অক্ষমতা এক ধরনের মানসিক রোগ। বিশেষ করে আমার মত অক্ষমদের জন্য। বিষণ্নতা রোগের মত এ রোগও মগজে জন্ম নেয় এবং একে একে গ্রাস করে নেয় শরীরের বাকি অংগ। অনেক বছর আগের একটা ঘটনা। প্রিয়জনের সাথে হুমায়ুন আহমদের উপন্যাসে মুক্তি পাওয়া সিনেমা দেখতে গেছি নিউ মার্কেট এলাকার বলাকা সিনেমা হলে। উপচে পড়া ভীড়। বেশির ভাগই মনে হল প্রতিবেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী। ছবি শেষ করে ফেরার পথেই ঘটল ঘটনাটা। দেখতে ছাত্র মত একজন সাথের মানুষটার গায়ে হাত দিল। পাশ হতে আরও দুয়েক জন উল্লাসে ফেটে পরল। অসহায়ের মত তাকাল সে আমার দিকে। হয়ত সাহায্যের আশায়। কিন্তু বিশাল এ জনসমুদ্রে নিজকে মনে হল ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলের অক্ষম একজন পুরুষ মানুষ। অক্ষমতা, অসহায়ত্বের সাথে যোগ হল লজ্জা। মাটির দিকে তাকিয়ে অনেকটা অন্ধের মত বেরিয়ে এলাম ভীড় হতে। ঘরে ফেরার পথটা মনে হল অনন্তকালের যাত্রা। রিক্সায় বসে দুজন চলে গেলাম দুই পৃথিবীতে। তার দুচোখে কষ্টের অশ্রু। আমি ততক্ষণে চলে গেছি অক্ষমতার পৃথিবীতে। এবং প্রতিশোধের মহাপ্রলয়ে গুড়িয়ে দিচ্ছি বলাকা সিনেমা হল সহ গোটা নিউমার্কেট এলাকা। একটা পিপঁড়া মারতে গেলে আমাকে দুবার ভাবতে হয়। অথচ সেই আমি অপমানের প্রতিশোধ নিতে হয়ে গেলাম বন্য, হিংস্র। অনেকটা হিন্দি সিনেমার নায়কের মত একাই মোকাবেলা করলাম ৪/৫ জনের গ্রুপটাকে। ধারণাটা বিষাক্ত ক্যানসারের মত চেপে বসল মগজে। শয়নে স্বপনে তাড়া করে বেড়ায় প্রতিশোধ স্পৃহা। ভুতুরে লড়াই করতে গিয়ে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পরি। নাওয়া খাওয়ায় দেখা দেয় চৈত্র মাসের খরা। স্বভাবতই রাজ্যের অসুখ এসে চেপে ধরে শরীরকে। খবরের কাগজে পড়া অথবা সামনে দেখা অন্যায় ও অনাচারের মোকাবেলা আমি এভাবেই করতে অভ্যস্ত। গত দুদিন ধরে একই কায়দায় নারায়ণগঞ্জ সেভেন মার্ডার সহ গোটা দেশজুড়ে র্যাব, পুলিশ, আওয়ামী ও ছাত্রলীগ ক্যাডারদের তাণ্ডবের মোকাবেলা করছিলাম।
অফিসের ডাইনিং হল জুড়ে কাচের বিশাল একটা জানালা। পর্দা সরালে সামনে লুটিয়ে পরে সান্দিয়া পাহাড়ের উঁচুনীচু শত শত চূড়া। টেবিলে খাবার নিয়ে বিস্ময়কর এ প্যানোরমা দেখতে গেলে কখন যে সময় পেরিয়ে যায় টের পাওয়া যায়না। কিন্তু আজ আর চুড়া গুলোকে তেমন কিছু মনে হলনা। খাবারও মনে হল গলায় আটকে যাচ্ছে। কোথায় যেন ছন্দপতন হয়ে গেছে জীবনের। সবকিছুতে আজ কেমন যেন নদীর ছোঁয়া। শীতলক্ষ্যা নদী। চূড়া গুলোকে মনে হল ভাসমান এক একটা লাশ। হলটায় আমি একা। খেতে ইচ্ছে করছেনা। আজগুবি সব চিন্তা মাথায় এসে জরো হতে লাগল।
