জনাব সোহেল রানা কি রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর রানা ভবন গড়ে তুলেছিলেন, না ভবন সহ আলিশান সম্পত্তি নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন? অনেকটা ’মুরগী আগে না ডিম আগে’ প্রশ্নের মতই শোনাবে প্রশ্নটা। দুভাবেই সম্ভব বাংলাদেশে। কেউ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেন, কেউবা আবার হেলিকপ্টারে চড়ে সিঁড়ির শীর্ষে পা রাখেন। যেহেতু যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাই ধরে নেব ক্ষমতার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়েই এ পর্যন্ত এসেছেন। নাম, প্রতিপত্তি, যশ, সম্পদের বাহারী সমাহার সহ খ্যাতিমান হতে চাইলে রাজনীতিতে নাম লেখাতে হয়, আবার রাজনীতিতে নাম লিখিয়েও এসবের মালিক হওয়া যায়। এরও হরেক রকম কারণ থাকে। রাজনীতির সাইড লাইনে বসে বৈধ পথে আয়কৃত সম্পদ রক্ষা করা আর আবাবিল পাখির পীঠে চড়ে সৃষ্টিকর্তার সাথে দেখা করা প্রায় সমান দুরুহের কাজ। তাই সম্পদের সাথে বাংলাদেশের রাজনীতির সম্পর্ক অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর মত। একজন আরেক জনের পরিপূরক। সোজা বাংলায়, কেউ চুরি করে বড় হয়, কেউ আবার বড় হয়ে চুরি করে। চুরি এখানে অবধারিত, বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হতে শুরু করে সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সবাই এখানে চোর। ’জীবন থেকে নেয়া’ নামের সুন্দর একটা সিনেমা দেখেছিলাম ছোটবেলায়। নির্মাতা বোধহয় মরহুম জহির রায়হান। কাহিনীর সবটা মনে করতে পারবো না, যতদূর মনে হয় পারিবারিক একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রের একনায়কতন্ত্রকে রূপক অর্থে তুলে ধরেছিলেন নির্মাতা। আন্দোলন, বিদ্রোহ, পতন সহ সবই ছিল ছবিটায়, তবে তা রাস্তার চাইতে ঘরেই ছিল বেশি প্রাধান্য। চাইলে সোহেল রানা নামের মধ্যসারির নেতাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র বানিয়ে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটা রূপক ছবি আঁকা যায়। এই নেতার উত্থান লাখ লাখ নেতার উত্থানেরই কার্বন কপি, মুদ্রার এ পীঠ ও পীঠ। আসুন সীমিত পরিসরে সে চেষ্টাটাই করি। উদ্দেশ্যটার আরও একটা কারণ আছে। নিউ ইয়র্ক হতে এক বন্ধু ফোন করে আগ বাড়িয়ে সাবধান করে দিয়েছেন সাভার ট্রাজেডির জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করে যেন ব্লগ না লিখি। বেডরুম পাহারা দেয়ার মত ইমারত পাহারা দেওয়া-ও নাকি মন্ত্রি প্রধানমন্ত্রীদের কাজ নয়। আসুন সে কাজটাই করি, খোদ প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করার চেষ্টা করি। নামও একটা দেয়া যাক সে চেষ্টার, ’সাভার থেকে নেয়া।’
