আওয়ামী লীগের নৌকা কি তাহলে ডুবতে শুরু করেছে? অনেকে বলবেন এ ফয়সালা তো হবে সামনের নির্বাচনে! তথাস্তু! সময় আমাদের সবার বন্ধু। এর উপর ভর করলে ৮০ দিনেই নাকি গোটা দুনিয়া ঘুরে আসা যায়! নির্বাচন তো মাত্র কয়েক মাসের ব্যাপার, আমরা ম্যাঙ্গোরা না হয় সে সময়টার জন্য অপেক্ষা করবো। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনী লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরীর যে রোডম্যাপ আমরা দেখা পাচ্ছি তাতে ডুবা দূরে থাক, এ যাত্রায় পাহাড় বাইয়্যা যাওয়ার কথা আওয়ামী নৌকা। জামাত- বিএনপি জোটের ছোট বড় প্রায় দুই লাখ নেতা মামলার কারণে এখন ঘর ছাড়া। গ্রেফতার এড়াতে দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বানের স্রোতের মত। খালেদা জিয়া ছাড়া কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সবাই এখন জেল হাজতের সরকারী মেহমান। রিমান্ডে নিয়ে বিভিন্ন থেরাপির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত তরুন নেতাদের শারীরিকভাবে পঙ্গু বানানোর ’ঐতিহাসিক’ সিদ্ধান্তও নাকি মঞ্জুর করেছেন দলের ওয়ান ওম্যান শো হাই-কমান্ড। তাতেই নাকি প্লেয়িং ফিল্ড মনের মাধুরি মিশিয়ে লেভেল করা যাবে, যেমনটা করা হয় ২২ গজের ক্রিকেট পীচ কে। পরিকল্পনাটা নাকি এরকমই ছিল; প্রতিপক্ষের সবাইকে ডান্ডাবেড়ির ফাঁদে আটকে, এরশাদ ও ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাকে বিরোধী দলের জুতা পরিয়ে সাজানো হবে ক্ষমতার পরবর্তী সিংহাসন। খালেদা জিয়াকেও আনা হবে এর আওতায়। তবে তা হবে নির্বাচনের পালে যেদিন হাওয়া লাগবে ঠিক তার আগের মুহূর্তে। এতিম তহবিল নয় ছয় করার মামলায় ৭ বছরের জেল সহ লালকার্ড দেখিয়ে বিদায় করা হবে নির্বাচনে মাঠ হতে। পরের ইতিহাস হবে ৭৪-৭৫’এর মত। এ যাত্রায় শতকরা ৯০ ভাগ ভোট দেখিয়ে মসনদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে মাঠের একমাত্র খেলোয়াড় আওয়ামী লীগ তথা শেখ পরিবারকে। এখানেই শেষ নয়, ক্ষমতার দিগন্ত রেখায় মহা মুক্তির ডিজিটাল মন্ত্র নিয়ে যে অশ্বারোহী হাজির হবেন তিনি আর কেউ নন, খোদ জয় ওয়াজেদ। দলীয় প্রধান হয়ে নৌকার হাল ধরার কথা ডাচেস অব গোপালগঞ্জ জনাবা শেখ রেহানার। প্রশ্ন উঠবে, তাহলে রাজমাতার কি হবে? বনবাসে যাবেন? মোটেও না। বয়স হয়েছে, তাই অবসরে যাওয়ার মহাপরিকল্পনা করছেন তিনি। হাতে তসবি, মাথায় হিজাব নিয়ে বাকি জীবনটা নাকি ধর্ম-কর্মের পাশাপাশি নায়-নাতিদের সাথে কাটিয়ে দেয়ার খায়েশ প্রকাশ করেছেন। ইট-সুরকি ও বিটুমিন ইমালশান দিয়ে প্রায় পাকা করে ফেলেছিলেন ক্ষমতার রাজপথ। সাথে শাহবাগী কাফেলা যোগ হয় অনেকটা বোনাসের মত। আর তাতেই নেত্রী ধরে নিয়েছিলেন শুধু বাংলাদেশ কেন, চাইলে ভুবনেশ্বরের অধিপতি হতে পারেন তিনি।
