জনৈক হরমুজ ভাইয়ের গল্প

Submitted by WatchDog on Friday, March 22, 2013

 Bangladeshi

হরমুজ ভাইয়ের ফোনটা অপ্রত্যাশিত ছিলনা। শাহবাগ গণজাগরণের উপর প্রথম লেখাটা দেয়ার পরই মনে হয়েছিল তিনি করবেন। না করলে বরং অবাক হতাম। কিন্তু এমন অসময়ে করবেন ভাবতে পারিনি। ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলার কিছু আন-অফিসিয়াল সময় আছে এ দেশে, যেমন উইক এন্ড অথবা আফটার ডিনার। তবে নিউ ইয়র্ক শহরের বাংলাদেশিদের বেলায় এ ধরণের নিয়ম কানুন প্রযোজ্য কিনা সন্দেহ আছে। থাকলে হরমুজ ভাই নিশ্চয় এমন অসময়ে ফোন করতেন না। তিন ঘন্টার টানা কনফারেন্স কলের দু ঘন্টা কাটতে রাজ্যের ঘুম নেমে এল চোখে। কর্পোরেট প্যাঁচাল শুনতে শুনতে এমনিতেই ছিলাম ক্লান্ত। গেল কোয়ার্টারে কোম্পানী আশানুরূপ লাভ করতে পারেনি, তাই ওয়ালস্ট্রিটে বিরামহীন রক্তক্ষরণ চলছে। এ নিয়ে মিটিং সেমিনারের শেষ নেই। স্টক হোল্ডারদের আশ্বস্ত করা না গেলে ধ্বস নামতে পারে বাজারে, আশংকাটা ঝেঁকে বসেছে ম্যানেজমেন্টের সব লেভেলে। এ ধরণের চাপ যদি প্যাসকালে মাপা যেতো অনেক আগেই ডেঞ্জার লেভেল অতিক্রম করার বিপদ সংকেত বেজে উঠতো। এমন একটা অস্বাস্থ্যকর সময়ে ঝন ঝন করে বেজে উঠলো ফোনটা। কলার আইডিতে হরমুজ ভাইয়ের নাম দেখে দ্বিধায় পরে গেলাম। জরুরি না হলে ভর দুপুরে ফোন করতেন না, ভাবনাটা মাথায় ঢুকতে রিসিভ করতে বাধ্য হলাম। কিন্তু হরমুজ ভাইয়ের গলার আওয়াজে জরুরি কিছুর আভাস না পেয়ে দমে গেলাম।

প্রবাসী বাংলাদেশি হরমুজ আলি ব্যাপারির সাথে পরিচয় পর্বের সূত্রপাতটা কি চাইলেও এখন মনে করতে পারবো না। প্রিয় ডটকম তখন ই-মেলা নামে পরিচিত। বাংলা ব্লগের শুরুটা বোধহয় ই-মেলা দিয়েই। অনেকে তর্ক করতে পারেন, তবে দাবি করলে দ্বিতীয় কোন ব্লগের নাম সামনে আনতে পারবেন বলে মনে হয়না। খালেদা জিয়া গংদের তখন সোনালী সময়। চারদিকে লুটপাটের ভরা বসন্ত। আমার কলমে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল আলীবাবা চল্লিশ চোর হিসাবে। নিয়মিত লিখতাম চোরদের নিয়ে। অনেক সময় শালীনতা অতিক্রম করে যেত। লেখার মুণ্ডুপাত করা পাঠকের সংখ্যাই ছিল বেশি। হঠাৎ একদিন হরমুজ ভাইয়ের ফোন পেলাম। নাম্বার কিভাবে যোগাড় করলেন জিজ্ঞেস করতে এড়িয়ে গেলেন। আশাতীত তৈলমর্দন করলেন এবং জানালেন আমার লেখার একান্ত ভক্ত তিনি। খাম্বা মামুন অধ্যায়ের উপর একটা লেখার প্রতিটা লাইন মুখস্ত বলে আমাকে হতবাক করেছিলেন। আমি শুধু অবাক হ্তাম কর্মক্ষম একজন মানুষ এতটা সময় পায় কোথায়, বিশেষ করে প্রবাসে? এভাবেই শুরু। আমি লিখি আর তিনি প্রশংসা করেন। নিজের অজান্তে কখন এই তৈলসমুদ্রে সাতার কাটতে শুরু করেছি বুঝতে পারিনি। তবে বুঝিয়ে দিলেন হরমুজ ভাই নিজেই।