......নিঁখোজ ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে ফ্লাইট এমএইচ৩৭০ শুয়ে আছে বঙ্গোপসাগরের তলায়। সাগরের গভীর নোনাজলে ডুবে আছে যাত্রীদের সবাই। ওরা কেউ মরেনি। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে ২৩৯ জন বাংলাদেশি। আমিও তাদের একজন। আমরা ক্লান্ত, শ্রান্ত, ক্ষুধার্ত। ফুরিয়ে আসছে ফ্লাইটের খাদ্য ভান্ডার। জানালার বাইরে তাকালে দেখা যায় হরেক রকম মৎস প্রাণীর জলকেলি। হাঁ হয়ে গিলছি আমরা। এভাবে কেটে গেল এক মাস। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ততদিনে সবাই পরিনত হয়েছি নররাক্ষসে। ধারণাটা আমার মুখ হতেই বেরিয়ে এল। হয়ত ১৯৭২ সালে এন্ডিসের চূড়ায় বিধ্বস্ত উরুগুয়ান এয়ারফোর্স ফ্লাইট ৫৭১’এর কথা মনে হয়েছিল। ৪৫ জন যাত্রীর ২৭ জন বেঁচে গিয়েছিল সে যাত্রায়। এবং ঘটনার দুই মাস পর এন্ডিসের চুড়া পাড়ি দিয়ে খুজে পেয়েছিল জনপদ। বাঁচার জন্য তারা সহযাত্রীদের মৃত লাশ ভক্ষণ করেছিল। এক সময় জীবিতরাও একে অপরের মাংশ খাওয়ার তাগাদা অনুভব করেছিল। কিন্তু এ যাত্রায় আমাদের সে পথে যাওয়ার প্রয়োজন হলনা। প্রথম শ্রেনীতে ভ্রমণ করছিলো ওরা। বাবা, ছেলে ও মেয়ে জামাই। কে একজন চীৎকার করে জানিয়ে দিল যাত্রী তালিকায় তাদের উপস্থিতি। উন্মত্ত হায়েনার মত ধাবিত হল প্রথম শ্রেনীর দিকে। প্রথমে দেখা মিলল পুত্র দিপু চৌধুরীর। তার দিকে হাত বাড়াতে বেরিয়ে এল সিটের নীচে লুকিয়ে থাকা বাবা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। সবশেষে পাওয়া গেল জামাতা তারেক সাইদকে। পুত্র দিপুর পেট হতে ভুরিটা বের করতে সময় লাগল না। নিরাপত্তা বলয় পেরিয়ে কি করে ধারলো ছুরিটা ফ্লাইটে প্রবেশ করল এ নিয়েও কেউ মাথা ঘামাল না। জামাতার শরীর হতে মাথা আলাদা করতে ছুরির প্রয়োজন হলনা। ক্ষুধার্ত পঞ্চাশ নরখাদকের হিংস্র থাবায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তারেক সাইদের শরীর। অনেকটা ফুটবল কায়দায় কেউ একজন লাথি মারল তার মাথায়। গল গল করে বেরিয়ে এল সাদা সাদা মগজ। সবশেষ শিকার বাবা মোফাজ্জল হোসেন মায়া। তৃপ্তি ভরে ভক্ষণ করল মায়ার হাত, পা, মাথা, চোখ, কান, নাক। তারেক সাইদের সিটের নিচেই পাওয়া গেল ৬ কোটি টাকার বস্তা গুলো। টাকার বান্ডেল দিয়ে একে একে ভরাট করা হল তিন জনের চামড়া। ফুলে উঠলো ওদের শরীর। দেখতে অবিকল জ্যান্ত মানুষের মত দেখাল। যাত্রীদের কেউ একজন তিনটা প্যারাসুট নিয়ে এল। সবাই মিলে তিন জনকে তিনটা প্যারাসুটে ঝুলিয়ে ছেড়ে দিল সাগরের অথৈ পানিতে। ওরা আগুনের গতিতে বেরিয়ে এল সাগর হতে। তারপর উড়ে গেল আকাশে। অনেক্ষণ ধরে গুলশান এলাকায় গোত্তা খেল প্যারাসুট গুলো। অনেকে ভাবল ভিনদেশ হতে এলিয়েনরা এসেছে বোধহয়। এক হাজার এক টাকায় সদ্য কেনা দেড় বিঘা জমির উপর বাড়িটায় বসে আরও একজন উপভোগ করছিল এ লীলাখেলা......
তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটল বন্ধু জেসনের ডাকে। এটা কি ভর দুপুরে দেখা অলস স্বপ্ন না একজন অক্ষমের কাল্পনিক প্রতিশোধ পর্বের কুৎসিত বাস্তবায়ন বুঝতে পারলাম না। শুধু বুঝতে পারলাম দেরি হয়ে যাচ্ছে এবং এক্ষুণি ফিরতে হবে টেবিলে।