ক্ষমতার হীরা জহরৎ ও সিসিম ফাঁক মন্ত্র

Submitted by WatchDog on Saturday, August 2, 2014

Bangladeshi

অন্যান্য তত্ত্বের মত গণতন্ত্রেরও নিজস্ব কিছু সংজ্ঞা আছে। এ সংজ্ঞা কতিপয় দল অথবা দলীয় পন্ডিত দিয়ে বদলানোর সুযোগ নেই। তা করতে গেলে ফলাফল হিসাবে যা বেরিয়ে আসবে তা হবে নতুন এক তত্ত্ব। আবিষ্কার একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া। সভ্যতা বিবর্তনের সাথে আবিষ্কারের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। সে বিবেচনায় কেউ যদি গণতন্ত্রের নতুন কোন গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা উপহার দিতে পারেন তা হবে যুগান্তরি আবিষ্কার। বলতে বাধা নেই আমাদের দেশে তাই হচ্ছে। প্রতিদিন কেউ না কেউ নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছেন। এবং তত্ত্বের প্রসব স্থান হিসাবে বেছে নিচ্ছেন টক শো, রাজনৈতিক সভা সমাবেশ, পত্রিকার কলাম অথবা সামাজিক মাধ্যম। ভাড়ায় খুন করার খেপে যাওয়া সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর জন্য একটি লাভজনক ব্যবসা। এ ব্যবসায় জড়িয়ে অনেকেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করে নিচ্ছেন এবং তা যথাসম্ভব দ্রুত। এসব খুনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার লোকেরও অভাব নেই। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা যেমন সমাজতন্ত্র অথবা ধর্মীয় লেবাস দিয়ে বিকৃত করার সুযোগ নেই, তেমনি সুযোগ নেই বিনা বিচারে কাউকে খুন করার বৈধতা দেয়ার। এমনকি ভিক্টিম যদি হয় একজন সিরিয়াল কিলার। ঠোঁট সার্ভিস দিয়ে এসব চিরন্তন সত্য বদলে দেয়ার চেষ্টা নতুন কোন আবিষ্কার নয়, বরং রুগ্ন মানসিকতার বিকৃত বহিঃপ্রকাশ। একই গবেষণা চলছে গণতন্ত্র নিয়েও। এসব গবেষণার ফলাফল জানতে আমাদের খুব একটা অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছেনা। প্রিন্ট মিডিয়া অথবা ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া নিয়মিত সয়লাব হচ্ছে আবিষ্কারের জোয়ারে। একটা দেশের অর্থমন্ত্রী যখন চার হাজার কোটি টাকা লুটের ঘটনাকে ’বিশাল’ অর্থনীতির দেশে যৎসামান্য ঘটবা হিসাবে চিহ্নিত করেন ধরে নিতে হবে কেবল একবিংশ শতাব্দীর অর্থনীতিতে তিনি নতুন মূল্যবোধের জন্ম দিচ্ছেন না, পাশাপাশি ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টের সনাতনী ধ্যান-ধারণায়ও আনছেন ’বৈপ্লবিক’ পরিবর্তন।

পাঠক, আপনাদের কি ’সিসিম ফাঁক’ মন্ত্রের সাথে পরিচয় আছে? যাদের নেই তাদেরকে কিছুক্ষণের জন্য আলীবাবা চল্লিশ চোরের রাজ্যে নিয়ে যেতে চাই। বাকিদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করবো। আরব্য উপন্যাস ’এক হাজার এক রাত্রি’র অন্যতম সংযোজন এই গল্প। গরীর কাঠুরে আলীবাবা জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে আবিষ্কার করেন চল্লিশ চোরদের গোপন আস্তানা। গুহার চোরাগলিতে লুকানো এই ভান্ডার খোলার চাবিই হচ্ছে এই সিসিম ফাঁক মন্ত্র। ’সিসিম ফাঁক’ বলা মাত্র গুহার বিশাল দরজা খুলে যায়। মন্ত্র কাজে লাগিয়ে চোরদের গুপ্ত ভান্ডারে ঢুকে পরতে সক্ষম হন গল্পের নায়ক আলীবাবা। ভেতরে ঢুকে তিনি তো থ! সোনাদানা, হীরা-জহরত আর মনি-মুক্তার অথৈ পাহাড়। এবং সেখান হতেই শুরু হয় গরীব আলীবাবার নতুন যাত্রা। এবার চলুন ফিরে যাই মূল লেখায়।