শুরুটা বোধহয় এভাবেইঃ বাবা আবদুল খালেক। তেল মিলের মালিক। মিলে সরষে ভাঙ্গিয়ে তেল করা হয়, না বিদেশ হতে কাঁচামাল আমদানি করে ভোজ্যতেল তৈরী করেন সেটা জানা জরুরি নয়। আবদুল খালেকেরই ছেলে আমাদের সোহেল রানা। যুবক এবং হাতে কাজকর্ম বলতে বিশেষ কিছু নেই। করার প্রয়োজনও হয়না। বাবার যা আয় রোজগার তা দিয়েই চলে। বেশির ভাগ সময় কাটে ইয়ার দোস্তদের সাথে মৌজ ফুর্তি করে। মদ, গাঁজা, চরস, ভাং, ফেন্সি, হিরোইন, এলএসডি, ইয়াবা, ভায়াগ্রা সহ সবকিছুতে বেজায় আসক্তি। এলাকার তরুণদের আড্ডায় খুব জনপ্রিয় আমাদের এই সোহেল। এ নিয়ে বাবাও বেশ গর্বিত। আপন মেয়ের স্বামী জাকির হোসেনের সাথে জায়গা জমি নিয়ে বিরোধ বাধে শ্বশুর খালেক সাহেবের। গর্জে উঠে আরেক সন্তান ও ভবিষত্যের তরুন রাজনৈতিক নেতা জনাব সোহেল রানা। বোনের স্বামীকে ধামরাই এলাকার ধুলিভিটা বাসস্ট্যান্ডে প্রকাশ্য দিবা লোকে শত শত মানুষের সামনে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখে। আগুনের লেলিহান শিখার মত খবরটা পৌঁছে যায় স্থানীয় আওয়ামী নেতা জনাব মুরাদ জংয়ের দরবারে। ভ্রমরে ভ্রমর চেনার মতই একে অপরকে চিনতে পারে। জনাব জং গাঁটের পয়সা ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে জেলহাজত হতে দুরে রাখেন খুনি সোহেলকে। সামনের সংসদ নির্বাচনে জং’এর হয়ে ’জং’ করার চুক্তিতে প্রকাশ্য রাজনীতিতে নাম লেখান ’সাভার থেকে নেয়া’ গল্পের নায়ক। মূর্তিমান আতংক হয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন নিজ এলাকায়।
বাবা খালেক সাহেবের তেলের মিলের পাশেই দুই একর পতিত জমি। বিশাল দুটি পুকুর ও খালি জায়গা সহ সম্পত্তিটার দিকে অনেকদিনের নজর খালেক সাহেবের। ছেলের গায়ে গতরে জোর হওয়ায় নজরটা শকুনের নজরে রূপ নিতে সময় লাগেনি। সম্পত্তির মালিক পাগলা নাথ। আওয়ামী ভোটব্যাংকের স্থায়ী ভোটার এই নাথের সম্পত্তি ক্রোক দিতে সাত পাচ ভাবতে হয়নি সংখ্যালঘুদের রক্ষক ও ত্রাণকর্তা সোহেল সাহেবের। কারণ শেখ হাসিনার নেত্রীত্বে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্ষমতা তার জন্যে এনে দিয়েছে নাম, যশ, প্রতিপত্তি ও অঢেল অর্থ। কেনা হয়ে গেছে প্রশাসন। আইন আদালতের উপর শৌচাগার বানিয়ে নিয়মিত মলমূত্র ত্যাগ করার আইনী বৈধতাও পেয়ে গেছেন ইতিমধ্যে। তাই পাগলা নাথের ঠুকে দেয়া মামলা বানের জলের মত ভেসে যায় সোহেল রানার ক্ষমতার জোরে।
২০০৭ সালের কথা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে ততদিনে। বস সর্বজনাব মুরাদ জং মুজিব কোট লাগিয়ে সংসদে আসা যাওয়ার ক্লিয়ারেন্স পেয়ে গেছেন ইতিমধ্যে। তাই আর দেরি করতে রাজী ছিলেন না রানা সাহেব। ডোবার উপর কোন রকমে মাটি ভরাট করে শুরু করে দেন ১০ তলা ইমারতের কাজ। ঠিকমত পাইলিং ও কম্পাক্টিং না করে সস্তা মালামাল দিয়ে এত বড় দালানের কাজ করতে বলায় বেঁকে বসে ঠিকাদার। ক্ষমতার সোনালী হরিন ততদিনে রানাদের হাতের মুঠোয়। চাইলে ১৬ কোটির সবাইকে শায়েস্তা করার ক্ষমতা ও অধিকার রাখে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ তথা বঙ্গবন্ধু সৈনিকেরা। এ যাত্রায় ঠিকাদারকে শায়েস্তা করার ভেতর ক্ষমতা সীমিত রাখেন যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ধানমন্ডিতে ডেকে নিয়ে থেতলে দেন ঠিকাদারের পা হতে মাথা পর্যন্ত। কেড়ে নেন ব্যবহারের গাড়ি। কেস কোর্টে উঠলে বিচারক রায় দেন রাজনৈতিক প্রতিশোধের কারণে বিরোধী দলের করা এ মামলা আইনের চোখে অবৈধ। ২০০৭ সালে শুরু করা দালানের কাজ শেষ হয় ২০১০ সালে। এবং তিন বছরের মাথায় মাটিতে লুটিয়ে পরে অন্যায় ও অবিচার সমুদ্রের উপর দাঁড়ানো রানা প্লাজা। সাথে নিয়ে যায় দেড় শতাধিক খেটে খাওয়া মানুষের প্রাণ। বিরোধী দলের হরতাল, তাই সাংসদ মুরাদ জংকে নেত্রীর কাছে প্রমাণ করতে হবে সাভারের জনগণ বিরোধী দলের হরতালে সাড়া দেয়নি। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের জন্য এসব নেত্রীর বাধ্যতামূলক শর্ত। মুরাদ জং মানেই কতিপয় সোহেল রানা। তাদের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয় উপরওয়ালার চাহিদা। তাই হরতালের ব্যর্থতা সফল করতে জং সাহেব হাত বাড়ান সোহেলের দিকে। ফাঁটল দেখা দেয়ায় ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ করতে বাধ্য হয় রানা প্লাজার ভাড়াটিয়ারা। দুদিন বন্ধের পর তৃতীয় দিন মাঠে নামে সাংসদের পেশি শক্তির দল। ভয় দেখিয়ে পোষাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের কারখানায় ঢুকানো হয়। বলা হয় ফাঁটল কোন সমস্যা নয়। এর পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। এর ভয়াবহতা বর্ণনা করার মত স্ক্রীপ্ট নেই লেখকের হাতে।
অনেকে প্রশ্ন করবেন এখানে শ্রমিক মৃত্যুর সাথে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কটা কোথায়? প্রথমত, রানা প্লাজা তৈরী করার এত টাকা কোথায় পেল সোহেল? উওর, রাজনৈতিক ক্ষমতা অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট। সমীকরণটা এ রকম, কেবল মুরাদ জং’দের বিজয়ই নিশ্চিত করতে পারে বিশেষ পরিবারের ক্ষমতা। আর একজন মুরাদ জংয়ের বিজয় নিশ্চিত করতে সোহেলদের প্রয়োজনীয়তা বাধ্যতামূলক। এরা বিনা পয়সায় চ্যারিটি করার আদম নয়। তাই চাঁদাবাজী, হত্যা, গুম, খুন, টেন্ডারবাজী সহ ভাগ্য ফেরানোর সব রাস্তা খুলে দেয়া হয় রাজনীতির ছত্রছায়ায়। খুন করলে ওদের কিছু হয়না, কারণ আদালতে আছেন বিচারক লীগের একদল গৃহপালিত ভৃত্য। থানা-পুলিশের জন্য প্রতিটা খুন খুলে দেয় ভাগ্য ফেরানোর নতুন দরজা। রাষ্ট্রযন্ত্রের সবকটা গলি উন্মুক্ত থাকে সোহেলদের জন্য। আইন আদালত, থানা-পুলিশ, মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী সহ প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত উন্মুখ হয়ে থাকেন সেবা দানের জন্য। এভাবে সবকিছু আবর্তিত হয় বিশেষ একজনের ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। এ আবর্তনের গলিতেই জন্ম নেয় একজন সোহেল রানা, দস্যু, তস্কর ও শতাধিক সহজ সরল খেটে খাওয়া বাংলাদেশির খুনি। বাংলাদেশে এমন কি কেউ আছেন যিনি সোহেলকে ২০০ মানুষ হত্যার দায়ে বিচার করার ক্ষমতা রাখেন? চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এমনকি ফাঁসির মঞ্চ হতে সসম্মানে ফিরে আসার রাস্তা তৈরী আছে সোহেলের জন্য। এ জন্যেই নিয়োগ দেয়া হয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি প্রেসিডেন্টকে।
রাষ্ট্রকে যদি মানব শরীর হিসাবে কল্পনা করা হয় বলতে অসুবিধা নেই সবকটা অঙ্গে পচন ধরেছে আমাদের। একজন সোহেল রানাকে শাস্তি দিয়ে এ রোগ দুর করার ভাবনা হবে অনেকটা আকাশ কুসুম কল্পনার শামিল।