মধ্যপ্রাচ্যের পশুত্ব যেন থামতেই চাইছে না। ইরাক হতে মার্কিন দখলদার বাহিনী সরে গেলেও দুর হয়নি দেশটার শিয়া, সুন্নি ও কুর্দি কনফিçক্ট। প্রায় প্রতিদিন বাগদাদ সহ বিভিন্ন শহর কেঁপে উঠছে বোমা হামলয়ায়। রক্তাক্ত হচ্ছে জনপদ। ঝরে পরছে শিশু, নারী সহ নিরীহ মানুষের প্রাণ। এক সময়ের তেল সমৃদ্ধ দেশটার অর্থনীতি এখন পর্যন্ত পায়ের উপর দাঁড়াতে পারেনি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে পশ্চিমা বেনিয়া গুষ্টি তেলকে ব্যবহার করছে তুরুপের তাস হিসাবে। কেউ জানেনা আর কত রক্ত ঝরলে ইউফ্রেটিস ও শাতিল আরবের তীরের দেশটায় শান্তি আসবে। অবস্থা আরও ভয়াবহ প্রতিবেশী দেশ সিরিয়ায়। ওখানে মানুষ মরছে অনেকটা পাখির মত। জটিলতার শুরুটা বোধহয় ২০১১ সালের ১৫ই মার্চ। আরব স্প্রীংয়ের দমকা বাতাসে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে একে এক উড়ে যাচ্ছে ক্ষমতার মসনদে পোক্ত হয়ে বসা রাজা বাদশাহদের আলখেল্লা। উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনেসিয়া, নীল নদের দেশ মিশর, লৌহমানব গাদ্দাফির দেশ লিবিয়া সহ ইয়েমেন, ওমান, জর্ডান দেশে দেশে শুরু হয়েছিল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। সিরিয়ানরাও বাদ যায়নি। তারাও রাস্তায় নেমে আসে এবং দাবি জানায় আসাদ পরিবারের চল্লিশ বছরের লৌহ শাসন অবসানের। এপ্রিলের শুরুতেই রাস্তায় সেনাবাহিনী নামিয়ে দেয় দেশটার কথিত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। ১৯৬৩ সাল হতে আরব সোসালিস্ট বা’থ পার্টি শাসন ক্ষমতার একছত্র অধিপতি। ৫১ বছরে এক দলীয় শাসনের আওতায় দেশটার কোন পরিবর্তন হয়নি বললে ভুল বলা হবে। বরং অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাড় করানো সহ নারীর সমান অধিকার, শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি, সাধারণ সিরিয়ানদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে নজর কাড়া পরিবর্তন প্রশংসার দাবি রাখে। সমস্যা দেখা দেয় এক জায়গায়, পরিবারকেন্দ্রিক ক্ষমতা। পিতা হাফেজ আল আসাদের মৃত্যু পর রাজা বাদশাহদের কায়দায় অভিষেক ঘটে পুত্র বাশার আল আসাদের। ১৯৮২ সালে পিতা হাফেজ আল আসাদের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিরোধী মুসলিম ব্রদারহুড বিদ্রোহ করলে প্রেসিডেন্ট আসাদ নির্মমভাবে নির্মূল করেন সে বিদ্রোহ। প্রায় ৪০ হাজার স্বদেশি প্রাণ হারায় তার বাহিনীর হাতে। ২০১১ সালের আরব স্প্রীং একই সমস্যা নিয়ে আসে পুত্রের জন্য। এবং এখানেও আসাদ ডাইনাষ্টি আশ্রয় নেয় চরম নির্মমতার। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান মতে এ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি সিরিয়ান প্রাণ হারিয়েছে। চল্লিশ লাখ বাড়ি ঘর ছাড়া। পনের লাখ পাড়ি জমিয়েছে প্রতিবেশী দেশ গুলোতে। আসাদ বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করছে সাধারণ সিরিয়ানদের। এ কাজে গেল সপ্তাহে ব্যবহার করেছে রাসায়নিক বোমা, যার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেত্রীত্বে পশ্চিমা বিশ্ব তৈরী হচ্ছে নতুন এক যুদ্ধের। এবং এ যুদ্ধ বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে।
সন্দেহ নেই মার্কিন অনুপ্রবেশ প্রতিবেশী সাদ্দাম হোসেনের মত সিরিয়ায়ও পতন ঘটাবে বাশার ডাইনাষ্টির। মার্কিন অর্থনীতি এখন স্মরণকালের সেরা ক্রান্তিকাল পার করছে। স্বভাবতই ইরাক যুদ্ধের মত সিরিয়া যুদ্ধ নিয়েও সাধারণ মার্কিনিরা প্রশ্ন তুলবে। সিরিয়ার সাথে মার্কিনিদের হিসাব মেলানো অনেক দিন ধরেই ঝুলে আছে। ১৯৮৩ সালের ঘটনা। ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত মধ্যপ্রাচের আরেক দেশ লেবানন। জাতিসংঘের ম্যান্ডেট নিয়ে দেশটায় উপস্থিত হয় বহুজাতিক যৌথ বাহিনী। মার্কিনিরাও ছিল সে বাহিনীতে। এর আগে ১৯৮২ সালে ইসরায়েলি বাহিনী দখল নেয় লেবাননের। উদ্দেশ্য দেশটায় বসবারত প্যালেস্টাইনি উদ্বাস্তুদের নির্মূল করা। উদ্দেশ্য, লেবানন-ইসিরায়েলি সীমান্ত নিরাপদ করা। এসব উদ্বাস্তুরাই নাকি সীমান্ত অতিক্রমে করে নিয়মিত হামলা চালায় ইসরাইলের অভ্যন্তরে। ইসরায়েলিদের সাথে যোগ দেয় লেবাননের খ্রিষ্টানদের জঙ্গি দল ফালাঙ্গিষ্টরা। সাব্রা ও শাতিলা ক্যাম্পে এই দুই বাহিনীর ভয়বহ গণহত্যায় শিউরে উঠে গোটা বিশ্ব। ইসরায়েলি জেনারেল এবং পরবর্তীতে দেশটার প্রেসিডেন্ট এরিয়েল শ্যারন নিজে অংশ নেন এই হত্যাকাণ্ডে। বলা হয় মার্কিনিদের নীরব সম্মতি নিয়েই ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এ ঘটনা ঘটায়। পালটা প্রতিশোধ হিসাবে জনৈক ইরানী নাগরিক ট্রাক ভর্তি বোমা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে মার্কিন ও ফ্রেঞ্চ ছাউনিতে। ২৪৭ জন মার্কিন ও ৫১ জন ফরাসী সৈন্য প্রাণ হারায় এ হামলায়। ঘটনার প্রেক্ষাপটে আর্ন্তজাতিক বাহিনী লেবাননে তাদের কার্যক্রম গুটাতে বাধ্য হয়। মার্কিনিদের সন্দেহ ইরানী নাগরিককে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছিল সিরিয়ান সরকার।
সিরিয়ায় মার্কিনি অথবা জাতিসংঘের ম্যান্ডেট নিয়ে যৌথবাহিনীর প্রবেশ হয়ত ব্যাপক প্রতিবাদের সন্মুখীন হবে। আজন্ম মার্কিন বিরোধিরা হয়ত সিরিয়া অনুপ্রবেশ বিদেশি সম্পদ লুটপাটের মার্কিন কলাকৌশল হিসাবে দেখবে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠবে, তাহল কি ঘটবে সিরিয়ানদের ভাগ্যে? তারা এভাবেই কি মরতে থাকবে?