আমাদের বর্তমান সরকার কথিত গণতন্ত্র ও তা রক্ষার নামে যে সার্কাসের জন্ম দিয়েছেন তা এক অর্থে ট্র্যাজিক এবং অন্য অর্থে এন্টারটেইনিং। দল এবং দলীয় বোদ্ধাদের কাছে গণতন্ত্র তথা মানুষের মৌলিক অধিকারের সংজ্ঞা এখন আর গ্রীক সংজ্ঞা নয়, বরং দুই অধ্যায়ের পৌরাণিক উপাখ্যান হিসাবে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। এর এক অধ্যায়, ক্ষমতাসীন এবং অন্য অধ্যায়, ক্ষমতাহীন। এসবের ভেতরে যাওয়ার আগে আলীবাবা কর্তৃক আবিষ্কৃত চল্লিশ চোরের গুপ্ত গুহায় ঢোকা আমাদের জন্য এ মুহূর্তে বাধ্যতামূলক। সার্কাসের মূল আকর্ষণই ঐ গুহা। আমরা কি একবারের জন্যও ভেবে দেখেছি নারায়ণগঞ্জের নুর হোসেনের জন্য নজরুল হত্যা কেন বাধ্যতামূলক ছিল? আসুন জিনিষটা একটু অন্য ভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করি। গণ-প্রতিনিধি হওয়ার বাধ্যতামূলক ইচ্ছা এবং তা বাস্তবায়নের যে পথ আমাদের সামনে আবিষ্কৃত হয়েছে সন্দেহ নেই তা কর্দমাক্ত, রক্তাক্ত এবং ভয়াবহ। গোয়ালের শেষ গরুটা বিক্রি করে হলেও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হওয়ার সাধ, আহ্লাদ ও খায়েশ মেটাতে অনেকে হিংস্র বনে যায়। কেবল দলীয় মনোনয়নের জন্যই হবু মন্ত্রী এম্পিদের ঢালতে হয় কোটি কোটি টাকা। নির্বাচন প্রক্রিয়ার লম্বা ও দুরূহ পথ পাড়ি দিতে কেবল অর্থই নয় বরং হুমকির মুখে ফেলতে হয় নিজের জীবন। তাতেও কিন্তু দুর্গম এ পথ পাড়ি দিতে ইচ্ছুক যাত্রীর অভাব হয়না। দেশের গ্রামে গঞ্জে শহরে গণ-প্রতিনিধি নির্বাচন মানে এখন পানিপথের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হারতে কেউ রাজী নয়। প্রতিপক্ষকে হারাতে গিয়ে প্রফেশনাল খুনি পর্যন্ত ভাড়া করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। কারণটা কি? রহস্যটা কোথায়? মন্ত্রী, এম্পি, চেয়ারম্যান, কমিশনার, মেম্বারদের মাসিক বেতন কি এতটাই আকর্ষণীয় যার জন্য লোটা-বাটি, কম্বল বিক্রি করে পদটা নিতে হবে? এখানেই আসে সিসিম ফাঁক রহস্য। আমার বিচারে দেশীয় গণতন্ত্রে নতুন সংজ্ঞা সংযোজন করেছে চলমান রাজনীতি। যার বিকল্প নাম হতে পারে সিসিম ফাঁক। গণতন্ত্র মানে সিসিম ফাঁক। মন্ত্রবলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের গুহা খুলে ফেলার অপর নামই ক্ষমতা। গ্রীকদের জন্য যা গণতন্ত্র আমাদের জন্য তা সিসিম ফাঁক।

সরকার ও তার প্রতিপক্ষ মন্ত্রের মালিকানা নিয়ে এখন বাকযুদ্ধে ব্যস্ত। হুমকি আসছে এ যুদ্ধ খুব শীঘ্র নাকি মাঠে যাবে। এবং শুরু হবে পানিপথের নতুন যুদ্ধ। কেন এ যুদ্ধ? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর চাইলে আমাদের হাতড়াতে হবে এর গোঁড়া। জোর গলায় বলতে হবে মূল সমস্যা অন্য জায়গায়, চোরের সাম্রাজ্যে দুই চোর! ক্ষমতা ধরে রাখা এবং তা ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে সৈনিকরা মাঠে থাকলেও তাদের অন্তরে থাকবে সিসিম ফাঁক মন্ত্র। সরকারী খাজাঞ্চিখানার সুবিশাল দরজাটা খুলতে চাইলে প্রথমে এর কাছে যেতে হবে এবং উচ্চারণ করতে হবে ’সিসিম ফাঁক’। তবেই কেবল অনুভব যাবে সোনা-দানা, হীরা-জহরত, মনি-মুক্তার উত্তাপ। একবার যারা এই উত্তাপ অনুভব করেছে তাদের পক্ষে দুরে থাকা কষ্টের। আমার কথা বিশ্বাস না হলে বাবু সুরঞ্জিত সেনকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। তিনি রেলের গুহা খুলেছিলেন এবং বুঝেছিলেন সিসিম ফাঁক মন্ত্রের রহস্য। আবুল হোসেনের সাথে কথা বলে দেখুন। বললে শুনতে পাবেন গুহার অলৌকিক সব কাহিনী। সাদেক হোসেন খোকা, আমানুল্লাহ আমান, মওদুদ আহমদদের জিজ্ঞেস করে দেখুন। গুহার তাপমাত্রার উপর এরা একেক জন একেক ধরণের বিশেষজ্ঞ। এখানে প্রশ্ন উঠবে, গুহার মালিকানা নিয়ে। এক পক্ষ দাবি করছে যেহেতু গুহার আসল আবিষ্কারক তারা তাই এর আজীবন মালিকানা তাদের হাতেই থাকতে হবে। অন্যপক্ষ বলছে, তা কি করে সম্ভব! মন্ত্র দিলেই যদি গুহা খুলে যায় সে মন্ত্রের উপর তাদেরও অধিকার আছে।

পদটীকাঃ দুই চোরের লড়াইয়ে আমরা তাহলে কারা? সিসিম ফাঁক মন্ত্রের মালিকানা নেয়ার ম্যান্ডেট যদি গণতন্ত্র হয় আমরা কি এর অংশ নই? দাঁড়ান, এখানেও কথা উঠবে! আলীবাবা ৪০ চোর উপাখ্যানে আর কি কোন পার্শ্ব চরিত্র নেই? আছে, নিশ্চয় আছে এই যেমন মর্জিনা, কাসেম... আমরা কি তাহলে তাদেরই একজন?

ভালো লাগলে শেয়ার করুন