এয়ারপোর্টের পরিসংখ্যান বলছে গেল তিন সপ্তাহে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বাংলাদেশি মালয়েশিয়া ভ্রমণে গেছেন। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, কানাডা সহ ইউরোপের অনেক দেশেও ভিড় বাড়ছে বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের। ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ হাইপ্রোফাইল স্বদেশি বিভিন্ন উছিলায় বিদেশ ভ্রমণ করছেন। অনেকে আবার এক সপ্তাহে একাধিক বার। ভেতরের খবর যাদের জানা নেই তারা হয়ত বলবেন, এতো সুসংবাদ, দেশের অর্থনীতিতে গতি আসছে বলেই তো ভ্রমণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এ জন্যে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচীকে অনেকে সাধুবাদ জানাবেন। একটা সুস্থ, সবল উন্নয়নশীল দেশের উন্নতির সূচক মাপার যন্ত্র হিসাবেও বিবেচিত হতে পারে নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণের অভ্যাস। শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থার তাত্ত্বিক গুরু কার্ল মার্কস বলেছিলেন, আর্থিক ও সামাজিক বিবেচনায় একটা সমাজ কতটা উন্নত তা নির্ণয় করে তার বাসিন্দাদের অবসর কাটানোর সংস্কৃতি। সাম্প্রতিক কালের বিদেশ ভ্রমণ হিড়িক দেশের রাজনৈতিক ও জননিরাপত্তা কারণ দেখিয়েও জাস্টিফাই করা যায়। বাংলাদেশের সমসাময়িক বাস্তবতা বিশ্ব মিডিয়াতে আজকাল ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে। তাই আমাদের মত বাকি দুনিয়াও ধারণা করতে পারে হাই-প্রোফাইল বাংলাদেশিদের ভ্রমণ বৃত্তান্তের আসল কারণ। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য এ চিত্র খুবই টিপিক্যাল। এশিয়া-আফ্রিকা সহ উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেকে দেশে এ ধরণের অস্বাভাবিক ভ্রমণ শুরু হয় বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষাপটে। এমন একটা প্রেক্ষাপট এখন বাংলাদেশের দোরগোড়ায়। তাই স্বদেশিরাও হাটছে সে পথে যে পথে হেটে গেছেন ফার্ডিনান্ড মার্কোস, রেজা শাহ পাহলভি, বেন আলী, মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও বাশির আল আসাদের পরিবার ও তাদের সেবাদাসের দল।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা নেত্রীদের আত্মবিশ্বাসে বড় রকমের চীর ধরেছে। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় গলাবাজি করে উপরে থাকার চেষ্টা করলেও তলে তলে তল্পিতল্পা গোটাচ্ছেন অনেকে। লাখ লাখ ডলার নগদ নিয়ে হয় নিজেরা অথবা নিজেদের আত্মীয়-স্বজনকে ঘন ঘন বিদেশে পাঠাচ্ছেন। এই যেমন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা জনাব এইচ টি ইমাম। উনার আমেরিকা প্রবাসী কন্যা এখন প্রায়ই দেশে আসছেন এবং প্রতিবার লাগেজ ভর্তি নগদ নিয়ে উড়ে যাচ্ছেন নিরাপদ গন্তব্যে । মন্ত্রী, এমপিদের ফোনে তটস্থ থাকছেন এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন ও কাস্টম কর্মকর্তারা। বিনা বাঁধায় লাগেজ সহ বিমানে উঠা নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীনরা ঢালাও ভাবে ব্যবহার করছেন নিজের রাজনৈতিক ও এক্সিকিউটিভ পাওয়ার। এ দৌড়ে এগিয়ে থাকছেন রাজনৈতিক নেতা, সচিব, মন্ত্রিদের পিএস, এপিএস, পুলিশ কর্মকর্তা সহ রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটে জড়িত হোমরা চোমরাদের অনেকে। বিরোধী দলীয় হুইপের উপর হামলাকারী পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি পদোন্নতি সহ প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পেয়েছিলেন, তিনি নাকি পালানোর প্রক্রিয়া প্রায় গুটিয়ে এনেছেন। আওয়ালী লীগের প্রথমসারির নেতা জনাব হানিফ পরিবারের বাকি সবাইকে কানাডা পাঠিয়ে মাইগ্রেশনের প্রস্তুতি পর্ব সেরে রেখেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক জনাব আশরাফ বিদেশি স্ত্রীর নামে যা পাঠানোর তা পাঠিয়ে আখের গোছানোর প্রক্রিয়াও নাকি শেষ করে ফেলেছেন। এ দৌড়ে প্রধানমন্ত্রী ও শেখ পরিবারের বাকি সবার প্রস্তুতি কতটা এগিয়েছে তা জানতে আমাদের আরও কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে। লোটা বাটি নিয়ে চোরের দল পালাচ্ছে, এমন ট্রাজিক অথচ মধুর দৃশ্য আমার মত ম্যাঙ্গোরা মিস করবে তা অকল্পনীয়। এমন ছবি এক জনমে বহুবার মুক্তি পায়না, তাই অপেক্ষা না করার প্রশ্ন আসেনা। ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষায় থাকবো।
