একজন ঐশি, তানিয়া এবং কার্ল মার্ক্সের বিবর্তন তত্ব

Submitted by WatchDog on Wednesday, August 21, 2013

Bangladesh

মার্ক্সীয় তত্ত্বের অনেক কিছুর সাথে দ্বিমত থাকলেও একটা ব্যাপারে আপোষ করতে অসুবিধা নেই। তা হল সংস্কৃতিক বিবর্তন। সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টা কার্ল মার্ক্সের মতে সংস্কৃতির বিবর্তন অর্থনৈতিক বিবর্তনের উপর নির্ভরশীল। সোজা বাংলায়, আমাদের সংস্কৃতি আবর্তিত হবে আমাদের পকেটকে ঘিরে। অর্থনীতির ভিত্তি যত শক্ত হবে পাশাপাশি বদলাতে থাকবে আমাদের আচার, আচরণ, পোষাক, অবসর যাপন সহ পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক। সন্দেহ নেই বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা যে ভাবেই হোক সচল থাকছে। আজ হতে ত্রিশ বছর আগে ঢাকার একটা ছবির সাথে আজকের ঢাকার কোন তুলনা হয়না। শহর বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে শহরের মানুষ। পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের এ ঢেউ গ্রাম বাংলা পর্যন্ত পৌঁছতেও সময় লাগছে না। আমাদের স্কুল/কলেজ জীবনে অবসরের দৌড় ছিল বড় জোর সিনেমা হল পর্যন্ত। বদলে গেছে আমাদের সে সংস্কৃতি। হোক তা ব্যক্তি অথবা পারিবারিক পর্যায়ে। সবকিছু সম্ভব হচ্ছে চলমান অর্থনীতির অগ্রসরতার কারণে। তবে মার্ক্সীয় অর্থনীতির বিবর্তনের সাথে আমাদের বিবর্তনের কিছুটা মৌলিক পার্থক্য আছে। এই যেমন এর বন্টন ব্যবস্থা। সম্পদের সুসম বন্টনের উপর সাম্যবাদী সমাজের প্রথম স্তর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি, যদিও আমাদের অর্থনীতির সংজ্ঞাটা ঠিক উলটো ধারায় প্রবাহিত। সম্পদের অসম বন্টনের অপর নামই বাংলাদেশের অর্থনীতি। সংগত কারণে সংস্কৃতিক বিবর্তন ও ঘটছে অসম পথে। আর এখানেই বাসা বাঁধছে সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক দ্বন্ধ ও মূল্যবোধের উত্থান পতন। এ দ্বন্ধই হয়ত মধ্যবিত্ত পরিবারের ঐশীকে টেনে নিয়ে গেছে মা-বাবাকে খুন করার মত পৈশাচিক পথে।

২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাস। চারদিকে শীতের আমেজ। নির্বাচনী হাওয়া বইছে দেশে। মোক্ষম সময় দেশে যাওয়ার। প্রায় চার বছর পর হঠাৎ করেই উড়ে গেলাম ঢাকায়। চারদলীয় জোট সরকারের বহুমুখী অপরাধের উপর বিরামহীন লেখা লিখতে গিয়ে ক্লান্ত প্রায়। তাই সামনে হতে এ শক্তির পতন দেখার লোভটা সামলাতে পারলাম না। দেশে গেলে ঢাকায় এক বন্ধুর বাসায় কটা দিন না থাকলে চলে না। লম্বা প্রবাস জীবনের মাঝ পথে যে কটা বছর দেশে ছিলাম তার অনেকটা সময় বাস করেছি তার বাসায়। বলা যায় স্থায়ী অথিতি। এ যাত্রায়ও বাদ গেলনা। ডিসেম্বরের শেষদিন। দেশ বাকি বিশ্বের মত তৈরী হচ্ছে নববর্ষ বরণ করার জন্য। বিকেলে সাতমসজিদ রোডের উপর টিচার্স ট্রেনিং স্কুলের কাছে একটা রেষ্টুরেন্টে বন্ধুর সাথে আড্ডা দিচ্ছি। আড্ডা দিলেও বন্ধুর নিশানা ছিল অন্যদিকে। বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করতে জানাল তৃতীয় একজনের অপেক্ষা করছে সে। কালো রংয়ের ঝক্‌ঝকে একটা গাড়ি এসে থামলো রাস্তার পাশে। খুলে গেল সামনের দরজা। অত্যন্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল একজন তরুণী। পরনে বাংলাদেশি কনটেক্সটে খুবই অস্বাভাবিক পোষাক। চোখে সানগ্লাস ও হাতে বিদেশি তামাকের প্যাকেট এবং মুখে ইংরেজির খৈ। বন্ধুর রহস্যজনক হাসিতে একটু দমে গেলাম। ব্লাইন্ড ডেইটে হাজিরা দিচ্ছে সে। প্রতিপক্ষ আমি নিজে। সাবলীল ঢংয়ে নিজেকে প্রকাশ করলো এবং জানালো প্রথম বার দেখলেও বন্ধুর মুখে অনেকবার শুনেছে আমার কথা। পোষাক, সানগ্লাস আর হাতে তামাকের প্যাকেট দেখে দমে যাওয়ার মানুষ নই আমি। তাই কৌতুহলি হয়ে যোগ দিলাম ত্রিমুখী আলোচনায়। নাম তানিয়া। চেহারা দেখে বয়স অনুমান করার উপায় নেই। প্রস্তাবটা দিতে সামান্যতম দ্বিধা করলো না সে। রাতে বর্ষবরণের রঙ্গিন উৎসবে যোগ দিতে হবে তার সাথে। স্থানীয় একটা হোটেলে পানাহার সহ অনেক কিছুর ব্যবস্থা আছে। বন্ধুও যাবে সেখানে এবং সাথে থাকবে তানিয়ার এক বান্ধবী। দেশে এসেছি মাছে ভাতে দিন কাটাতে। আমাদের বাড়ির পাশে মেঘনা নদী। তার তীর ধরে খালি পায়ে হাঁটার স্মৃতি রোমন্থন করাও ছিল ভ্রমণের তালিকায়। যে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে জীবনের ত্রিশটা বছর কাটিয়েছি একই জিনিস দেশের মাটিতে উপভোগ করার কোন তাগাদাই অনুভব করলাম না। সরাসরি না বলে দিলাম এবং মনে মনে বন্ধুর উপর ক্ষুন্ন হলাম। মুখ ভারি করে যে পথে এসেছিল সে পথেই চলে গেল সে। বিস্তারিত জানতে এবার বন্ধুকে চেপে ধরলাম।

