ জন্ম নিলে জীবন্ত কবর দিত। এমন একটা সমাজে একজন মোহম্মদের বহুগামীতা বা ৯ বছরের শিশু বিবাহ একবিংশ শতাব্দীর দৃষ্টিতে বিচার করলে তা হবে ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়ার শামিল। ইসলাম ধর্মের প্রচারণার শুরুটা ছিল অনেকটা আরবদের গোত্রীয় লড়াই। এক গোত্র আরেক গোত্রকে পরাজিত করে নিজদের ঐতিহ্য মোতাবেক ভাগাভাগি করে নিচ্ছিল যুদ্ধ জয়ের ফসল। এ নিয়ে আমরা যারা নন-আরব বিতর্ক করতে পারি। কিন্তু একটা কথা তো সত্য, মোহম্মদ উনার সাহাবীদের নিয়ে ইসলাম প্রচারে আমাদের মাটিতে যুদ্ধ করতে আসেন নি। কথিত রেপিষ্ট, বহুগামী আর পেডাফেলিয়ার গোত্রীয় লড়াইকে কেন পৃথিবীর বিলিয়ন মানুষ নিজেদের লড়াই হিসাবে নিয়েছে তার জন্যে কি মোহম্মদকে দায়ি করা উচিৎ হবে? আসামীর কাঠগড়ায় আন্য কাউকে দাঁড় করানোর আগে নিজের মা-বাবাকে কেন দাঁড় করানোর চেষ্টা করিনা? তারাই তো একজন ’রেপিষ্টের’ ধারক বাহক হিসাবে আমাদের উপহার দিয়েছে্ন ইসলাম ধর্ম। না-কি তারা সময়ের ভিকটিম? বাস্তবতার শিকার? একই বিচারে গোটা মানব সভ্যতাকে সময়ের ভিক্টিম হিসাবে আখ্যায়িত করলে খুব কি বাড়িয়ে বলা হবে?
৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে জন্ম নিয়ে মোহম্মদ কেন সমাজতন্ত্রের কথা বললে নি এ জন্যে কি উনাকে দায়ি করছি? সৌরজগতের বাইরে কোন এক অচেনা কক্ষপথে সৃষ্টিকর্তা নামের কেউ একজন বাস করেন এমনটা বিশ্বাস না করলেই কি ইসা, মুসা আর মোহম্মদদের রেপিষ্ট বানাতে হবে? সমাজতন্ত্রের জন্মদাতা মার্কস, এঙ্গেলস আর ভ্লাদিমির উলিয়ানভের চরিত্র নিয়ে কি হাজারো কাহিনী বাজারে চালু নেই? কাহিনীর সবটাই কি মিথ্যা? মানব সভ্যতা বিকাশে এসব মুনি ঋষিদের অবদানকে কি আমরা তাহলে কার্ল মার্ক্সের পতিতা ভোগের কাহিনী দিয়ে ম্লান করে দেব? তাত্ত্বিক চরিত্র বিশ্লেষণ করলে সব ধর্মই পার্ফেক্ট, যেমনটা পার্ফেক্ট দান্ধিক বস্তুবাদ, সম্পদের সুসম বন্টন আর শ্রমের সাথে শ্রমজীবির সম্পর্কের তত্ত্ব সমৃদ্ধ সমাজতন্ত্র। কাগজের ইসলাম আর বাস্তবতার ইসলামের সাথে আজকে যোজন যোজন পার্থক্য। শ্রেণীহীন সমাজের প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক সমাজের পরতে পরতে কতটা অন্যায়, অনাচার আর অবিচার তা উপলদ্ধি করতে আপনাদের হয়ত ১২ বছর বাস করতে করতে হবে এমন একটা সমাজে, যেমনটা করেছি আমি। কোন সমাজই পার্ফেক্ট সমাজ নয়, কোন তত্ত্বই পার্ফেক্ট তত্ত্ব নয়। সময়ের চাহিদা মেটাতে সমাজে ধর্ম ও তত্ত্বের উদ্ভব হয়, আবার একই সময়ের কারণে এগুলো ইতিহাসে ঠাঁই নেয়।
সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে ধর্মের চাহিদা ও এর অবস্থান নির্ধারণ করতে আমাদের ফিরে যেতে হবে সমাজের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে। দারিদ্র, অবিচার, অনাচার, শোষণ আর বঞ্চনার জরায়ুতেই বেচে থাকে আজকের ধর্ম। মানুষ হিসাবে আমরা যতদিন একটা পার্ফেক্ট সমাজ উপহার দিতে না পারছি ততদিন চলতে থাকবে ধর্মের রাজত্ব। মোহম্মদ নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে এর প্রভাব যে কমানো যাবেনা এর প্রমান আজকের বিশ্বাসী বিলিয়ন মুসলমান। গণতন্ত্রের নামে, সমাজতন্ত্রের নামে, মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে মানুষকে বঞ্চিত করার ধারা যতদিন অব্যাহত থাকবে ততদিন অব্যাহত থাকবে মানুষের ধর্মপ্রীতি। এ নিয়ে সস্তা মন্তব্য মানুষ হিসাবে আমাদের দেউলিয়াত্বই প্রমান করবে কেবল।