আউলা ঝাউলা তত্ত্বাবধায়কের আমল তখন। নেত্রীদের পেটিকোটে টান পরেছে কেবল। একটার পর একটা লোমহর্ষক অধ্যায় বের হচ্ছে লুটপাটতন্ত্রের সাম্রাজ্য হতে। পারিবারিক জমিদারিতে বর্গীদের পায়ের আওয়াজ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত বদলে দিল রাজনৈতিক পরিবেশ। চেকের মাধ্যমে শেখ হাসিনার চাঁদাবাজির উপর লেখাটা পড়ে তৈল মর্দনে ব্রেক কষলেন হরমুজ ভাই। ফোন করে নিজের ক্ষোভ লুকানোর চেষ্টা করলেন না। আমি কেবল মানুষের মত প্রকাশের মৌলিক অধিকারকে সন্মান জানানোর দাবি করলাম। হাল্কা হুমকি দিয়ে মনে করিয়ে দিলেন লগি-বৈঠার শক্তি। নিজেই একদিন ফোন করলাম এবং কথার পিঠে কথা গেথে মিছরির ছুরির মত নিজের ক্ষোভ গুলো হরমুজ ভাইয়ের বুকে ঢুকিয়ে দিলাম। খুব হাল্কা সুরে আমিও মনে করিয়ে দিলাম দুই পরিবারের জমিদারিতে প্রজা হতে বাংলাদেশে জন্ম নেইনি। পাকিস্তানি ২২ পরিবারের খপ্পর হতে বেরিয়ে দেশীয় দুই পরিবারের খপ্পরে ধরা দেয়ার জন্যও দেশ স্বাধীন হয়নি। নেত্রী পূজার নিবেদিত পুজারী হরমুজ ভাই থমকে গেলেন এসব অপরিচিত কথা শুনে। সেই হতে দূরত্বটা বাড়তে থাকলো।

- হরমুজ ভাই যে, তা আছেন কেমন?
- ভাল আর রাখলেন কই?
- কেন, কি হল আবার?
- বিদেশে ছাগুর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে ভাল থাকি কি করে?
- তা সব ছাগুদেরই কি আপনাকে কাঁঠাল পাতা খাওয়াতে হয় নাকি?
- ভাওতাবাজি ছাড়েন, কত পেয়েছেন বলেন।
- খোলাসা করেন।
- নগদ না পেলে এভাবে কেউ রাতারাতি বদলে যায়?
হরমুজ বেপারীর কণ্ঠ রাগ, ক্ষোভ ও হতাশা ছাড়িয়ে হুমকির দিকে মোড় নিল। পালটা রাগ না করে বরং উপভোগ করার চেষ্টা করলাম আমি। ঈশ্বরকে নিয়ে পূজারিদের এসব ত্রিপিটক পাঠ নতুন ছিলনা আমার জন্য।
- তা আপনার অসুবিধাটা কোথায়? আমার লেখা ভাল না লাগলে পড়েন কেন? গাফফার চৌধুরিরাই তো আছেন মনোরঞ্জনের জন্য।
- আপনি কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান না? ফাঁসি চান না? পারলে সোজা বাংলায় উত্তর দেন।
- ভাই, আপনি কিন্তু দুটা চাওয়া নিয়ে ঘোল পাকিয়ে ফেলছেন।
- যেমন?
- দুটার যে কোন একটা চাইতে হবে আপনাকে। হয় যুদ্ধাপরাধীর বিচার, অথবা ফাঁসি।
- ইংরেজি মারাইয়েন না, বাংলা কন।
- শানে নজুল হচ্ছে, আপনি যখন বিচার চাইবেন শাস্তির দায়িত্বটা দিতে হবে আদালতকে। বিচার চাইবেন সাথে রায়ও দেবেন, আর যাই হোক এর নাম বিচার হতে পারেনা। অন্যদিকে ফাঁসিই যদি আপনার একমাত্র দাবি হয়, তাহলে সরকারের কাছে ক্রসফায়ারের দাবি তোলেন। সরকার প্রতিদিনই খুন করছে। নিজামী মুজাহিদদের খুন ঈশ্বরের আরশ নতুন করে কাঁপিয়ে দেবে না। খুন শেখ হাসিনার জন্য ডাল-ভাত। তাই খেলারামজীর এ খেলা চালিয়ে যেতে বলুন।