জেল-হাজত ও জুলুম-নিপীড়নের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ নির্মূল করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার রাস্তা অনেক পুরানো রাস্তা। এ রাস্তায় খোদ আইয়ুব-ইয়াহিয়া চক্র সহ কথিত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবও হেঁটে গেছেন। শেখ হাসিনাও হাঁটছেন। জামাতি-হেফাজতি জুজুর ভয় দেখিয়ে এ পর্যন্ত দুশতাধিক মানুষ খুন করেছেন। সরকারের জরায়ুতে জন্ম নেয়া মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এসব হত্যাকাণ্ডকে মানুষ হত্যা বলে প্রচার করতে লজ্জা করছে, কারণ তাদের চোখে ধর্ম বিশ্বাসি দাড়িওয়ালারা মানুষ নয়, জামাতি। দেশীয় নয়, পাকিস্তানি। তাই এদের হত্যায় বাঁধা নেই, অপরাধ নেই। আসলেই কি তাই? আশাকরি সরকারকে মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই এ দেশে জন্ম নেয়া প্রতিটা মানুষের রাজনীতি করার অধিকার শাসনতান্ত্রিক ভাবে সংরক্ষিত। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক পছন্দ মানুষের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা আওয়ামী লীগ বা অন্য কোন দলের ম্যান্ডেট নেই। আমি আওয়ামী করবো না বিএনপি করবো, না জামাতি অথবা হেফাজতি তালিকায় নাম লেখাবো এ আমার নিজস্ব পছন্দ। পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই যারা আমার পছন্দ বদলে দেয়ার অধিকার রাখে। এ নিয়ে রাষ্ট্র, সরকার, দল, নেত্রী, পিতা অথবা সদ্য গজিয়ে উঠা ব্লগ দুনিয়াও সিদ্ধান্ত দেয়ার কেউ নয়। পশুদের মান এবং হুস দুটোর একটাও নেই। এদের দিয়ে সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হালচাষ করা যায়, পেটানো যায়, অভুক্ত রাখা যায়। ওরা প্রতিবাদ করেনা। প্রতিরোধ গড়তে জানেনা। মানুষের সাথে পার্থক্যটা এখানেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী হয়ত দেশের ১৬ কোটির সবাইকে পশু ভেবে থাকবেন। কয়েক কোটির কাঁধে দলীয় জোয়াল চাপিয়ে দেশকে পারিবারিক সম্পত্তি বানিয়ে চাষাবাদ করাতে সক্ষম হলেও বাকি কয়েক কোটি বেয়ারা পশুকে বা্গে আনতে লাঠি হাতে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সমস্যাটা এখানেই, সব মানুষই পশু নয়। ৭১’এর খুনিদের বিচারকে প্লাটফর্ম বানিয়ে কোটি কোটি মানুষের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেয়ার নাম গণতন্ত্র নয়। এ শ্রেফ স্বৈরতন্ত্র। কলমের এক খোঁচায় শেখ মুজিব সাড়ে সাত কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে জাতিকে পশু বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। চরম মূল্য দিয়েছিলেন সে জন্য। সন্তান হিসাবে শেখ হাসিনার তা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। লিবিয়ার স্বঘোষিত বাদশাহ মোয়াম্মার গাদ্দাফি বিরোধীদের ঠাট্টা করে ইঁদুর বলে সম্বোধন করতেন। যখন যেভাবে চাইতেন সেভাবে শায়েস্তা করতেন। ইঁদুরের মতই টিপে টিপে মারতেন। ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা, শেষ পর্যন্ত আসল ইঁদুরের গর্তে লুকাতে বাধ্য হয়েছিলেন বাঁচার জন্য। স্বৈরাচারী খুনি সরকার গুলোর পরিণতি বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বে কি হয় তার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের পলায়ন প্রস্তুতি তারই ইঙ্গিত বহন করে।