গোলাম আজমের শেষ যাত্রা, কফিনে একটি শুয়োর ও কিছু কথা...
গোলাম আজম পর্বের সমাপ্তি হয়েছে শেষ পর্যন্ত। বলা যায় অনেকটাই শান্তিপূর্ণ ভাবে। যা আংশকা করা হয়েছিল তেমন কিছু ঘটেনি। অবশ্য দুর্মুখেরা বলছে ভিন্ন কথা। রাজনীতির মাঠে অঘোষিত বুঝাপড়ার কারণেই নাকি জানাজার মাঠে সরকারী ও বেসরকারি পেটোয়া বাহিনী হামলা করেনি। কৃত্রিম কফিন বানিয়ে তার পাশে শুয়োর বসিয়ে কজন তরুণ উল্লাস করলেও এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের মত সরকারের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী ছিল নীরব। সরকার ও তার প্রাইভেট বাহিনীর ইদানীংকালের কর্মকান্ড বিবেচনায় আনলে অনেকের কাছে তা বিস্ময়অর মনে হবে। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেই বোধহয় জামায়ত এ ইসলামের জোট গুরু বিএনপি জানাজায় কাউকে পাঠায়নি এবং শোক-বানী পর্যন্ত প্রকাশ করেনি। বাংলাদেশের রাজনীতি ও বেশ্যাবৃত্তির মধ্যে মৌলিক এবং গুনগত পার্থক্য আছে কিনা তা গবেষণার বিষয়। চাইলে এর ভেতর থিসিস লিখে পিএইচডি নেয়ারও উপাদাণও পাওয়া যাবে। তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের জন্য রাজনীতির মাঠ ও দৌলতদিয়া ঘাটে কিছুটা সময় ব্যয় করতে হবে কেবল। গোলাম আজম ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের অপরাধ প্রমাণ করার জন্য হাইব্রিড আদালতের প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়না। আমরা যারা ’৭১ কে গাঞ্জার কলকিতে দেখতে অভ্যস্ত নই তাদের কাছে স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধ মানেই সংগ্রাম, যুদ্ধ, মৃত্যু, লাশ আর বিজয়ের মিছিল। রাজাকার , আলবদর ও আলশামস নামক কিলিং মেশিনের তাণ্ডবে গোটা দেশ ছিল ভীত, সন্ত্রস্ত। আর এই গোলাম আজমরা ছিল এসব অপকর্মের পালের গোদা। রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝার আগেই এদের ভিক্টিম হয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি শহর হতে গ্রামে, গ্রাম হতে শহরে। ওরা খোলা আকাশের নীচে আমাদের উলঙ্গ করে মুসলমানিত্বের প্রমাণ নিয়েছে। হিসাবে না বনলে ধরে নিয়ে লাশ বানিয়েছে। জানাজায় লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়ে এসব পাপ মোচন করা যাবে এমনটা ভেবে থাকলে ভুল করবেন কথিত আল্লার বান্দা দাবিদার এসব ’আউলিয়ার’ দল।
পাপ কেবল পাপই। এর অন্যকোন পরিচয় নেই। ৭১ আর ২০১৪ সালের পাপের ভেতর মৌলিক কোন তফাৎ নেই। ৭১ সালের পাপ মোচনের মিশনে ব্যস্ত আওয়ামী লীগের আপাদমস্তক জুড়ে আছে পাপের প্রেতাত্মা। শুরু সেই ৭২ সাল হতে। যেসব মূল্যবোধের উপর এ দেশের মানুষ পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে এক হয়েছিল তার ভিত্তি উপড়ে ফেলে এই আওয়ামী লীগই জন্ম দিয়েছিল নব্য ইয়াহিয়া খানদের। জনগণের নাগরিক ও মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে দেশকে বানিয়েছিল ব্যক্তিপূজার চারণভূমি। এবং আশা করেছিল এ চারণভূমিতে গরু ছাগল বনে এ দেশের মানুষ আজীবন ঘাস খেতে থাকবে। বাস্তবে তা ঘটেনি। রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ মুজিবের ব্যর্থতার জরায়ুতেই জন্ম নিয়েছিল সামরিক শাসন, যার উপর ভর করে ফিরে এসেছিল দেশ শাসনের পাকিস্তানী ভুত। এর পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। ক্ষমতা নিয়ে দুই পরিবারের নোংরা ও কদর্য লড়াইকে বানানো হয়েছে রাজনীতি। দেশের উপর ঠাঁই পেয়েছে দল এবং দলের উপর ব্যক্তি। গোলাম আজম এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা ছিল সে পচনশীল রাজনীতির দাবার গুটি। প্রয়োজনে কাছে টানবো, মিলেমিশে রাজনীতি করবো আবার প্রয়োজনে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলাবো, আওয়ামী রাজনীতির এ চিরন্তন ধারার বলি হয়েই গোলাম আজমকে বিদায় নিতে হয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী এ নেতার ৯০ বছরের জেল হয়েছিল ৭১’এর অপরাধের জন্য নয়, বরং ক্ষমতার লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গী না হওয়ার অপরাধে। রাজনীতির নোংরা সমীকরণে রাজনীতিবিদ-গন নিজেদের ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নিচ্ছেন সত্য, পাশাপাশি দেশকে বিভক্ত করার যে পৈশাচিক উন্মাদনা জাতির রক্তে ছড়িয়ে দিয়েছেন তার ফলাফল ভোগ করতে আমাদের কিছুটা সময় হলেও অপেক্ষা করতে হবে। মৃত গোলাম আজমের জানাজায় লাখ লাখ মানুষের যোগদান এবং পাশাপাশি শুয়োর নিয়ে নব্য দেশপ্রেমিকদের বিকৃত উল্লাস সে বিভক্তি ও বিভাজনেরই কুৎসিত প্রতিচ্ছবি।
আমি যেখানটায় বাস করি তার পাশে লস আলামস বলে একটা শহর আছে। পাহাড় পর্বতে ঘেরা সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ শহরের অতীত কিন্তু ততটা সুন্দর নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ শহরের গবেষণাগারেই আবিষ্কৃত হয়েছিল আণবিক বোমা এবং যার ফসল ছিল হিরোশিমা নাগাসাকির ধ্বংস যজ্ঞ। শহরের নির্জন পথে প্রান্তে হাঁটলে প্রায়ই দেখা মেলে জাপানি টুরিস্টদের। তেমনি একজন টুরিস্টদের সাথে আলাপ হয়েছিল গেল শীতে। এক কালের শত্রু দেশে আসার হেতু জিজ্ঞেস করতে উড়িয়ে দিল শত্রুতা প্রসংগ। জানাল সময় এখন ভিন্ন, এগিয়ে যাওয়ার সময় এটা। হিরোশিমা নাগাসাকির ভয়াবহ ধ্বংস যজ্ঞের মাধ্যমে মার্কিনীরা কেবল জাপানীদের পার্ল হারবার আক্রমণের প্রতিশোধই নেয়নি বরং উন্মোচন করেছিল পারমানবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার নতুন দিগন্ত। সমসাময়িক বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তি জাপান কিন্তু হিরোশিমা নাগাসাকি নিয়ে মার্কিনীদের সাথে স্থায়ী বৈরিতা সৃষ্টি করেনি। বরং তারা এগিয়ে গেছে এবং শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে জবাব দিয়েছে মার্কিন আগ্রাসনের। আমাদের স্বাধীনতার আসল অর্থ যদি অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর নিশ্চয়তা হয়ে থাকে তাহলে আমাদেরও খুঁজতে হবে জাপানিদের পথ। মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লাখ, রাজাকার আর পাকি গান গেয়ে একটা বিশেষ পরিবারের বিষাক্ত থাবা হয়ত টিকিয়ে রাখা যাবে কিছুদিন, কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সাথে তাল মেলাতে চাইলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে হবে। কৃত্রিম কফিনের পাশে শুয়োর বসিয়ে গোলাম আজমের ’মৃত্যু উৎসব’ পালন করা যাবে ঠিকই, তবে তা মানুষ হিসাবে আমরাও যে শুয়োর উপরে উঠতে পারিনি তাই প্রমাণ করবে। অন্তত বাকি বিশ্বের কাছে।