তানিয়া। এটা তার আসল নাম কিনা কেউ জানেনা। জন্ম নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে হলেও রাজনীতির সিঁড়ি ডিঙিয়ে গরীব বাবা অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক। ইংরেজি লেভেল শেষ হওয়ার পর মেয়েকে নামকরা একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে ভেবেছিলেন স্বপ্ন পূরণ হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। তানিয়া অধ্যায়ের দ্বিতীয় পর্বের শুরুটা বোধহয় এখানেই। ’এ-লেভেল’ ’ও-লেভেলের’ সাথে ফুটফাট ইংরেজি, মদ, গাজা, ড্রাগ আর রঙ্গিন নৈশ জীবন অলিখিত বাস্তবতা হয়ে গ্রাস করে নেয় তানিয়াকে। নতুন জীবনকে চরম পাওয়া ভেবে গা এলিয়ে দেয় প্রবাহে। পরিবর্তনটা মা-বাবার চোখে পরতে সময় লাগেনি। শুরু হয় টানাপোড়ন এবং সম্পর্কের অবনতি। বাবার অর্থকড়িতে যৌবন আসলেও নিম্ন মধ্যবিত্তের সংস্কৃতিতে সে ঢেউ খুব একটা আঁচড় কাটতে পারেনি। অথচ নিজের আপন সন্তান তখন অন্য জগতের বাসিন্দা। এমন এক জগৎ যেখানে হাজার বছরের বাংলাদেশি সংস্কৃতি রীতিমত লায়াবিলিটি। এ লায়াবিলিটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনার মাধ্যমেই তানিয়া যুদ্ধ ঘোষনা করে আপনা স্বত্ত্বার লতায় পাতায় জড়িত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। বাইরের লড়াইকে নিয়ে আসে নিজ আঙ্গিনায়। মা-বাবা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি সন্তানের নতুন পরিচয়। এক কাপড়ে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয় তানিয়া। প্রথমে ঠাঁই নেয় উঁচুতলার এক বন্ধুর বাসায়। তারপর একে একে বিভিন্ন বন্ধুদের সাথে লিভ টুগেদার। বেশিদিন টেকেনি এসব অস্থায়ী সম্পর্ক। একসময় ভাটা দেখা দেয় আর্থিক সামর্থ্যে। আমার সাথে ব্লাইন্ড ডেইটের কারণও পকেট। যে হোটেলে নববর্ষের পার্টির আয়োজন হয়েছে তার প্রবেশ মূল্য বার হাজার টাকা। পানাহার সহ যাবতীয় আমুদ আল্লাদের হিসাব টানলে তা একরাতে বিশ ত্রিশ হাজারের ব্যাপার। এত টাকা নেই তার হাতে। কিন্তু পার্টিতে হাজির হওয়া বাধ্যতামূলক। সমগোত্রের অনেক বন্ধু বান্ধব অপেক্ষা করবে তার জন্যে। তাই শিকারের সন্ধানে নামতে হয়েছে। এবং আমি তার টার্গেট।

মার্ক্সীয় ফিলসফির সংস্কৃতি বিবর্তন তত্ত্ব কি তাহলে মিথ্যা? তানিয়াদের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত হয়েছে সত্য, কিন্তু শক্ত হয়নি তাদের সংস্কৃতিক ভিত্তি। ব্যাপারটা কি কন্ট্রাডিক্ট করেনা মার্ক্সীয় তত্ত্বের? আমার কেন জানি মনে হয় কার্ল মার্ক্স তার ফিলসফি লিপিবদ্ধ করার সময় বাংলাদেশ নামক একটা দেশের সম্ভাবনা আমলে নেননি। দেশ এবং সরকারের সংজ্ঞায় মাল মুহিতের মত একজন অর্থনীতিবিদের যোগ্যতা মূল্যায়ন করেননি। পনের কোটি মানুষের সমস্যাসংকুল একটা দেশে চালকের আসনে শেখ হাসিনা নামক একজন প্রধানমন্ত্রী বসবেন তাও বিবেচনায় নেননি। অর্থনৈতিক উন্নতির একটা ধারা থাকে, যা অন্যান্য ফ্যাক্টরের সাথে এক্সপোনেন্সিয়াল গতিতে এগুতে থাকে। সমস্যা হচ্ছে তানিয়া পরিবারের অর্থনৈতিক ভিত্তির প্রায় সবটাই দাঁড়িয়ে লুটপাটের উপর। অর্থনীতিকে লুটপাট ফ্যাক্টর এতটা ডমিনেট করবে কার্ল মার্ক্সের তা জানার কথা ছিলনা। তানিয়া বা ঐশিরা লুটপাটের ফ্যাক্টরেরই বাই-প্রোডাক্ট। যার মূল ’কৃতিত্ব’ রাষ্ট্র ও সরকারের আসনে বসা নির্বাচিত সরকার। নিজেরা প্রস্তুত না হয়ে কেবল সন্তানদের বিবর্তিত সংস্কৃতির সমুদ্রে ঠেলে দিলে তা ছোবল হানতে বাধ্য। ঐশির মা-বাবা সে ছোবলেরই শিকার।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন