মনোনয়নপত্র জমা দিতে তিনি হেলিকপ্টারে চড়ে এলাকায় গেলেন এবং জমা শেষে একই ফ্লাইটে ঢাকা ফিরে এলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ এক নতুন সংযোজন এবং মনে হচ্ছে তা টিকে থাকার জন্য এসেছে। পরিবর্তনের এ ধারা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছিলাম শেষবার বাংলাদেশ বেড়াতে গিয়ে। এক বছর আগের ঘটনা। জর্জ (ছদ্ম নাম) আমার ছোটবেলার বন্ধু। তার বাবা ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য। মারা যাওয়ার আগে জীবনের শেষ পাঁচটা বছর ভাগ্যের সাথে অসফল লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন। দলের তখন ভাদ্র মাস। চারদিকে নাই নাই ভাব। টেবিলে তিন বেলা খাবার যোগার দিতে রীতিমত হিমসিম খেতে হয়। আয় বলতে কেবল শহরের বানিজ্যিক এলাকায় মার্কেট ভাড়া। জীবন যুদ্ধের এ কঠিন বাস্তবতা আগে কোনদিন মোকাবেলা করতে হয়নি বনেদি এ পরিবারকে। নিউ ইয়র্কে বসে খবর পাই জর্জের বাবার মৃত্যুর। তত্ত্বাবধায়ক নামক ঝামেলার শেষে আওয়ামী লীগ যেদিন ক্ষমতার শপথ নেয় সেদিন আমি দেশে। বাবা নেই, তাই বলে জর্জ বসে থাকেনি। সুদিনকে স্বাগত জানাতে গুলসান এলাকায় মাসিক ৭৫ হাজার টাকায় ফ্লাট ভাড়া নিতে অসুবিধা হয়নি। কারণ জিজ্ঞেস করতে রহস্যজনক হাসি দিয়ে এড়িয়ে গেল সে প্রসঙ্গ। কিছুটা হলেও ধারণা ছিল কি হতে যাচ্ছে এর পর। ২০১২ সালে দেশে গিয়ে যা জানার জানলাম, যা দেখার তাই দেখলাম।
ছুরির মত ধারালো শরীরের স্বল্প বসনা এক তরুণী আমাকে ওয়েটিংরুমে বসিয়ে ভেতরে গেল বসের সন্ধানে। চারদিক ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম। রূপকথার মত মনে হল সবকিছু। শান সৈকতের এমন জটিল ও ভয়াবহ সমাহার কেবল কল্পলোকেই সম্ভব। সবকিছু সাজানো গোছানো। চারদিকে মৃতপুরীর স্বব্দতা। মাঝে মধ্যে ফাইল হাতে দুয়েকজন এদিক সেদিক করছে। তাও খুব সন্তর্পণে। বাবার মতই বদমেজাজ ছেলের। সামান্য কিছুতে রেগে যায় এবং ছোটবড় কারও উপর হাত তুলতে দ্বিধা করেনা। এ অফিসের কিসের ব্যবসা হয় জানিনা, কিন্তু কর্মচারীদের চেহারা দেখলে আন্দাজ করতে পারি এ আমার বন্ধু জর্জের ব্যবসা। আমরা একসাথে বড় হয়েছি। পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমন করেছি। অনেক ভ্রমর হতে একসাথে মধু পান করেছি। কিছুটা হতাশ হলাম বন্ধুর দর্শনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে। আগে কখনও এমনটা হয়নি। সাধারণত তাকেই অপেক্ষা করতে হয়েছে। মন হল মেয়েটা ইচ্ছা করে নিতম্ব দোলাচ্ছে। স্কার্টের উপর সাদা শার্টের দুটা বোতাম খোলা রাখছে বিশেষ উদ্দেশ্যে। তার বাবার কথা মনে পড়ল। ভদ্রলোকের চরিত্রও ছিল ভেজালে ভর্তি। ব্যবসায় সুন্দরী সেক্রেটারি তার অন্যতম। পর নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক অনেকটা খোলামেলা ভাবেই প্রকাশ করতে পছন্দ করতেন। এ নিয়ে স্ত্রীর সাথে টানাপোড়নের অন্ত ছিলনা। আমি ছিলাম তাদের ভেতরের মানুষ। সব পক্ষই আমাকে স্বাক্ষী মানতে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করত। নিতম্বের শেষ দোলাটা আমার ঠিক মুখটার কাছে এসে শেষ হল। যান্ত্রিক একটা হাসি দিয়ে জানাল একটু দেরি হবে, স্যার এখন ব্যস্ত। আমার নিজেরও সময় ছিলনা। তাই উঠতে হল। নামটা জিজ্ঞেস করে একটা ম্যাসেজ রেখে দরজার দিক পা বাড়ালাম। হয়ত গলার আওয়াজেই হুস হল বন্ধুর। ঝড়ো গতিতে বেরিয়ে এল এবং আমাকে দেখে উল্লাসে ফেটে পরল। কর্মচারীরা মনে হল ভূত দেখার মত কিছু একটা দেখল তাদের অফিসে।
বিশেষ একটা কক্ষ। থরে থরে সাজানো লাল নীল বোতল। এক কোনায় সিংহাসনের মত একটা খাট। পূর্ব লন্ডনের একটা সরকারী ফ্লাট কটা দিন একসাথে শেয়ার করেছি বন্ধুর সাথে। তখনই তার মুখে শুনতাম হবু ব্যবসার স্বপ্নীল কাহিনী। অফিস এবং সাথে সাজানো গোছানো একটা রুম। পুরনো মদের কালেকশন এবং যৌবনা নারী। কাজ আর আনন্দে কেটে যাবে জীবন। কোন কিছুই বাদ রাখেনি স্বপ্নপূরীর সে অফিস হতে। খুব দ্রুত পরিচয় করিয়ে দিল সখের মদ কালেকশনের সাথে। অন্তরঙ্গ মুহুর্তে নতুন করে পরিচয় হল একটু আগে দেখা মেয়েটার সাথে। তার রক্ষিতা। খুব উঁচু পরিবারের কেউ না হলেও ট্রেনিং দিয়ে তাকে উঁচুতে উঠানো হয়েছে। ব্যবসায়িক মনোরঞ্জন তার মূল পেশা। তবে সবকিছুই হয় বিদেশে। থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া সহ ইউরোপের অনেক দেশে তার যাতায়াত। লাভের অংক আশাতীত হওয়ার পরই কেবল উপঢৌকন হিসাবে কদিনের জন্য ছেড়ে দেয়া হয় ক্লায়েন্টের হাতে। শর্ত একটাই, দেশের বাইরে। দু দুটা অসফল বিয়ের পর বন্ধু এখন একা। মনে হল এ নিয়ে খুশির অন্ত নেই তার। যৌন মিলনের ঝাঁপিটা খোলার আগেই থামাতে হল তাকে। ব্যবসা প্রসঙ্গ আসতে বদলে গেল সবকিছু। তালিকাটা লম্বা। যোগ বিয়োগ শেষে যা বুঝাতে চাইল তার পরিমান মাসিক ২ হতে ৩ কোটি টাকা নীট মুনাফা। এলাকায় অনেককে পালন করতে হয়, তাই লাভের অংশ এতটা ’কম’। দুয়েকজন কমন বন্ধুর তুলনা দিয়ে জানাল তাদের মাসিক আয় ১০-১৫ কোটির উপরে। দুয়েকটা উপরওয়ালার নাম চাইলে বন্ধু সজাগ হয়ে গেল এবং কৌশলে এড়িয়ে গেল। অবশ্য না বললেও আমি জানি তাদের। কারণ তার বাবার মুখেই শুনেছি কারও কারও নাম। বন্ধু তার পুরানো আক্ষেপটা নতুন করে প্রকাশ করল। আমি দেশে থাকলে তার আয় রোজগার নাকি দশ গুনা বাড়ানো সম্ভব ছিল। মগজ এবং কানেকশনের সমাহার অনেক কিছু বদলে দেয় বাংলাদেশে, চাইলে আমরা দুজনে হতে পারতাম তার চমৎকার উদাহরন। এসব কথাবার্তায় কোন চমক ছিলনা আমার জন্য। টাকা পয়সা আর বিত্ত বৈভবের গল্প বেশিক্ষন শোনা যায়না। বিরক্ত লাগে। এক সময় ক্রোধ এসে জড়ো হতে থাকে। কক্সবাজার ঘুরে আসার প্রস্তাবটা বন্ধুই দিল। পুরানো স্মৃতি রোমন্থন নাকি আসল উদ্দেশ্য। সময় এবং ট্রাফিক জ্যামের কারণ দেখিয়ে এড়াতে চাইলে হো হো করে হেসে উঠল। একটু অবাক হলাম তার অপ্রাসঙ্গিক হাসির জন্য। উওরে জানাল ট্রাফিক কোন সমস্যা নয়, আমরা হেলিকপ্টার ভাড়ায় নিয়ে যাবো। কেবল তখনই কিছুটা হলে আন্দাজ করতে পারলাম বন্ধুর সম্পদের পরিমান। নিউজিল্যান্ডের রটোরোয়া বলে একটা হট স্প্রীং এলাকা আছে। হেলিকপ্টারে চড়ার অভিজ্ঞতা ওখানেই সেরে নিয়েছি জানাতে বন্ধু দমে গেল। রাতে একটা প্রাইভেট ক্লাবে আসার দাওয়াত দিল। অনেক সিনে ও টিভি তারকাদের খোলামেলা জীবনের সাথে চাইলে নাকি পরিচিত হওয়া যাবে। এসব আমার জন্য সব চাইতে অনাকাঙ্খিত উপাদান। তাই ধন্যবাদ জানিয়ে প্রত্যাখান করলাম। বিদায়টা খুব সুখকর হলনা। বন্ধু বুঝতে পারল আমি বিরক্ত হচ্ছি। খালাম্মার কথা জিজ্ঞেস করে অনেকটা গায়ের জোরে বিদায় নিলাম।
গুলসানের এ এলাকাটা খুব অপরিচিত লাগল আমার কাছে। বাড়ি ঘর, রাস্তা ঘাট সবকিছু মনে হল এক একটা অর্থ কামানোর ফ্যাক্টরি। এক সময় জর্জের সাথে প্রতিটা রাস্তা চষে বেড়িয়েছি। অমাবশ্যা জোৎস্না রাতে গলির ধারের ট্রলি হতে ফুচকা খেয়েছি। মিটমিটে আলোর রেষ্টুরেন্ট হতে গরম গরম পরোটা ও ভাজি দিয়ে রাতের খাবার সেরেছি। আর্থিক কষ্ট নিয়ে দুজনের কেউই আমরা বড় হয়নি। কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতা ছিল। তাই সবকিছু শেয়ার করেছি। মাঝে মধ্যে রিক্সা ভাড়া নিয়ে দ্বিধায় পরেছি, তর্ক করেছি। আবার হাতে পয়সা এলে দুহাত উজার করে খরচ করেছি। কিন্তু এত বছর পর কোথায় যেন একটা ছন্দপতন অনুভব করলাম। আমার সব চাইতে কাছের বন্ধু এখন কয়েক শ কোটি টাকার মালিক। এবং বয়স তার মাত্র ৪৩ বছর। রাজনীতি নামক ক্যান্সার সমাজের পরতে পরতে চষে বেড়ায় জানতাম, কিন্তু তা এত কাছে আসতে পারে কল্পনা করিনি। বন্ধুর নারায়ণগঞ্জ বাসার তিন তলার ছাদে কত রাত আমরা জোৎস্না দেখেছি, নির্জন শহর দেখার লোভে হাটতে বেরিয়েছি। কিছুই মেলাতে পারলাম না আজ। মনে হল রাজনীতি আসলে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ, যার ছোঁয়ায় রাতকে দিন আর দিনকে রাত করা যায়। আমেরিকার হিংস্র পশ্চিমে অখ্যাত শহরে আমার বাড়িটার কথা মনে পড়ল। রক্ত পানি করা কামানো অর্থের কিছুটা আগাম দিয়ে বাড়িটা কিনতে হয়েছে। বাকিটা শোধ করতে হয়ত আমার এক বছরের ছোট কন্যাকেও এক সময় হাল ধরতে হবে। কর্পোরেট আমেরিকার মাসে দুবার করে পে-চেকের অংকটার কথা মনে হতে দ্বিধায় পরে গেলাম। আমি কি তাহলে জীবন নামক দৌড়ে ব্যর্থ!
পাঠক, নির্বাচনী হলফনামা বলতে প্রার্থীদের যে আমলনামা বেরিয়েছিল তা পড়তে গিয়ে আপনার কি নিজেকে একবারও ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা বলে মনে হয়নি? ওরা রাজনীতির চাক হতে চুকচুক করে মধু লুটছে আর আপনি সে লোটায় উদ্বেলিত হয়ে তালি দিচ্ছেন, একবারও কি এরকম কিছু মনে হয়নি? স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের চেতনা, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, কাদির মোল্লা, খালেদা জিয়ার জন্মদিন, ফাঁসি - এসব কথন একবারও কি মনে হয়নি বাংলাদেশ নামক দেশটাকে নেংটা করার সিসিম ফাঁক মন্ত্র মাত্র? পড়ে থাকলে মনে আছে কি আলীবাবা চল্লিশ চোরের সে গল্প? আমার কিন্তু মনে আছে। কারণ আমার বন্ধু জর্জদের বাসায় আমি দেখেছি চেতনা বিকাশের এসব সৈনিকদের তৎপরতা। ১৫ই আগষ্ট ওদের বাসায় রান্না বন্ধ থাকে। ২১শে ফেব্রুয়ারী কেটে যায় শহীদ মিনারের পাদদেশে। ১৬ই ডিসেম্বর আসে মহোৎসবের প্রলয় নিয়ে, দলবেঁধে ছুটে যায় জাতীয় শহীদ মিনারে। ওরা রাজাকার নিধনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, খালেদা জিয়া উৎখাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আবার ১লা বৈশাখের সকাল কাটে পানি পান্তায়। কিন্তু দিনশেষ ওদের কুলায় ফিরতে হয়। এবং নামতে হয় বিরামহীন ধান্ধায়। এ ধান্ধা যেনতেন ধান্ধা নয়, দেশকে উলংগ করার ধান্ধা, ধর্ষনের ধান্ধা। তেতাল্লিশ বছর বয়সে কয়েক শ কোটি টাকার মালিক বনতে চাইলে বাংলাদেশে রাস্তা একটাই, চেতনার পাইকারি ব্যবসা। বাকি সব ধাপ্পাবাজি, ধোকাঁবাজি, চাপাবাজি, ছলচাতুরি, ফটকাবাজি ।