বিএনপির দ্বিতীয় টার্মের সময় তখন। প্রবাস জীবনে ব্রেক নিয়ে দেশে অবস্থান করছি। বাবার মৃত্যুর পর অর্ধশতাব্দি পুরানো আমাদের পারিবারিক শিল্পকারখানার চরম দুরবস্থা। জীবন প্রদীপ নিভু নিভু করছে প্রায়। এ অবস্থা হতে বেরিয়ে আসতে হবে এবং যথাসম্ভব দ্রুত...এমন একটা দায়িত্ব নিতে মার জরুরি তলবের কারণে অস্ট্রেলিয়া হতে ফিরে আসতে হল। বছর দেড়েক লাগল নড়বড়ে অবস্থা গুছিয়ে নিতে। এবং দুই বছরের মাথায় শুরু হল নতুন যাত্রা। কর্তন বর্ধনের পর প্রায় তিন শতাধিক শ্রমিক কর্মচারী নিয়ে শিল্পের ভিত্তিটা শক্ত পায়ের উপর দাঁড়িয়ে গেল।
চারদিকের বাণিজ্য বাতাস তখন অস্বাভাবিক ভারী। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কাছ হতে দেখলে গোটা শহরকে মনে হবে চাঁদাবাজীর লাস ভেগাস। সহজ আয়ের এসব বীর সৈনিকদের সংখ্যা হাতে গুনে মুখস্ত রাখা সমস্যা হয়ে দেখা দিল। শেষপর্যন্ত মাছের ভাগার মত ভাগ করতে বাধ্য হলাম। এক ভাগা বিএনপির, এক ভাগা ছাত্রদলের, এক ভাগা আওয়ামী লীগ ও তার সহযোদ্ধাদের, এক ভাগা মসজিদ, মাদ্রাসা, ওয়াজ, মিলাদ, জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, খৎনা, ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ও একভাগা মাননীয় সরকার মহোদয়ের বেতনভুক কর্মচারীদের। ডিসি সাহেব চাঁদার ইংরেজী তরজমা করে এর গায়ে কন্ট্রিবিউশন তকমা লাগিয়ে ঘন ঘন এলান ফরমানো শুরু করলেন। ওসি সাহেবের কেবল টাকা নয়, সুন্দর এক সকালে এত্তেলা পাঠালেন স্ত্রী ঢাকা যাবেন মার্কেটিংয়ে, আমাদের গাড়িটা দরকার। সাথে থাকতে হবে ট্যাংকভর্তি তেল। বাংলাদেশ নামক দেশটার জন্মের উষালগ্ন হতে দেশের বাইরে। তাই অনেক কিছুর উপর নূন্যতম ধারণা ছিলনা। একটা জাতি সন্মিলিতভাবে এভাবে নোংরামির কোমর পানিতে নামতে পারে আমার জন্য তা ছিল অভাবনীয়, বিস্ময়কর।
দুপুরের খাবারের জন্য বাসায় ফিরছি। কড়া রোদ। রিক্সা নেই কোথাও, তাই হেঁটেই রওয়না দিলাম। কয়েক শ গজ যাওয়া হয়নি, ঘ্যাচ করে হুড খোলা একটা জীপ পথরোধ করে ফেলল। পুলিশ। থ্রি নট থ্রি রাইফেল তাক করে মাটিতে শুয়ে পরার তাগাদা দিল। আমি মূর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। অন্য একজন ওকিটকিতে কথা বলতে শুরু করল।
-স্যার একজনরে ধরছি। মসজিদের সামনে। বাকিরা পলাইছে। ঠিক আছে, জলদি আসেন।
একটু পর পালের গোদা থানার ওসি এসে হাজির। এসেই মা-বাবার নামে কুৎসিত একটা গালি দিল এবং সহকারীকে নির্দেশ দিল পাশের সেলুন হতে কাঁচি এনে আমার চুল গুলো কেটে দিতে। প্রমাদ গুনলাম। হিসাব কষে দেখলাম নিজকে প্রকাশের এটাই উত্তম সময়। অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক হিসাবে সাময়িক ভিসা নিয়ে বাস করছি বাংলাদেশে। নিজের অধিকার সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। বাংলা নয়, ইংরেজিতেই শুরু করলাম চোর-পুলিশ খেলা।
হু দ্যা ফাক ইউ আর টু কাট মাই হেয়ার?
স্তম্ভিত হয়ে গেল কথিত একজন সন্ত্রাষীর মুখে ইংরেজি শুনে।
তুই বড় চুলের মাস্তান। তোর কাছে এতকিছুর জবাব দিতে বাধ্য নই।
ডাজ কনষ্টিটিউশন অব বাংলাদেশ লিমিটস ইটস সিটিজেনস রাইট টু হেভ লং হেয়ার? ইফ সো, প্রভাইড মি এভিডেন্স।
এবার থেমে গেল ওসির মুখ। হয়ত আশা করেনি তর্কের সবটা ইংরেজিতে চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ।
- ইউ আর আন্ডার এরেষ্ট।
- নো প্রবলেম। লেট মি টক টু মাই এম্বাসি এন্ড গেট সাম হেল্প।
সংখ্যায় ওরা ছিল ৭/৮ জন। পিনপতনের নীরবতা নেমে এল ঘটনাস্থলে।
নিউ সাউথ ওয়েলসের ড্রাইভিং লাইসেন্সটা পকেটেই ছিল। নিজের পরিচয় যেচেই প্রকাশ করলাম। দমে গেল পুলিশ বাহিনী। এ ফাঁকে খবর চলে গেলে আমাদের কারখানায়। শিফট বন্ধ করে প্রায় ১০০ শ্রমিক ঘেরাও করে ফেললো গোটা এলাকা। চারদিকে টান টান উত্তেজনা। পুলিশ দল নিজেদের ভেতর ফিসফাস শুরু করে দিল। একজন এসে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি রহমান সাহেবের ভাই?
- নট রিয়েলি, আই এম নট, রাদার হি ইজ মাই ব্রাদার। ইংগার ব্রদার।
- আমরা কি আপনাদের কারখানায় গিয়ে কথা বলতে পারি? অতি বিনয়ের সাথে পালের গোদা অনুরোধ জানালেন।
- অভার মাই ডেড বডি। উই উইল স্কয়্যার আওয়ার ইস্যু রাইট হেয়ার।
এবার পুলিশের ঘাড়ে চেপে বসলাম আমি। শুধু শুধু নাম ধাম জিজ্ঞেস করতে থাকলাম। শুরু হল ক্ষমা পর্ব। ভাষ্য মতে কত গুলো মাস্তানকে ধাওয়া করছিল ওরা। তাদের সবার মাথায় লম্বা চুল। দেখতে আমিও নাকি তাদের মত। ততক্ষণে জনতার স্রোত বাড়তে শুরু করে দিল। ঘটনাস্থলে আমাদের পারিবারিক বন্ধু পৌরসভার চেয়ারম্যানকে দেখতে পেলাম। সাথে আমার ছোট ভাই। ওরা শহরের হোমরা চোমরা, মুরুব্বি। জোর করে সরিয়ে আনল আমাকে। রক্তের দাপাদাপি থামাতে ডাক্তার ডাকা হল। তিনদিনের মাথায় সবকিছু থিতু হয়ে এল।
মাস না গড়াতেই মার সাথে বুঝাপড়ায় বসতে হল। স্বপ্ন আর বাস্তবতার লড়াইয়ে বাস্তবতাই জয়ী হল। ফিরে গেলাম দত্ত্বক নেয়া দেশ অস্ট্রেলিয়ায়।...
ক্ষমতার পালাবদল কি বদলাতে পারবে এসব অসূস্থ সংস্কৃতি? নাকি নতুন বোতলে পুরানো মদ ঢালার মত জাতীয়তাবাদিরাও ঢালতে শুরু করবে চরিত্র সংকটের নতুন সিফিলিস? তাহলে আর কিসের জন্য এ হা হুতাস...কারণ আমার জন্য স্বাধীনতা মানে চুলেরও স্বাধীনতা, গণতন্ত্র মানে মুক্ত বাতাসে চলাফেরার স্বাধীনতা...