আগামীকাল বাংলাদেশ নাকি নতুন বিশ্বরেকর্ড করতে যাচ্ছে। দেশের লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষ এক সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গাইবে এবং তাতেই ভেঙ্গে যাবে ইতিপূর্বে করা ভারতীয় রেকর্ড। প্রাসঙ্গিকভাবে একটা ঘটনার কথা মনে পরে গেল। ৯০ দশকের প্রথমদিকে চাকরি উপলক্ষে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে ঘুরাফেরা করছি। ঐ এলাকার গভীর নলকুপ গুলো বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যে বিএডিসি পিডিবির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে কেবল। পত্নীতলা, বদলগাছী ও ধামইরহাট এলাকার নক্সা কাজে সহায়তার জন্য পিডিবি উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে আমাদেরকে। আমি তার প্রকল্প প্রকৌশলী। চৌদ্দ জনের একটা দল নিয়ে থাকি পত্নীতলায়। প্রকল্প মালিকদের সাথে যোগাযোগের জন্য প্রায়ই যেতে হয় রাজশাহী। ওখানেই পরিচয় পিডিবির নির্বাহী পরিচালক বাবু অধীর চন্দ্র সাহা ও সহকারী প্রকৌশলী ২১ আঙ্গুইল্যা জনাব আবু বকরের সাথে। বিধাতা বিশেষ কোন কারণে বকর সাহেবকে অতিরিক্ত একটা আঙ্গুল দিয়ে থাকবেন। আমার বিচারে তা ছিল অর্থকড়ি ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার জন্য। কেবল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সহকারী নন, অফিসের উপরি আয় ব্যবস্থাপনায়ও তিনি ছিলেন হেড অব দ্যা ডিপার্টমেন্ট। প্রকল্পের ফাউন্ডেশন কনসিভ করার ছয় মাস আগে বকর সাহেব আমার হাতে একটা চোতা ধরিয়ে দিলেন, যা ছিল উপরি আয় বন্টন সংক্রান্ত চাহিদাপত্র। এক কথায় পিয়ন হতে শুরু করে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পর্যন্ত কার কত ডিমান্ড তার একটা তালিকা।
দিন যায়, মাস আসে। আবু বকরের আমলনামার সাথে আমার বসরা দফারফা করতে নারাজ। সিদ্ধান্তটা সরাসরি জানাতেও আবার মানা। সমস্যা দেখ দিল ঈদের আগে। বোনাস দুরে থাক মাসিক বেতন নিয়ে দেখা দিল অনিশ্চয়তা। টিমের বাকি সবাই প্রায় বিদ্রোহ করার পর্যায়ে। ঢাকা হতে লাল বার্তা এল, যে করেই বিল আনতে হবে, তাহলেই কেবল বেতন। জরুরি ভিত্তিতে ঢাকাগামী ফ্লাইট ধরতে হল। বসদের বুঝিয়ে উপঢৌকনের অর্থ সাথে করে রাজশাহী ফিরে এলাম। রমাজানের শেষ শুক্রবার। জুমার সময়। মসজিদে মুসল্লিদের ব্যাপক সমাগম। হাতে সময় কম। টাকা গুলো যে করেই হোক বকর সাহেবের কাছে পৌছাতে হবে। এবং বিকেলে রিটার্ন ফ্লাইট ধরে ঢাকা ফিরতে হবে। উপায় না দেখে মসজিদের দিকে রওয়ানা দিলাম। বকর সাহেব ওজু করছেন। ওজু অবস্থায় সালাম দেওয়ার তরিকত জানা না থাকায় চুপ করে রইলাম। নষ্ট করার মত হাতে সময় নেই, তাই ওজুর প্লাটফর্মে নিজকে প্রকাশ করতে বাধ্য হলাম। বকর সাহেবকে মন হল ধ্যানে মগ্ন। আমাকে দেখলেন এবং চোখের ইশারায় কিছু একটা বললেন। আমি পকেট হতে প্যাকেটটা বের করলাম। বকর সাহেব ওজুর ফাঁকে খুব কায়দা করে উপরের পকেটের দিকে লম্বা একটা ফু দিলেন। হা হয়ে গেল পকেটের মুখ। অতি সন্তর্পণে ছেড়ে দিলাম পাঁচশ টাকার বান্ডিলটা। বকর সাহেব দ্বিতীয়বার ফিরে তাকানোর চেষ্টা করলেন না।
ধর্মকর্মে বিশ্বাস নেই অনেকদিন। জুমা পড়ার তাগাদা শেষ কবে অনুভব করেছি তাও মনে করতে পারলাম না। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ফ্লাইট পর্যন্ত বেশকিছু সময় বাকি। বকর নাটকের শেষ অংক না দেখে মসজিদ ত্যাগ করতে মন চাইল না। ভয় ডর দ্বিধা দন্ধ জয় করে বসে গেলাম বকর সাহেবের পিছনের কাতারে। উদ্দেশ্য সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভ নয়, বরং ঐ মুহূর্তে আমার ইহজগতের ভাগ্যদেবতা বকর সাহেবের কর্মকান্ডে নজর রাখা। পিছনে আর দশজন মুসুল্লির মতই জুমা আদায় করলেন বকর সাহেব। পার্থক্যটা ধরা পরল মোনাজাতের সময়। এক পর্যায়ে নাকের পানি চোখের পানিতে ধুয়ে মুছে পবিত্র করে দিলেন ইহজগত পরজগত। এবং ফুরফুর মেজাজে বেরিয়ে গেলেন মসজিদ হতে।
কালকের লাখ, তথা কোটি কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের আয়োজন কেন জানি কোন এক রমজানের শেষ শুক্রবারে বকর সাহেবের মোনাজাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়।