সবকিছু যখন স্বপ্নের মত এগোচ্ছিল অনেকটা জীবাণু হয়ে মাঠে আবির্ভুত হন আমারদেশ পত্রিকার সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমান। থাবা বাবা ও আসিফ মহিউদ্দিনদের নাস্তিকতার অবাধ রাজত্বকে অনেকটা ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের কায়দায় আবিস্কার করে তুলে ধরেন জাতির সামনে এবং সামগ্রিক দায় দায়িত্ব চাপিয়ে গোটা ভার্চুয়াল দুনিয়ার উপর। ১.২ বিলিয়ন বিশ্বাসীদের নবী মোহাম্মদকে মোহাম্মক (মোহাম্মদ + আহাম্মক) ও শিশু ধর্ষক বানিয়ে ঠাট্টা তামাসার সাথে প্রতিটা মসজিদকে টয়লেট বানানোর দাবি হতবাক করে দেয় কোটি কোটি বিশ্বাসীর অন্তর। ব্লগার ও বামপন্থী তরুণদের উল্লাসে মুখরিত শাহবাগ চত্বর ও রাজপথে সহসাই নেমে আসে একাকিত্বের বেদনা। শুভ্র পোষাক ও দাড়িওয়ালাদের কাফেলা অনেকটা পিপীলিকার মত বেরিয়ে আসে গর্ত হতে এবং দখল করে নেয় রাজনীতির মঞ্চ। অথচ দুদিন আগে এ মঞ্চেই শুরু হয়েছিল কথিত দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধাপরাধী বিচারের কাধে চড়তে গিয়ে কিছু ব্লগার নিজেদের আবিস্কার করে ফেলে সেনাপতির চেয়ারে। এবং সে চেয়ার হতে চালু করে দেশ পরিচালনার নতুন কমান্ড সেন্টার। কাকে নিষিদ্ধ করতে হবে, কাকে ধরতে হবে, কাকে মারতে হবে, কাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করতে হবে, তা কেবল ঘোষনার মধ্যেই সীমিত থাকেনি, বরং সময় বেধে আলটিমেটাম দিয়ে বলতে গেলে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার হাতে তুলে নেয় নিজেদের হাতে। যে হেফাজতে ইসলামের নাম দেশের কোথাও কোনদিন উচ্চারিত হয়নি শেষ পর্যন্ত তাদের প্রচারণার নীচে দলিত মথিত হয় ব্লগারদের বিশ্বজয়ের উৎসব। রাজমাতা একটু দেরিতে হলেও বুঝতে পারেন নিজের ভুল, এবং মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত মুখ ফিরিয়ে নেন ব্লগীয় ভেঞ্চার হতে। ভোট সমীকরণের কাছে পরাজিত হয় তরুণদের আবেগ, উল্লাস ও স্বপ্ন দেখার উন্মাদনা।
মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯০ জনেরই জানা নেই ব্লগ কি। অথচ কাদের মোল্লার রায় যেদিন বেরোল তারুণ্যের তর্জন গর্জন আছড়ে পরেছিল দেশ হতে দেশান্তরে। কনকনে শীত ও তুষারপাত উপেক্ষা করে হাজার হাজার স্বদেশি নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, লন্ডনের মত বড় বড় শহরের রাস্তায় নেমেছিল। বিদেশিরা অবাক হয়ে দেখেছিল আবেগের উদ্দামতায় একদল আদমের চীৎকার। হয়ত বুঝতে কষ্ট হয়েছিল চিৎকারের ভাষা, প্রতিবাদের উদ্দেশ্য, স্থান, কাল, ও পাত্রের ভেন্যু। কিন্তু তাতে দমে যায়নি হুজুগে মাতাল বাংলাদেশিরা। অনেকের কাছে এ ছিল ’৭১এর পুনঃজন্ম। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল বিজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। নিজামী, গোলাম আজমদের সাথে খালেদা জিয়া, মাহমুদুর রহমানদের কবর খুড়তেও অনেকে তৎপর হয়ে উঠেছিল। পথের কাটা বিরোধী দলীয় নেত্রীকে গোলাপি বানিয়ে ড্রেনে সমাহিত করেও কেউ কেউ তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন। কিন্তু ব্লগের বাইরেও যে একটা দুনিয়া আছে এ সত্যটা বোধহয় কারও মগজে আসেনি। এক অর্থে সে দুনিয়াই আসল দুনিয়া, আসল বাংলাদেশ। সেখানে হাতগোনা কজন ব্লগার ছাড়া কোটি কোটি স্বদেশির বাস, যারা রুটি রুজির সন্ধানে প্রতিদিন রাস্তায় নামে, ফসলের মাঠ মাড়ায়। সহজ, সরল ও ধর্মভীরু এসব মানুষকে হিসাবের বাইরে রেখে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো বদলে দেয়ার ব্লগীয় চেষ্টাকে যারা বিপ্লব হিসাবে দেখেছিলেন তাদের হয়ত দেশকে চিনতে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। বাংলাদেশের যে কোন পরিবর্তনে ৯০ ভাগ মানুষের স্বার্থ প্রতিফলিত না হলে সে পরিবর্তন বুমেরাং হয়ে জাতির গলায় চেপে বসতে বাধ্য। আজকের হেফাজতে ইসলাম তারই ইঙ্গিত।
আওয়ামী নৌকায় ইতিমধ্যে ফুটো তৈরী হয়ে গেছে। তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সে নৌকাকে বিপুল বিক্রমে তলিয়ে দিতে বাধ্য করবে কেবল। এমনটাই আজকের বাস্তবতা। পাশাপাশি ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের পরাজয় প্রতিশোধের রক্তগঙ্গা ডেকে আনতে বাধ্য। এ রাস্তা খোদ শেখ হাসিনা নিজ হাতে তৈরী করে রেখেছেন। ভার্চুয়াল দুনিয়ার স্বাধীনতা ভোগ করার নামে আওয়ামী প্রতিপক্ষকে যারা নিজের প্রতিপক্ষ বানিয়ে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে চলছেন তাদের নতুন করে ভেবে দেখার অনুরোধ করবো। কারণ ছাত্রলীগের মত তাদেরও আছে দল, শিবির, পুলিশ, আদালত, বিচারক ও কোটি কোটি জনতা। হিংস্রতায় ওরা কারও চেয়ে কম যায়না। ভুল সময়ে ভুল ভাষার ব্যবহার কতটা বিপদ ডেকে আনতে পারে আসিফ মহিউদ্দিন গং’রা হয়ত এতদিনে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। সরকারের পয়সায় পাঁচ তারকা হোটেলে বাস করে, সরকারের দেয়া গানম্যান নিয়ে বেশিদিন নিরাপদে থাকা যাবে এরই বা নিশ্চয়তা কোথায়?
দুই পরিবারের ক্ষমতার লড়াই দেশকে গৃহযুদ্ধের দাঁড়প্রান্তে নিয়ে গেছে। কুৎসিত এ লড়াইয়ের বলি হয়ে গোটা জাতি ধুকছে। পাশাপাশি জাতীয় সম্পদ লুটপাটের ভয়াবহ প্রতিযোগিতা ছোট করে দিচ্ছে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে বেচে থাকার পৃথিবী। পরিসর সীমিত হলেও ভার্চুয়াল দুনিয়া ছিল এমন একটা স্থান যেখানে দলীয় ভক্তির উর্ধ্বে উঠে তুলে ধরা যেত রাজনীতি তথা অর্থনীতির আসল চেহারা। কিন্তু আমরা ব্লগাররাই বিতর্কিত করে ফেলেছি এ ভেন্যু। যার ফসল ঘরে তুলছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটে ব্যস্ত চোরের দল।