রুটিন বিহীন জীবন জানতাম মন্থর হয়। ঘড়ির কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে সময় কাটানোর অভ্যাস করতে হয়। কিন্তু সান্তা মার্তার অলস সাতটা দিন কিভাবে চলে গেল বুঝাতে পারলাম না। বিশেষ কোন পরিকল্পনা নিয়ে এখানে আসিনি। শহরে দেখার মতও তেমন কিছু ছিলনা। তাই কোন কিছুতে তাড়া অনুভব করিনি। তাড়া ছিলনা ঘড়ির এলার্মের সাথে বিছানা ছাড়ার, না ছিল রুটিন করে বিছানায় যাওয়ার তাগাদা। রিসোর্টের ব্রেকফাস্ট বাফে খোলা থাকে সকাল দশটা পর্যন্ত। তাই অতিরিক্ত দুয়েক ঘন্টা বিছানায় গড়াগড়ি খেলে হারানোর কিছু ছিলনা। আমাদের কটেজটা ছিল সাগরের একদম পাড় ঘেষে। জানালার পর্দা সরালেই দিগন্তরেখায় আছড়ে পরত সাগরের উত্তাল জলরাশি। ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কিছুক্ষণ শুনতে গেলে বুঁজে আসতো চোখের পাতা। সূর্য্য উঠার অনেক আগে ওয়াটারস্কি প্রেমীরা সাগরে ভীড় জমাতো। মাছ ধরার ট্রলার গুলোকে দেখা যেত দলবেঁধে ঢেউয়ের রাজ্যে মিলিয়ে যেতে। দক্ষিন আমেরিকার দেশ কলম্বিয়াকে কোন অর্থেই নিরাপদ বলা যায়না। ড্রাগ লর্ডদের প্রভাব এখানে সর্বত্র। ফেডারেল সরকার হতে শুরু করে দেশের অর্থনীতির প্রায় সবকটা চাকাতেই আছে মাদকের বিষাক্ত থাবা। নামে বেনামে অনেক কিছুরই নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। এ নিয়ে ভ্রমন ব্যবসার সাথে জড়িত কাউকে প্রশ্ন করলে সবাই মেডেইনের দিকে আঙ্গুল দেখায়। তাদের মতে পাবলো এস্কোবারের প্রেতাত্মা এখনো মেডিয়িনের আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। আসলে ভয় দেখিয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখা যায়না। যদি তাই হত তাহলে আমার মত মাছে-ভাতের বাংলাদেশিকে পৃথিবীর এ প্রান্তে দেখা যেতো না। আগের বার পেরু হতে এন্ডিসের বুক চিড়ে বলিভিয়া পাড়ি দেয়ার পথে অনেক ট্যুরিস্টের মুখে শুনেছি কলোম্বিয়া ভ্র্রমণের রোমাঞ্চকর কাহিনী। যার অনেকটাই ছিল তিক্ততায় ভরা। গুম করে মুক্তিপণ আদায় মাদকের মতই জনপ্রিয় কলোম্বিয়ার ঐ অঞ্চলে। ড্রাগ লর্ডদের কাছ মার্কিন ভ্রমণকারীরা খুবই লোভনীয় টার্গেট। রাজধানী বোগোটা ছাড়ার আগে চিন্তাটা যে মাথায় ঘুরপাক খায়নি তা নয়। পৃথিবীর এ অংশে ভ্রমনে আসার আগে এমন একটা সম্ভাবনার কথা যাচাই বাছাই করেই আসতে হয়।
প্রি-সিলেকশন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে ট্রাভেল এজেন্টের কাছে রিসোর্টের মালিকানা ও নিরাপত্তা নিয়ে কম করে হলেও ডজনখানেক প্রশ্ন করেছিলাম। তারাও একইভাবে দেশটার উত্তর পশ্চিমের দিকে ইঙ্গিত করেছিল। কেবল প্রতিবেশী দেশ পেরু বলে নয়, অনেকের মতে, ড্রাগ ঝামেলা হত বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে কলোম্বিয়া। এ কাজে মার্কিনিদের নিবিড় সহযোগীতা অনেকে মহাদেশের কলংক মুক্তির শুরু হিসাবে বিবেচনা করে থাকে। মাদক ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রণ এখন নাকি মেক্সিকানদের হাতে। দেশটার সীমান্ত শহর খোয়ারেস কলোম্বিয়ার মেডেয়িনকেও নাকি হার মানায়। রিসোর্ট ইরোতামার তিন প্রস্ত নিরাপত্তা বলয় শুরুতেই আশ্বস্ত করেছিল আমাদের। এর পাশ ঘেষে লম্বা বীচও লীজ নেয়া। বাইরের