২০০২ সালের ঘটনা। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের মডেস্টো শহরের নিজ বাড়ি হতে নিঁখোজ হন সুন্দরী ল্যাসি পিটারসন। আট মাসের অন্তসত্ত্বা ল্যাসিকে শেষ কবে ও কোথায় দেখা গেছে কেউ বলতে পারেনি। ক্রিসমাসের আগে এমন একটা খবর খুব সহজ ভাবে নেয়নি ল্যাসির মা বাবা। পুলিশের সন্দেহের তালিকায় তাৎক্ষনিক ভাবে স্বামী স্কট পিটারসনের নাম আসেনি বিভিন্ন কারণে। প্রথমত, খোদ ল্যাসির পরিবার সাফাই গেয়েছিল তার পক্ষে। দ্বিতীয়ত, মাতৃগর্ভের আট মাসের সন্তান কোণর সহ সুন্দরী স্ত্রীকে গুম অথবা হত্যা করার মত চরিত্র মনে হয়নি স্কটকে। ল্যাসি পরিবার না চাইলেও পুলিশ লেগে থাকলো তার পেছনে। এবং উদঘাটন করলো আসল চরিত্র। ফোনে আড়ি পেতে জানতে পারলো বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরেও তার একাধিক সম্পর্ক ছিল। সানফ্রানসিসকো বে’তে ল্যাসির লাশ পাওয়া গেল ২০ দিন পর। চেনার মত চেহারা ছিলনা। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে মৃত কোণরকেও সনাক্ত করা হল। রাগে ক্ষোভে ফেটে পরলো গোটা দেশ। গ্রেফতার করা হল স্কট পিটারসনকে। মডেস্টো শহরে প্লাবন নামলো মিডিয়া কভারেজের। স্থানীয় জনগণ পারলে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় ল্যাসি ও তার আন-বর্ণ শিশু কোণরের ঘাতক স্কট পিটারসনকে। আমেরিকার অন্যতম বিখ্যাত ডিফেন্স এটর্নি মার্ক গারোগাসকে নিয়োগ করে স্কট। এবং শুরু হয় শতাব্দীর অন্যতম হাই প্রোফাইল ট্রায়াল। মামলার শুরুতে মার্ক গারোগাস আদালত ও জুরিদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। স্থানীয় মিডিয়া ও জনগণের হিংসাত্মক মনোভাব জুরিদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে এমন একটা কারণ দেখিয়ে ডিফেন্স টিম শহরের বাইরে নতুন কোন আদালতে কেস ট্রান্সফার করার অনুরোধ করেন। আদালত বিবেচনায় নেয় আসামী পক্ষের আবেদন। স্থানীয় মিডিয়ার বিরামহীন প্রচারণা ও জনগণের হোষ্টায়লিটি একপেশে করে তুলবে স্কট পিটারসনের রায়, এমন একটা সম্ভবনার কথা বিবেচনা করে আদলত বিচার কর্ম রেডউড সিটিতে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন। এবং সেখানেই সম্পন্ন হয় বিচার কাজ।
অনেকে বলবেন এ তো আমেরিকা, গণতন্ত্রের সূতিকাগার। তাই বলে আমাদেরকেও কি এত সব বিবেচনায় আনতে হবে, বিশেষ করে গণহত্যার দায়ে বিচারাধীন আসামীদের বেলায়? ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে আমাদের আবেগ এখন তুঙ্গে। অনেকে বলছেন এ আবেগ নয়, গণজাগরণ, দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীর বিভিন্ন কোনায় বাসরত বাংলাদেশিরাও নেমে এসেছে রাস্তায়। নিউ ইয়র্ক, টরেন্টোর মত শহরে তুষারপাত উপেক্ষা করে অনেকে হাজির হয়েছে সমর্থন জানাতে। পৃথিবীর সবকটা মহাদেশ ধ্বনিত হয়েছে বাংলাদেশিদের কণ্ঠ, বেরিয়ে এসেছে ৪২ বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ। এখানে হিউম্যান ফ্যাক্টর ও বিচার প্রক্রিয়া একে অপরের সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং পরিপূরক হয়ে সভ্যতার বিকাশকে উর্ধ্বে তুলে ধরেছে। কিন্তু একই জনসমর্থন যখন আদালতের রায় ডিকটেক্ট করার কাজে ব্ল্যাকমেইল হিসাবে ব্যবহূত হয় আইনী প্রক্রিয়ার সাথে সংঘর্ষ দেখা দিতে বাধ্য। অন্তত সভ্য সমাজে তাই হওয়া উচিৎ। এখানে প্রশ্ন উঠবে, জনদাবি ও আবেগের স্থান তাহলে কোথায়? অপরাধ যখন বিচার প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ধাপে পা দেয় আবেগ ঠিক সেখানেই বিদায় নেয়। অপরাধ ও শাস্তি পর্বের বাকি কাজ সমাধা করার দায়িত্ব চলে যায় কোর্টের দুয়ারে। এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য রাষ্ট্রকে বছরের পর বছর ধরে লালন করতে হয় বিচারক ও প্রসিকিউশন নামের বিশাল এক কাফেলা। অবশ্য ক্যাঙ্গারু কোর্টের ব্যাপার গুলো আলাদা। কাদের মোল্লাকে যে কোর্ট যাবজ্জীবন দিয়েছিল সে কোর্ট কি তাহলে ক্যাঙ্গারু কোর্ট ছিল? যে ভাষায় কোর্টের রায়কে প্রত্যাখান করা হচ্ছে তা বিবেচনায় আনলে এমনটা মনে হতে বাধ্য। সবচাইতে আশ্চর্যজনক ঘটনা হচ্ছে যে কোর্ট এবং বিচারক এ রায় দিল তাদের নিয়ে টু শব্দটি নেই। একদল বন্দী আসামী ও তাদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া নিজেদের পক্ষে নেয়ার জন্য দেশে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, যুদ্ধ নিয়ে এর চাইতে বড় তামাশা ইতিপূর্বে কেউ কোনদিন করেছে বলে মনে হয়না।
গাড়িতে মন্ত্রিত্বের নিশান উড়িয়ে মাওলানা নিজামী গোপনে চলাফেরা করেন নি, বরং বুক ফুলিয়ে বছরের পর বছর ধরে শহর বন্দর ঘুরে বেরিয়েছেন। আজকে যারা চেতনার ভারে নুয়ে পরছেন প্রায় তারা সেদিন কোথায় ছিলেন? শাহবাগ দূরে থাক, গাবতলির গরুর হাটেও দশটা লোক এক হয়ে নিজামির গাড়ি আটকানোর সাহস দেখাননি কেন? বাংলায় একটা কথা আছে, সুযোগে ব্যাঙও ঠ্যাং মেলে। সরকারের হাতে বন্দী ও চলমান বিচার প্রক্রিয়ার একদল আসামীর ফাঁসির দাবিতে এখন ঠ্যাং মেলছেন এবং দাবি করছেন মুক্তিযুদ্ধের। এ শ্রেফ নির্লজ্জ কাপুরুষতা। সরকারের তিন ধাপ নিরাপত্তা সেবায় অবস্থান করে, তাদেরই অর্থায়নে গণজাগরণ নাটক মঞ্চায়ন করার অনেক মূল্য দিয়েছে জাতি, এবার থামার পালা। আদালতের কার্যক্রমকে যারা দলীয় কার্যক্রমের অংশ হিসাবে মনে করেন তাদের উচিৎ হবে আর্ন্তজাতিক আদালতের দরজা ঘেরাও করে বিচারকদের হুমকি দেয়া। তাতেও কাঙ্খিত রায় পাওয়া না গেলে উচিৎ হবে সরকারের সিংহাসন ধরে টান দেয়া। কথায় বলে দাঁতের সাথে আঁতের সম্পর্ক, বাংলাদেশের বেলায় আদলত ও সরকারের সম্পর্ক অনেকটা একই রকম।
’৭১ এর খুনিদের বিচার চলছে। যদিও আদালতের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে (একটা রায়ের লাইজ্ঞা হেরা পাগল হইয়া গেছে দ্রষ্টব্য) তারপরও এ অধ্যায়ের সমাপ্তি প্রয়োজন। ৪২ বছর ধরে জাতির নাকে যুদ্ধাপরাধী মূলা ঝুলিয়ে অনেকে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছেন। এ কলঙ্কিত চ্যাপ্টারের ইতি টানা একান্তই জরুরি। তবে যুদ্ধাপরাধী বিচারের পাশাপাশি যদি গণ্ডায় গণ্ডায় রাজনৈতিক ইস্যু সামনে আনা হয় ধরে নেব মূলার গন্ধ আরও দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে।