সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও দেশটার প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ যেদিন মারা যান সেদিন আমি সোভিয়েত দেশে। সময়টা বোধহয় ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসের কোন একদিন হবে। ১৯৬৪ সালে সেই যে ক্ষমতায় বসেছিলেন নড়াচড়ার নামগন্ধ কোনদিন উচ্চারিত হয়নি। জনগণ প্রায় ভুলেই গিয়েছিল মহাপরাক্রমশালী সোভিয়েত দেশের প্রধানও কোনদিন মরতে পারেন। তাই এই নেতার মৃত্যু বড় একটা ধাক্কা হয়ে আঘাত হেনেছিল সোভিয়েত সমাজে। একজন বিদেশী হিসাবে দেশটার ক্ষমতায় কে বসবে আর কে বিদায় নেবে তা একান্তই সে দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসাবে গন্য করেছি। তাই এ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। তবে সেমিস্টারের মাঝপথে এ ধরণের রাষ্ট্রীয় মৃত্যু দু’একদিনের জন্য হলেও যে আমাদের জন্য ছুটি নিয়ে আসবে এ ব্যাপারে আশার অন্ত ছিলনা। সময়টা ভয়াবহ শীতের সময়। তাপমাত্রা হিমাংকের নীচে চল্লিশ ডিগ্রির আশপাশে উঠানামা করছে। অতিষ্ঠ ছাত্রজীবনে অতিরিক্ত ছুটি অপ্রত্যাশিত বিশ্রাম ও স্বস্তি নিয়ে আসবে এমন একটা প্রত্যাশায় উন্মুখ থাকতাম ঘোষনার। কিন্তু হায়, দিন গড়িয়ে যায় ঘোষনা আর আসে না। ক্রেমলিনের সামনে রেড স্কয়ারে লাখো মানুষের লাইন, বিদেশ হতে শোক বার্তার মিছিল, পাশাপাশি স্থানীয় ও আর্ন্তজাতিক মিডিয়া তোলপাড় কোনকিছুই আমাদের আন্দোলিত করতে পারেনি। আমরা শুধু প্রহর গুনতাম ছুটি নামক মহেন্দ্র ক্ষণের। শেষপর্যন্ত কাঙ্খিত ছুটির দেখা পেলাম, তবে তার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র দু মিনিট। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করতে সপ্তাহ খানেক চলে যায়। তারপর শুরু হয় শেষ বিদায়। যে মুহূর্তে লাশ কবরে নামানো হয় থেমে যায় গোটা দেশ। দু মিনিটের জন্য যে যেখানে ছিল দাঁড়িয়ে যায়। থেমে যায় গাড়ি, ট্রেন, বিমান সহ সব ধরণের যানবাহনের চাকা। কারখানা গুলো হতে দু মিনিটের জন্য বিরামহীন ভাবে বাজাতে থাকে সাইরেন। এভাবেই বিদায় নেন সোভিয়েত লৌহমানব লেনিন, স্তালিন ও ক্রুশেভের উত্তরাধিকারী লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ। ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভুত হন নতুন নায়ক কনসটানটিন উস্তিনভিচ চেরনেন্কো।
ছুটি বিহীন এ ধরণের মৃত্যু কিছুটা হলেও হতাশ ও অবাক করেছিল আমাদের। এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে আমাদের বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদ বিষয়ের শিক্ষক ছোটখাট একটা লেকচার দিয়ে জানালেন জাতিকে ছুটিতে পাঠিয়ে মৃতকে সন্মান দেখানোর রেওয়াজ দেশটায় চালু নেই। বরং অতিরিক্ত উৎপাদনই হতে পারে নেতার প্রতি যথাযোগ্য সন্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন। তর্ক বিতর্কের দেশ ছিলনা সোভিয়েত সাম্রাজ্য, তাই এ নিয়ে ত্যনা পেঁচানোর সুযোগ ছিল সীমিত। সপ্তাহ না ঘুরতে ব্রেজনেভ পর্ব পিছনে ফেলে জাতি এগিয়ে গেল নতুন উদ্যমে। ১৮ বছর যে মানুষটার মুখের কথায় সাইবেরিয়া হতে ভ্লাদিভস্তক পর্যন্ত উঠাবসা করত, ১৮ দিনের মাথায় সে মানুষ ঠাঁই নিল ইতিহাসে। আমরাও ভুলে গেলাম ছুটি না পাওয়ার কষ্ট। তবে এ নিয়ে আমার শিক্ষকের করা মন্তব্যটা কেন জানি মগজে গেথে রইল, এবং সারা জীবনের জন্য। ছুটি, সভা, সেমিনার, বোমা ফাটানো কলম ঝড়, মুখ ফাটানো স্তুতি বন্দনা বাইরে গিয়েও মানুষকে সন্মান, শ্রদ্ধা জানানো যায়, সোভিয়েত দেশে ব্রেজনেভের বিদায় ক্ষণ হয়ত তারই মাইলস্টোন।
প্রতিটা জাতির কিছুনা কিছু ঘটনা থাকে যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় তার বর্তমান ও ভবিষৎ। বাংলাদেশের জন্য ১৯৭১ সাল ছিল তেমনি একটা বছর। স্বাধীনতার জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে সংগ্রাম হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে। দখলদার শত্রুকে পরাজিত করে বিজয়ী জাতি মাথা উঁচু করে পৃথিবীর বুকে পা ফেলেছে, ঝাঁপিয়ে পড়ে উন্নতির দৌঁড়ে সামিল হয়েছে। অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা, মাথার উপর ছাদ এবং স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর লড়াই করতে গিয়ে শত্রু-মিত্রের সমীকরণ নতুন করে কষতে হয়েছে। সভ্যতা এভাবেই এগিয়ে গেছে এবং সামনে হয়ত এভাবেই এগুতে থাকবে হাজার বছর ধরে। আমার বন্ধু নগুয়েন চি থানকে দিয়েন বিয়েন ফু হতে শুরু হওয়া যুদ্ধের দাবানল হতে সরাসরি পাঠানো হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য। তাদের জানা ছিল যুদ্ধ চিরস্থায়ী নয় এবং স্বাধীনতার আসল ফসল ভোগ করতে প্রয়োজন হয়ে যোগ্য মানুষের। কেবল গোটা পরিবারই নয়, নগুয়েনের নিজের শরীরের অনেকাংশ পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল মার্কিন নাপাম বোমার আঘাতে। এতগুলো বছর পর সে নগুয়েনের নাতিকে আসতে হচ্ছে মার্কিন মুলুকে। পোষাক শিল্পের বাজারের সন্ধানে ঘুরতে হচ্ছে ম্যানহাটনের ৫নং স্ট্রীটে। জানিনা নগুয়েনের শরীর হতে নাপাম বোমার ক্ষত গুলো ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেছে কিনা। হয়ত ক্ষত নিয়েই ওদের ঘুরতে হচ্ছে, এবং এমন একটা দেশে যে দেশের বি-৫২ বোমারু বিমানের কার্পেটিং বোমায় জ্বলে, পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল ভিয়েতনামের জনপদ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ৭১ সালে শেষ হয়নি। যুদ্ধ চলছে এবং চলতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। আমরা যারা যুদ্ধকে কাছ হতে দেখেছি, যুদ্ধের ভাল-মন্দের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হয়েছি তাদের কথা ও কাজে যতটা না যুদ্ধের প্রভাব তার চাইতে হাজার গুন প্রভাবে টইটম্বুর জাতির নতুন প্রজন্ম। অনেকটা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মত মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনার বায়বীয় বেলুনে ভেসে বেড়াচ্ছে এ প্রজন্ম। নতুন এ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানেই পাকি ও রাজাকার ’পুন্দানী’, যুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি নিয়ে রাজনীতির মাঠ তথা সোস্যাল মিডিয়ায় লাখ লাখ কর্মঘণ্টা ব্যায়। অথচ চেতনার অপর পীঠে এ দেশে রাজত্ব করছে ভয়াবহ দুর্নীতি, হত্যা, গুম সহ লুটের সুনামী। স্ববিরোধী এসব দেশপ্রেম জাতির অসুস্থতারই বহিঃপ্রকাশ।
স্বাধীনতা তথা দেশপ্রেম কেবল জামাত, পাকিস্তান, রাজাকার অধ্যায় নিয়ে তোলপাড় আর যুদ্ধাপরাধী বিচার দাবির মধ্যেই সীমিত থাকার কথা নয়, এর বাইরেও জাতির কিছু চাওয়া পাওয়া আছে। এসব চাওয়া পাওয়া চেতনার বেলুন হতে মাটির ধরণীতে নামিয়ে আনার জন্যই আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। চাপাবাজি ও ফাঁকা স্টেটাসের বাইরে গিয়েও মুক্তিযুদ্ধকে সন্মান করা যায়। একটা সুস্থ, সবল, ঐক্যবদ্ধ জাতি ও স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর নিশ্চয়তার সমাজ হতে পারে এর মাইলস্টোন।