নেলসন ম্যান্ডেলাকে আমি কোনদিন দেখিনি। দেখার সম্ভাবনাও নেই। একসময় স্বপ্ন দেখতাম জীবনযুদ্ধে সাময়িক বিরতি টেনে সহসাই চলে গেছি দক্ষিন আফ্রিকায়। কথা বলছি অবিসংবাদিত এই নেতার সাথে। অনেক কিছু জানার ছিল মানুষটার কাছে। প্রশ্ন গুলো বহুবার বহু ভাবে সাজিয়েছি। নিজেকেও মানসিক ভাবে তৈরী করেছি এমন একজন প্রবাদ পুরুষকে সামনে পেয়ে প্রশ্ন করার। কিন্তু হায়, দিন গড়িয়ে রাত নামে, মাস ঘুরে যায় বছরের আবর্তে, আফ্রিকায় আর যাওয়া হয়না। তেল আবিব হয়ে যে বছর পশ্চিম তীরের শহর রামাল্লায় যাওয়ার টিকেট কাটলাম ঠিক দুমাস আগে ইসরাইলের বন্দর নগরী হাইফা কেঁপে উঠে প্যালেস্টাইনি তরুণদের আত্মঘাতী হামলায়। রাতারাতি দখলদার বাহিনীর ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ঘেরাও করে ফেলে পিএলও তথা নেতা ইয়াসির আরাফাতের সদর দফতর। শুরু হয় অল-আউট বর্বরতা। সে বছর কেন, আর কোনোদিনই যাওয়া হয়নি স্বপ্নের প্যালেস্টাইনে। কারণ যাকে দেখতে যাওয়ার উপলক্ষ সে তিনিই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ইয়াসির আরাফাতকে অবশ্য ঢাকায় একবার দেখেছি। তাও রাস্তায়। কিন্তু সামনে বসে প্রশ্ন করার ইচ্ছাটা কে জানি কোনদিন দমাতে পারিনি। ২৭ বছর জেলের অন্ধ প্রকোষ্ঠে আটকে রেখে যে বর্ণবাদ তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল ঠিক তাদের সাথে আপোস করার তাগাদাটা কোত্থেকে এল, ম্যান্ডেলার কাছে এই একটা প্রশ্নের উত্তরের সময়ই আমার জন্য যথেষ্ট হত। উত্তরে কি বলতেন তিনি, ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে দেশের স্বার্থ? বঞ্চিত, নিপীড়িত আর লাঞ্চিত আফ্রিকানদের নতুন করে স্বপ্ন দেখানোর প্রয়োজনীয়তা? প্রচার বিমুখ এই নেতা আমার মত কাউকে সামনে পেয়ে চেতনার রেকর্ড বাজাতে শুরু করবেন এমনটা অকল্পনীয়। হয়ত স্মিত হাসি দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করতেন, তা কোন দেশ হতে এসেছো তুমি? কারণ, তিনি আর কেউ নন, খোদ নেলসন ম্যান্ডেলা। জেল হতে বেরিয়ে প্রথম যে কাজটি করলেন তা হল এতদিনের সুখে দুখের সাথী স্ত্রী উইনিকে তালাক দেয়া। অভিযোগ ছিল ম্যান্ডেলার অনুপস্থিতিতে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেত্রী বনে উইনি এমন কিছু কাজ করেছিলেন যা স্বামী হিসাবে ম্যান্ডেলার নেত্রীত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারতো। তিনি তা হতে দেননি। কেবল তালাক দিয়েই ক্ষান্ত হননি, সদ্য তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে তুলে দিয়েছিলেন আইনের হাতে।
নেলসন ম্যান্ডেলা আবারও হাসপাতালে। ফুসফুসে ইনফেকশন নিয়ে এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় বারের মত চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন দক্ষিন আফ্রিকার এই অবিসংবাদিত নেতা। দেখতে দেখতে জীবন হতে ৯৪টা বছর পার করে দিলেন। তা হলে মৃত্যু কি বার্ধক্যের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে? প্রতিবার তিনি যখন হাসপাতালে যান এমন একটা অশুভ আশংকা কেন জানি মগজে উঁকিঝুকি মারে। সদ্য প্রায়ত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের বেলাও এমনটা ঘটেছিল। শেষবার তিনি যখন সিঙ্গাপুর যান কেন জানি মনে হয়েছিল এটাই শেষ যাওয়া। ম্যান্ডেলার বেলায়ও কি তাই ঘটতে যাচ্ছে? এমন অলুক্ষুণে সম্ভাবনার জন্য অনেকে নিশ্চয় তিরস্কার করবেন। যদিও এই বিশ্ববরেণ্য মানুষটার স্বাস্থ্য নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ আশংকা প্রকাশ করেনি, তবু আমি চিন্তিত। কাউকে আজীবন বাচিয়ে রাখার পছন্দ যদি সৃষ্টিকর্তা আমার উপর ছেড়া দিতেন আমি বিনা দ্বিধায়, এক বাক্যে যার নাম উচ্চারণ করতাম তিনি হতেন কিংবদন্তী নেলসন ম্যান্ডেলা। বিশেষ করে আমাদের চোর রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক যোগ্যতাকে আঙ্গুল উচিয়ে দেখানোর জন্য ম্যান্ডেলার বেঁচে থাকাটা খুবই জরুরি।
সুপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ম্যান্ডেলা, আপনি বেঁচে থাকুন। শত নয়, বরং হাজার বছর।