খবরে প্রকাশ নতুন করে আদমশুমারী করতে যাচ্ছে সরকার। শীঘ্রই এ ব্যাপারে লোকবল ও অর্থ বিনিয়োগ সংক্রান্ত ঘোষনা দেয়া হবে। যে কোন উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সঠিক পরিসংখ্যান। হোক তা উন্নত বিশ্বে অথবা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে। আমাদের পরিসংখ্যান খাত বাকি দশটা খাতের মতই দুর্নীতির মহামারিতে আক্রান্ত। বিনিয়োগকৃত অর্থ পকেটস্থ করার উদ্দেশ্যে অনেক পরিসংখ্যানই জন্ম নেয় টেবিলে। গরু ঘাস খায়, গাধা ঘাস খায়, সুতরাং গরু = গাধা, এ ধরনের উদ্ভট ম্যাথমেটিক্যাল মডেলিং কায়দায় সমাধান করা হয় পরিসংখ্যান বিষয়ক সমীকরণ। যার দরুন দেশের মোট জনসংখ্যা নিয়ে রয়েছে বহুমুখি সন্দেহ। লিমিট মডেলিংয়ে সংখ্যাটার উপরের ভ্যালু পনের হলে নীচেরটা হবে সতের। অর্থাৎ পনের কোটি হতে সতের কোটির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে দেশের মোট জনসংখ্যা। আমদানী নির্ভর একটা দেশের অর্থনীতির জন্য এ ধরণের উঠানামা খুবই ভয়ংকর যা বিশ্ব অর্থনীতির সমসাময়িক বাস্তবতায় খাদ্য ও জ্বালানী নিরাপত্তায় ডেকে আনতে পারে নজিরবিহীন বিপর্যয়। এসব নিয়ে ক্ষমতাসীনদের আদৌ কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয়না। বাস্তবতা হল, এখানে রাজনীতিকে অর্থনীতি ডমিনেট করেনা, বরং তার উল্টোটাই বাংলাদেশের বেলায় প্রযোজ্য। তারও আছে বহুবিধ কারণ। যেমন, ক্ষমতা ধরে রাখা অথবা ফিরে পাওয়ায় এ দেশে অর্থনীতির কোন ভূমিকা নেই। সকাল-সন্ধ্যা বিরামহীন ব্যক্তি বন্দনাই মসৃণ করে ক্ষমতার সিঁড়িঁ । আদমশুমারী সংক্রান্ত সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের পেছনেও হয়ত রয়ে গেছে ব্যক্তি বিশেষের নতুন ইচ্ছা অথবা অভিপ্রায় বাস্তবায়নের নীলনকশা। এটাই আমাদের রাজনীতি, এটাই আমাদের অর্থনীতি। এবং এমনটাই আমাদের নিয়তি। আদমশুমারী নামক গৌরি সেনের টাকায় নতুন শ্রাদ্ধের সাথে চাইলে নতুন একটা ইস্যু যোগ করা যায়। এর জন্য নতুন কোন বাজেটের যেমন দরকার হবেনা, তেমনি দরকার হবেনা অতিরিক্ত কোন লোকবল অথবা বাহুবলের। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে নিহত ত্রিশ লাখ শহীদ ও তিন লাখ ধর্ষিতা বীরাঙ্গনার একটা তালিকা। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আসুন পরিসংখ্যান নিয়ে আরও কিছুটা সময় ব্যায় করি।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ হতে ১৬ই ডিসেম্বর। মাসের হিসাবে ৮ মাস ২৩ দিন। দিনের হিসাবে ২৬৭দিন। ঘন্টার হিসাবে ৬৬৭৫ ঘন্টা, মিনিটের হিসাবে ৪,০০০,৫০০ মিনিট এবং সেকেন্ডের হিসাবে মোট ২,৪০,৩০,০০০ সেকেন্ড। বলা হয় ২৬৭ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানিরা মোট ৩০,০০,০০০ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছিল। এবার আসুন যোগ বিয়োগ, পুরন ভাগ দিয়ে সংখ্যাটার একটা ফ্রিকোয়েন্সি দাঁড় করানোর চেষ্টা করি। যা বেরিয়ে আসবে তাতে দেখা যায় পাকিস্তানিরা প্রতিদিন মোট ১১,২৩৬ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছিল। ঘন্টার হিসাবে তা হবে ঘন্টায় ৪৫০জন, মিনিটে ৭.৫ জন এবং সেকেন্ডের হিসাবে ০.১২ জন। এবার আসুন এই ত্রিশ লাখ শহীদের লাশের একটা বিহিত করার চেষ্টা করি। বলা হয় প্রতিটা মুসলমানকে দাফন করতে মোট সাড়ে তিন হাত মাটির প্রয়োজন হয়। এ হিসবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ১,০৫,০০০,০০ হাত জায়গার প্রয়োজন হয়েছিল ত্রিশ লাখ দাফনের জন্য। আমরা যদি গজের হিসাবে দুই হাত সমান এক গজ ধরি তা দাঁড়াবে ৫২,৫০,০০০ গজে। যদি ভুল না হয় ৫,২৮০ গজ সমান এক মাইল। এ হিসাবে মোট গজকে মাইলে নিয়ে গেলে তা হবে ৯৯৪ মাইল। এবং কিলোমিটারের হিসাবে ১৫৯০ কিলোমিটার। ৫৪ হাজার বর্গমাইল আয়তনের একটা দেশে ত্রিশ লাখ লাশ দাফন করতে কত বর্গমাইল জায়গার দরকার তা বের করার দায়িত্বটা পাঠকদের উপরই ছেড়ে দিলাম। অনেকে বলবেন ত্রিশ লাখের সবাইকে দাফনের ব্যবস্থা করা গেছে এমনটা নয়। অনেকে আবার প্রশ্ন তুলবেন শহীদদের অনেকেই ছিল অমুসলিম এবং স্বভাবতই তাদের দাফন করার প্রশ্ন আসেনি। খুবই যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন। এটাও সত্য ত্রিশ লাখ শহীদদের কাউকেই বাংলাদেশের বাইরে হত্যা করা হয়নি। দাফন না করা গেলে তাদের মৃতদেহ কোথাও না কোথাও ঠাঁই পেয়েছিল। যদি স্বতন্ত্রভাবে সবাই দাফন করা সম্ভব না হয়ে থাকে প্রশ্ন উঠবে শত শত গণকবরের। হিন্দুদের ব্যাপারটা খুব সোজা। ৭১সালে বাংলাদেশের কোথাও কোন চিতায় আগুন জ্বলেনি। পাকিস্তানিরা জ্বলতে দেয়নি। তাদের লাশও কংকাল হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে কোথাও না কোথাও ঠাঁই পেয়েছে। পরিসংখ্যান গুলো একত্র করলে একটা প্রশ্ন জন্ম নিতে বাধ্য, আট মাস তেইশ দিনে আসলেই কি সম্ভব ছিল ত্রিশ লাখ হত্যা করার? নিশ্চয় অসম্ভব কিছু নয়। আমরা যদি সমসাময়িক সময়ে আফ্রিকার রুয়ান্ডায় ঘটে যাওয়া গণহত্যার দিকে চোখ ফেরাই তাহলে একবাক্যে স্বীকার করবো বাংলাদেশেও সম্ভব ছিল। ১০০ দিনের গৃহযুদ্ধে ১০ লাখ রুয়ান্ডান প্রাণ হারিয়েছিল, যা ছিল দেশটার মোট জনসংখ্যার শতকরা ২০ ভাগ। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ড গোটা পৃথিবীর সামনে ঘটেছে। লাশের মিছিল ট্রাকে করে ময়লা আবর্জনার মত গণকবর দেয়া হয়েছে। যুদ্ধ শেষে সে সব গণকবরের সন্ধান করে দেশটার সরকার তথা গোটা বিশ্ব নিহতদের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করেছে।
৭১’এ পাকিস্তানিরা এ দেশে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সংখ্যা এদিক ওদিক করে এ অপরাধ লঘু করার কোন উপায় নেই। বর্বরদের বর্বরতা ইতিহাস কোনদিন ক্ষমা করেনা, আমারাও করবো না। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, এই যে ত্রিশ লাখের কথা বলছি তার কোন তালিকা তৈরীর কেন চেষ্টা করছিনা? নাকি খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবেনা এ সংখ্যা? পরিচিত এক আওয়ামী নেতা আমাকে বলেছিলেন মৃতদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে নাকি পাপ হয়। আত্মারা অভিশাপ দেয়। আপাদমস্তক একজন চোরের মুখে হঠাৎ করে পাপের কথা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। আমি অবশ্য অবাক হয়নি, বরং চমকিত হয়েছি। লাশের সংখ্যাকে রাজনৈতিক উপাদান বানিয়ে ক্ষমতার বাজারে মুনাফা লোটা খুব সোজা। বিশেষ করে ৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তাদের জন্য এ সংখ্যা ঈশ্বরের ওহী বাণীর মত কাজ করতে বাধ্য। যার প্রতিফলন দেখা যায় আজকের সোস্যাল মিডিয়ায়। ত্রিশ লাখ সংখ্যার প্রবর্তক আওয়ামী লীগ জেনশুনে কাজটা করে থাকলে সাধুবাদ জানাতে হয় তাদের সুদুরপ্রসারী চিন্তাভাবনার জন্য। জাতিকে একটা বিশেষ পরিবারের সেবাদাস বানাতে এর চাইতে ভাল অস্ত্র দলটা হাতে পাবে বলে মনে হয়না। একবার ভেবে দেখুন, প্রতিবেশী একটা দেশের পানি আগ্রাসনে আমাদের নদী গুলো এখন সর্বশান্ত। নদী তীরের জীবন এখন ইতিহাস। খা খা করছে ফসলের মাঠ। ওরা সীমান্ত হতে আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পশু পাখির মত হত্যা করছে, পাশবিক নির্যাতন চালাচ্ছে। যাকেই দরকার নিজেদের গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে খোদ রাজধানী হতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অসম বানিজ্যিক ভারসাম্যের বোঝা কাধে চাপিয়ে জাতিকে করেছে বিকলাঙ্গ। ড্রাগ এবং অস্ত্রের পাশাপাশি উন্মুক্ত তথ্য প্রবাহের সুযোগ নিয়ে নিজেদের বিকৃত সংস্কৃতি দিয়ে লন্ড ভন্ড করে দিচ্ছে আমাদের সামাজিক ভারসাম্য। এসব নিয়ে প্রশ্ন তুললে ত্রিশ লাখ শহীদের মায়াকান্নায় সমাহিত করে দিচ্ছে আজকের বেচে থাকা। লুটেরার দল দেশ লুটছে, খুন করছে, গুম করছে, করছে ভোট ডাকাতি। এবং দিন শেষে পাপ মোচন হিসাবে ব্যবহার করছে ত্রিশ লাখ শহীদের লাশ।
বাস্তবতা হচ্ছে ৭১’এ ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়নি এ দেশে। কোনভাবেই সম্ভব ছিলনা এ ধরণের পাইকারি হত্যা। মিনিটে ৭ জনের লাশ পরেনি এ দেশে। অন্তত আমরা যারা ৭১’এ দেশে ছিলাম এমনটা দেখিনি। মাটি খুঁড়লেও পাওয়া যাবেনা এত লাশ। হাজার হাজার লাশের গণকবরও নেই আমাদের দেশে। কারও সন্দেহ থাকলে আসুন নিজের পরিবার হতে শুরু করি এর যাচাই। কজন প্রাণ হারিয়েছিল আপনার পরিবারে? গ্রামে অথবা শহরে? সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার ত্রিশ লাখ মানে শতকরা প্রায় ৪ ভাগ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন বাংলাদেশির ৪জন করে প্রাণ হারিয়ে ছিল সে যুদ্ধে। সে হিসাবে আমাদের প্রত্যেকের হাতে থাকার কথা স্বজন হারানোর তালিকা। আছে আপনার হাতে? তাহলে প্রকাশ করুন। এ সংখ্যার ফয়সালা জরুরি পাকিদের পাপ হাল্কা করার জন্য নয়, বরং একদল ক্ষমতালোভী রাক্ষসদের লাশ বানিজ্য বন্ধ করার জন্য। সোস্যাল মিডিয়া হতে পারে এ শুরুর আসল প্ল্যাটফর্ম। আসুন ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধে নিহত প্রতিটা লাশের পরিচয় লিপিবদ্ধ করি। এ সংখ্যা যদি ত্রিশ লাখে দাঁড়ায় সেটাই হবে আমাদের আসল সংখ্যা। শ্রদ্ধাভরে সন্মান জানবো সে সংখ্যাকে। কিন্তু আমরা প্রত্যেক শহীদের নাম জানতে চাই। জানতে চাই তার যাপিত জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এ দেশের রাস্তাঘাটের নাম দেখতে চাই এ সব শহীদদের নামে। এক শেখ মুজিবের নাম গোটা বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাট, নদী-নালা, মুতখানা, লঙ্গরখানা কভার করার জন্য যথেষ্ট নয়। চাই আরও নাম। যুদ্ধের প্রথম প্রহরে যে ব্যক্তি শত্রু ক্যাম্পের মেহমান হয়ে নিজের রাজনৈতিক চামড়া বাচাতে সচেষ্ট ছিলেন তার নামের বন্যায় গোটা দেশ ভেসে যাবে, আর বাকি ত্রিশ লাখ কেবল মায়াকান্নার উপাদান হিসাবে রয়ে যাবে তা হতে পারেনা।
এবারের আদমশুমারী হতে পারে শহীদ সংখ্যা তালিকাভুক্ত করার মোক্ষম মাধ্যম। শুমারির কাজে সরকারী লোকজন দেশের প্রত্যেকটা দুয়ারে কড়া নাড়বে। মাথা গুনবে মোট জনসংখ্যা নির্ধারণের অংশ হিসাবে। একই লোকজন পাশাপাশি আরেকটা তথ্য বের করে আনতে পারে, আর তা হল ৭১’এর শহীদদের নাম, ধাম ও পরিচয়। মনে আছে হুমায়ুন আহমেদের ’বহুব্রীহি’ নাটকের শেষ পর্বের কথা? আবুল হায়াত গরুর গাড়িতে চড়ে অজানার পথে বেরিয়ে পরছেন নতুন এক দায়িত্ব নিয়ে। সে দায়িত্ব ছিল ত্রিশ লাখ শহীদের পরিচয় উদ্বারের দায়িত্ব। কাউকে না কাউকে নিতে হবে এ দায়িত্ব।