এবার দুর্দান্ত হয়ে উঠলেন হরমুজ বেপারী। দেশপ্রেমের বন্যায় ভাসিয়ে দিলেন গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, ৩ লাখ বীরাঙ্গনার ইজ্জত, পাকিস্তান ও ছাগুকাব্য নিয়ে আউড়ে গেলেন গতবাঁধা বুলি। হরমুজ বেপারীদের মুখে এসব দেশপ্রেম সঙ্গীত শুনলে কেন জানি মাথায় রক্ত উঠে যায়। থুথু মারতে ইচ্ছে করে। এই আদমের আদ্যোপান্ত আমার জানা। এক কথায়, বিদেশে দুই নাম্বার বাংলাদেশি। দেশেও ঝুলছে খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও ডাকাতি সহ গোটা পঞ্চাশেক মামলা। চুক্তিভিত্তিক বৈবাহ করে বৈধ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। কাজ হয়নি। ক্রেডিট ফ্রড ও জালিয়াতির মাধ্যমে বাড়ি ঘর বিক্রির মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন ব্রুকলেন কোর্টে।

ডেস্কে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে আসছিল। বিদায় দিতে হবে হরমুজ ভাইকে। কিছুটা ছুড়ি না ঢুকিয়ে এই আদমকে বিদায় জানালে মনটা খুঁত খুঁত করবে, তাই আলাপের শেষটা অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক দিকে টেনে নিলাম।

- হরমুজ ভাই, চিন্তা কইরেন না, যেনতেন ভাবে হলেও শেখ হাসিনা নির্বাচনে জিতবেন। না জিতলে খবর আছে। একটা না, গোটা দশেক আজরাইল মউতি পরোয়ানা নিয়ে আশেপাশে ঘুরঘুর করবে। যেমন ধরেন বিডিআর হত্যাকাণ্ডের জন্য সেনাবাহিনী, নেতাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য আসামের উলফা, ইসলামী জঙ্গি বাহিনী এবং সবার আগে পুত্রদ্বয়কে দেশছাড়া, চল্লিশ বছরের স্মৃতিবিজরিত বাড়ি হতে উচ্ছেদ সহ হাজারটা প্রতিশোধের খোলা তরবারি হাতে বেগম খালেদা জিয়া।

দমে গেলেন হরমুজ বেপারী। কথা দিলেন আমার লেখা না পড়ার। এবং দাওয়াত দিলেন শাহবাগ গণজোয়ারে কিভাবে দেশের তাবৎ অন্যায় ভেসে যায় তা দেখার জন্য। ইচ্ছা থাকলেও বলতে পারলাম না, হে আমার হরমুজ ভাই, এমন একটা গণজোয়ারের অপেক্ষায় আমিও আছি। তবে সে জোয়ার একদল চোর ও খুনিদের পুনর্নির্বাচন নিশ্চিত করার জোয়ার নয়। এ জোয়ার ৪২ বছরের আবর্জনা ভাসিয়ে নেয়ার জোয়ার।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন