আসল নামটা কোনদিনই জানা হয়নি। আসলে জিজ্ঞাস করা হয়ে উঠেনি। নোরা নামেই চিনতাম তাকে। একসাথে প্রায় তিন বছর কাজ করেছি। খুব কাছ হতে জেনেছি একে অন্যের জীবন। তিন সন্তান নিয়ে একাই লড়াই করছিল প্রবাসে। স্বামী স্থানীয় একটা মসজিদের মুয়াজ্জিন এবং পার্ট টাইম ফিশ মার্কেটের শ্রমিক। বনিবনা না হওয়ায় ফিরে গেছে নিজ দেশে দুই বছর আগে। কেন এবং কবে এ দেশে এসেছিল এ নিয়ে প্রশ্ন করা হতো শিষ্টাচার বহির্ভূত, তাই ইচ্ছা থাকলেও জিজ্ঞেস করা হয়নি। শুধু জানতাম ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের বান্দা আচেহ শহরে তার জন্ম এবং ওখানেই বেড়ে উঠা। বিয়ে, স্বামী সংসার সবকিছুই ওখানকার। আরও অনেক স্বদেশীর মত ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। বৈধভাবে বসবাসের আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি কাজ করার অনুমতি দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান সরকার। সিডনির টারেন পয়েন্ট এলাকার বহুজাতিক একটা কোম্পানিতে তার সাথে পরিচয়। আমার এক বছর সিনিয়র। কাজে যোগ দেয়ার প্রথম দিনই পরিচয় হয়েছিল সহকারী হিসাবে। নোরা, ত্রিশ বছর বয়স্ক একজন কট্টর মুসলমান । মাথায় ফুল-টাইম হিজাব। কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই ধর্ম প্রসঙ্গ টেনে আমাকে হেদায়েত করার চেষ্টা করতো। কারণ ততদিনে জেনে গেছে জন্মসূত্রে মুসলমান হলেও আমি ধার্মিক নই। নামাজ রোজা দুরে থাক খাবার দাবারেও আমার বাছ বিচার নেই। অবাক হতো এসব শুনে। বাংলাদেশের মত মুসলিম প্রধান দেশে এমন একজন থাকতে পারে তার কাছে এ ছিল বিস্ময়কর ব্যাপার। তবে কোনকিছুই বাধা হয়ে দাড়ায়নি আমাদের বন্ধুত্বের। বছর গড়াতে বুঝতে পারি সম্পর্ক অন্যদিকে গড়াতে সচেষ্ট সে। দুপুরের খাবার প্রায় প্রতিদিনই বাড়ি হতে রান্না করে আনত। কাজের শেষে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতো টারেন পয়েন্ট ব্রিজটার তলায়। বিশেষ কোন অন্তরঙ্গ মুহূর্ত না কাটালেও বুঝতে পারতাম কিছু একটা বলতে চাচ্ছে সে। এবং সে পর্যন্ত বলে ফেললো।
অস্ট্রেলিয়ান পর্ব চুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে পাড়ি জমাচ্ছি। খবরটা জানাতে হতাশ হল নোরা। রেস্টুরেন্টে ডিনারের দাওয়াত দিয়ে বেলুন ফাটালো সে। বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ইমিগ্রেশনের আইনি লড়াইয়ে হেরে গেছে সে। তিন সন্তান নিয়ে শীঘ্রই দেশে ফিরতে হবে। বিয়েই বাচাতে পার এ অনিচ্ছাকৃত বিদায়। বান্দা আচেহের বিশাল বাড়ি এবং তিন তারা হোটেল ব্যবসা সহ সবকিছুর দখল নিয়েছে তার স্বামী। শীঘ্র দেশে ফিরে না গেলে এতদিনের সঞ্চিত সম্পদের সবকিছু হতে বঞ্চিত করার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা নেই তার। সন্তানরা এ দেশে মানুষ হচ্ছে। ভাল লেখাপড়া করছে তারা। এসব হারাতে রাজী নয় সে। সহসা উত্তর না দিয়ে আমি বললাম সময় দাও ভেবে দেখবো। পরেরদিন আবার দেখা। নতুন প্রস্তাবে আমি থ। বিয়ের জন্য আমাকে বিশ হাজার ডলার পর্যন্ত দিতে রাজী। কাগজের এ বিয়েতে আমাকে শুধু সই করতে হবে। বাকিটা সে এবং তার উকিল দেখবে। ধন্যবাদ জানিয়ে না করে দিলাম তাকে। চোখ আর নাকের পানিতে বিদায় জানালো আমাকে। ২০০০ সালের সেÌসেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়ান পর্ব চুকিয়ে পা বাড়ালাম উত্তর আমেরিকার পথে। এক বছরের ভেতর ফিরে গিয়েছিলাম সিডনীতে। তখনো দেশে ফিরে যাওয়া হয়নি নোরার। দেখা হলে জীবন সংগ্রামের অদ্ভুত কাহিনী শুনিয়েছিল সে। ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে তার সাথে শেষ দেখা। একই সালের ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ। অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল ভারত মহাসাগরে। পানির পাহাড় সুনামি হয়ে আঘাত হানলো অস্ট্রেলিয়া হতে আফ্রিকার তানজানিয়া পর্যন্ত। রিখটার স্কেলে ৯,১ মাত্রার ভূমিকম্পের কারণে ফুসে উঠেছিল সাগরের পানি। এবং তার এপিসেন্টার ছিল ইন্দোনেশিয়ার সুমত্রা দ্বীপে। দ্বীপের কোন কিছুই আস্ত রাখেনি পানির এ দানব। দেশটার ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নেয় এ তাণ্ডব, যার অধিকাংশই ছিল আচেহ প্রদেশের। আমি জানতাম না এ ফাঁকে নোরাকে ফিরে যেতে হয়েছিল।
দানব সাগর ফিরিয়ে দেয়নি নোরার লাশ। সাথে নিয়েছিল তার সন্তানকে। আজ দশ বছর আচেহ দ্বীপের সে ঘটনার।