আমার ভ্রমণ তালিকায় এমন কতগুলো নাম আছে যা স্মৃতির মণিকোঠায় আজীবন লালন করে যাব। চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনি তেমনি একটা নাম। ভ্রমণ পিপাসু বাইরের দুনিয়ার জন্য জন্যে রুশ দেশের ঐ এলাকা কোন কালেই উন্মুক্ত ছিলনা। এ বিবেচনায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। পাহাড় পর্বত ঘেরা সৌন্দর্য্যের অপরূপ লীলাভূমি চেচনিয়া ও ইঙ্গুশেটিয়ার মানুষ গুলোর সাথে যারা মেশেনি তাদের পক্ষে কঠিন হবে পৃথিবীর এ অঞ্চলের জীবন সম্পর্কে ধারণা পেতে। যদিও জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখার বাস্তবতা বার বার ব্যাহত হয়েছে চেচেনদের জন্য। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের একদিন পর আনিসিমভের নেত্রীত্বে বলশেভিকরা দখল নেয় চেচনিয়ার। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। রক্তের নদী বয়ে যায় ককেশিয়ান পাহাড়ের গা বেয়ে। ডেনিকিনের নেত্রীত্বে কশাকদের তীব্র বাঁধার মুখে বলশেভিকরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। সাদা আর্মির হাতে চলে যায় চেচনিয়ার শাসন। হিংস্রতায় সাদা আর্মি দখলদার লাল বাহিনীর চাইতে কোন অংশে কম যায়নি। এভাবে পালাবদল করে লন্ড ভন্ড হতে থাকে চেচেনদের জীবন। ১৯২০ সালের গ্রীষ্মের শুরুতে বলশেভিকরা সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে সাদা বাহিনীর উপর। নতুন করে শুরু হয় রক্তের হোলি খেলা। শেষ পর্যন্ত ১৯২১ সালের জানুয়ারী মাসে চেচনিয়াকে স্থায়ীভাবে আনা হয় সোভিয়েত শাসনের আওতায়। শুরু হয় স্বাধীনচেতা একটা জাতির পরাধীন যাত্রা। বলশেভিক বিপ্লবের বিরোধীতা করার প্রতিশোধ হিসাবে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ গোটা চেচেন জাতিকে পাঠিয়ে দেয় সুদূর সাইবেরিয়ায়। কেবল ১৯৪৪-৪৮ সালে স্টালিনের লাল আর্মির হাতে নিহত হয় প্রায় দেড় লাখ চেচেন, যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২৫ ভাগ। এ হত্যা চলতে থাকে বছরের পর বছর ধরে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিদ্রোহীদের হাতে চলে যায় চেচনিয়ার শাসন। জওহর দুদায়েভের নেত্রীত্বে গঠিত হয় স্বাধীন চেচেন সরকার। জন্ম নেয় নতুন চেচনিয়ার এবং প্রথম বারের মত মুক্তির স্বাদ নেয় দলিত মথিত চেচেন জাতি। স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকদের নেতা আবদুররখমানভকে দিয়ে বেশ কবার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় ক্রেমলিন। ক্ষমতা ফিরে পাওয়া দূরে থাক বরং চরম মূল্য দিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে এক কালের পরাশক্তি রুশরা জল, স্থল অন্তরীক্ষ হতে ক্ষুধার্ত হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পরে চেচনিয়ার উপর। গোটা গ্রোজনি শহর মিটিয়ে দেয় মাটির সাথে। ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পর শিশু, বৃদ্ধ, পোয়াতি মহিলা সহ কাউকে রেহাই দেয়নি দখলদার বাহিনী। যাকে যেভাবে পেরেছে হত্যা করেছে পশু হত্যার কায়দায়। স্থানীয় রুশরা সেনা বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে দুয়ারে দুয়ারে আঘাত হানে এবং বৃদ্ধ ও শিশুদের হত্যা করে পৈশাচিক উন্মত্ততায়। এভাবেই শুরু হয় চেচেন ট্রাজেডির নতুন অধ্যায়। গোটা দুনিয়া বোবা ও অন্ধ হয়ে অবলোকন করে এ গণহত্যা। কিন্তু অন্ধ থাকেনি চেচেন মুক্তিযোদ্ধারা। চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে দুর্বিষহ করে তুলে দখলদার রুশ বাহিনীর জীবন। ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে নিহতের সংখ্যা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রাশানরা শেষপর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হয়। মাত্র তিন হাজার গেরিলার সাড়াশি হামলার মুখে পিঠটান দেয় ককেশিয়ান অঞ্চল হতে। দ্বিতীয় বারের মত স্বাধীনতা পায় চেচনিয়া। তবে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এ স্বাধীনতা।
১৯৯৯ সালের শেষদিকে ব্যালেস্টিক মিসাইল দিয়ে শুরু হয় রুশদের দ্বিতীয় চেচেন অভিযান। ব্যস্ত লোকালয়, মেটারনিটি সেন্টার, বাচ্চাদের স্কুল টার্গেট করে ছুড়তে থাকে এসএস-২১ মিসাইল। দ্বিতীয় বারের মত মাটিতে মিশে যায় রাজধানী গ্রোজনি। পিছু হটতে বাধ্য হয় চেচেন গেরিলারা। তাদের প্রথমসারির অনেক যোদ্ধা প্রাণ হারায় এ আক্রমনে। দখলের পর রুশ বাহিনী ডিনামাইট ফাটিয়ে ধ্বংস করে দেয় বাকি চেচনিয়া। রুশদের হাতে যুগ যুগ ধরে ধর্ষিত চেচেন জাতির গর্ভ হতে জন্ম নেয় নতুন এক প্রজন্ম, যাদের শরীর মন জুড়ে জ্বলতে থাকে প্রতিশোধের আগুন। এ আগুনে পুড়ে সমাহিত হয় চেচেনদের মানবিক মূল্যবোধ। পাশাপাশি সরে আসে মূল লক্ষ্য স্বাধীনতা হতে। অনেকটা পশুত্বের কাতারে নাম লেখায় নতুন প্রজন্মের চেচেন জাতি। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর মার্কিনিদের আফগান অভিযানে উন্মোচিত হয় চেচেন গেরিলাদের নতুন পরিচয়। পালিয়ে যাওয়া গেরিলাদের প্রায় সবাইকে দেখা যায় ওসামা বিন লাদেনের পাশে। রুশ বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ নিয়ে যারা চেচেনদের পাশে দাঁড়িয়েছিল তাদের প্রায় সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং নতুন পরিচয় ঝুলিয়ে দেয় তাদের পরিচয়ে, ইসলামী বিছিন্নতাবাদী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সব দেশে চেচেনদের পরিচয় এখন উগ্র জঙ্গি হিসাবে। সোমালিয়া, সুদান, মালি, ইয়েমেন সহ পৃথিবীর অনেক দেশে জঙ্গি মুসলিম সংগঠন গুলোর হয়ে যুদ্ধ করছে নতুন প্রজন্মের চেচেনরা। স্বাধীন চেচেন কোর্সে শেষ পেরেক ঠুকে দেয় গেরিলাদের বেসলান ম্যাসাকার। ২০০৪ সালের ঘটনা। সে বছর সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে চেচেন ও ইঙ্গুশ গেরিলাদের একটা গ্রুপ উত্তর ওসেটিয়ার বেসলান শহরের এক স্কুলে হামলা চালিয়ে জিম্মি করে নেয় ১১০০ জনকে। যার বেশির ভাগ ছিল স্কুলগামী শিশু কিশোর। চেচেন নেতা সামিল বেসায়েভের বাহিনী তিন দিন ধরে আটকে রাখে শত শত শিশুকে। অনাহার অর্ধাহারের পাশাপাশি ও গেরিলাদের চরম অমানবিক কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়ণ সৃষ্টি করে। এই সুযোগে বর্বর রুশরা ট্যাংক ও সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে নির্বিচারে আক্রমন চালায় এবং প্রবেশ করে স্কুল আঙিনায়।ঙ্গে অভিযানে নিহত হয় ৩৩৪ জন, যার ১৮৬ জনই ছিল শিশু। এভাবেই মুখ থুবড়ে পরে চেচেনদের মুক্তির লড়াই। এ মুহূর্তে নিজ ভূমিতে তৃতীয় শ্রেনীর নাগরিক হয়ে বড় হচ্ছে চেচেন জাতি। রক্তে যাদের প্রতিশোধের আগুন বিশ্ব সমাজের অবজ্ঞা ও অবহেলার কারণ আজ তারা ছন্নছাড়া, ঘর ছাড়া, দিশেহারা।
চেচেনদের নিয়ে এ লেখার প্রাসঙ্গিক একটা কারণ আছে। বোস্টন ম্যারাথনে যে দুই ভাই বোমা হামলা চালিয়ে তিন মার্কিনিকে হত্যা করেছে তারাও নতুন প্রজন্মের চেচেন। কে বা কারা তাদের এ কাজে মোটিভেট করেছে তা এখন তদন্তের বিষয়। বড় ভাই তামেরলান তাসারনায়েভ ইতিমধ্যে নিহত হয়েছে পুলিশের হাতে। ছোট ভাই জওহর তাসারনায়েভ আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে বোস্টন হাসপাতালে। নিরীহ মার্কিন নাগরিক হত্যা করে এই দুই ভাই বিশ্বকে কি ম্যাসেজ দিতে চেয়েছিল তা এখন ধাঁধার বিষয়। প্রথমত, চেচেনদের ভাগ্য বিপর্যয়ের সাথে মার্কিনিদের কোন হাত ছিলনা। দ্বিতীয়ত, হাজার হাজার চেচেন উদ্বাস্তুকে নিজ দেশে আশ্রয় দিয়ে ভুলে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিল ককেশিয়ান বিভীষিকা। নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় নিরীহ জনগণকে জিম্মি করে অভিষ্ট লক্ষ্য হাসিল করার প্রবণতা যে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য, নিজ দেশে পরবাসী চেচেন ও প্যালেস্টাইনিদের তা হয়ত বুঝার সময় হয়েছে।
যাদের অতিথি হয়ে চেচনিয়ার মাটিতে পা রেখেছিলাম, তাদের সবাই আজ মৃত। শৃংখলার দাসত্ব হতে দেশকে মুক্ত করতে গিয়ে তারা সবাই প্রাণ দিয়েছে। স্বাধীন ভাবে বাস করা একটা জাতির জন্মগত অধিকার। এ অধিকার হতে চেচেন, প্যালেস্টাইন অথবা কাশ্মীরিদের বঞ্চিত করে বিশ্ব শান্তি তথা দেশে দেশে অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াই যে সফল হবেনা বোস্টন বোমা হামলা তার সর্বশেষ প্রমাণ। যতদিন চেচনিয়ার উপর আকাশ থাকবে, ককেশিয়ান পর্বতমালা বরফ ও বসন্তের বাতাসে আন্দোলিত হত থাকবে, চেচেনদের স্বাধীন ভাবে বাস করার ইচ্ছা, আকাঙ্খা, লড়াইও ততদিন চলতে থাকবে। সমস্যার স্থায়ী সমাধানে না গিয়ে দু একজনকে জেল ফাঁসি দিয়ে নিরাপদে বাস করা যাবে এমনটা ভেবে থাকলে পশ্চিমাদের এ ভুল চরম মূল্য দিয়ে পরিশোধ করতে হবে। তামেরলান ও জওহরদের যতই আধুনিক সুবিধা দিয়ে বড় হওয়ার সুযোগ দেয়া হোক না কেন, ওরা কোনদিন ভুলে যাবেনা কি ঘটেছিল তাদের মাতৃভূমিতে। তাই ভুল হলেও বার বার পা বাড়াবে পিচ্ছিল পথে...