কাউকে সমুদ্রের এ অংশে ঘুরে ফেরা করতে দেখলে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সক্রিয় হয়ে উঠে একদল হিংস্র কুকুর। এখানে যে সাতদিন ছিলাম নিরাপত্তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার অবকাশ ছিলনা। দিনের বড় একটা অংশ সমুদ্রে কাটিয়ে বাকি সময় কাটিয়ে দিতাম রিসোর্টের নিজস্ব গভীর জঙ্গলে। হরেক রকম বুনো পাখির পাশাপাশি পেখম তোলা ময়ুরদের অবাধ চলাফেরা আচ্ছন্ন করে ফেলে সময়। এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা বেঞ্চে বসে ডাক দিলে হরেক রকম পশু পাখি ভীড় জমায়। খাবার দিলে হাল্কা ছোবল মেরে কেড়ে নেয় সে খাবার। অদ্ভুত সব অনুভূতি এসে জড়ো হতে থাকে। মানুষ ও প্রকৃতির এ ভারসাম্য দেখলে মনে হবে বেচে থাকাটা এখনও জরুরি, এখনও সার্থক। জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার ভয়টা সহসাই ভর করতে পারে। করলে অবশ্য ক্ষতি নেই। এলোমেলো হাটতে থাকলে কোথাও না কোথাও পাওয়া যায় সাহায্য। হাল্কা বাতি আর কাচের টুং টাং আওয়াজই বলে দেবে শুঁড়িখানাটা কাছাকাছি কোথাও। ’পথিক, তুমি কি পথ হারিয়েছ?’ মনে হবে স্বপ্নের ঘোরে কেউ কথা বলছে। স্বপ্ন নয়, ইরোতামারই কেউ। পরনের কাপড় যতটা সংক্ষিপ্ত করা যায় তার চাইতে দশ গুন সংক্ষিপ্ত করে আলো আধারের মায়াবী কন্যা হয়ে দাড়িয়ে থাকে ওরা। হাল্কা হাসি দিয়ে আহ্বান জানায় শুঁড়িখানায়। বাইরেরটা শনের হলেও ভেতরে ঢোকা মাত্র ঝলসে উঠবে চাকচিক্য। সব ধরণের তৃষ্ণা মেটানোর বিশাল আয়োজন। ড্রিংকের প্রথম রাউন্ড অন দ্যা হাউস, অর্থাৎ ফ্রি। তারপর যা খাও তার জন্য নিজের পকেটে হাত দিতে হবে। জঙ্গলের সবকটা বাঁকে শুঁড়িখানা গুলোকে অনেকটা ভৌতিক ছায়াছবির রহস্যময় বাড়ি বলে মনে হবে। জানা না থাকলে ভয় ধরতে বাধ্য। সুইমিং পুলটা রিসোর্টের মেইন লবির পাশে। আকারে ছোটখাট একটা নদীর মত। খুব ভোর হতে জড়ো হতে থাকে সুন্দরীর দল। দ্বিতীয় দিনই ওখানে দেখা মিলল এক কালের মিস ইউনিভার্স ভেনিজুয়েলার মিস আলিসিয়া মেচাদোর। কি একটা কোম্পানীর বিকিনি প্রমোট করতে কমার্শিয়াল তৈরী করছে। পুলে মৎস কন্যার মত দাপাদাপি করল ঘন্টাখানেক। এ নিয়ে কেউ অভিযোগ করলো না। বরং প্রাণ ভরে উপভোগ করল ঈশ্বর সৃষ্টি এই রহস্য।
ইরোতামা হতে চলে আসার আগের রাতে আয়োজন করা হল বীচ পার্টি। রাত নামতেই সাগরের পাড়ে জ্বালানো হল বিশাল এক আগুন। আস্ত একটা শুয়োর ও ভেড়া ঝুলিয়ে দেয়া হল আগুনে। চারদিকে মদের ফোয়ারা। বোগোটা হতে একদল নর্তকী আনা হয়েছে। সুগঠিত শরীরে এসব কলম্বিয়ান রমণীদের পরনের কাপড় খুজতে চোখে চশমা লাগাতে হল। মেরেঙ্গে, সাম্বা, কুম্বিয়া, হরেক রকম গানের সাথে নিতম্ব দোলানোর শৈল্পিক কারুকার্য দেখে খোদ ঈশ্বরেরও থমকে যাওয়ার কথা। গভীর রাত পর্যন্ত চলল সাগর পাড়ের উদ্দামতা। শেষরাতে সবার হাতে ধরিয়ে দেয়া হল বিদায়ী উপহার। আমরা যারা উপস্থিত ছিলাম সবাইকে বর্ণনা করতে হল নিজ নিজ জীবন। অত্যন্ত আবেগঘন পরিবেশে ভেঙ্গে গেল সাত দিনের স্বর্গযাত্রা। সকালে আমাদের রওয়ানা দিতে হবে আরও পশ্চিমে। সিয়েনেগা, পুয়েবলো ভিয়েখো, সলিদাদ হয়ে বারাংকিয়া। এবং সেখান হতে কার্তাখেনা দ্যা ইন্ডিয়্যাস। ... চলবে