মানুষ অমানুষ ভাগ করার দুঃখজনক একটা সুযোগ দিয়ে গেল শিশু জেহাদ। তার মৃত্যু আমাদের কষ্ট দিয়েছে সন্দেহ নেই, তারপরও এ মৃত্যুতে খুঁজলে এমন কিছু পাওয়া যাবে যা নিয়ে জাতি হিসাবে আমরা গর্ব করতে পারি। মানুষ মরণশীল। যারা সৃষ্টিকর্তাকে জন্ম-মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক হিসাবে মানেন তাদের কাছে শিশু জেহাদের মৃত্যুর হিসাব খুব সহজ। হয়ত তার ভাগ্যলিপির আশু বাস্তবায়ন হিসাবে বিবেচনা করবেন তারা। কিন্তু আমার মত যাদের মগজে উপরওয়ালার অস্তিত্ব নিয়ে লাখো প্রশ্ন কিলবিল করে তাদেরকে কোন শিশুর মৃত্যু ঠাণ্ডা মাথার খুন ছাড়া অন্যকিছু মেনে নিতে কষ্ট হয়। হোক তা আফগানিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলায়, হোক তা পাকিস্তানের পেশোয়ারে তালেবানদের নৃশংসতায়, হোক তা শাজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির সরকারী মৃত্যু-কুপের কারণে। একটা শিশু জন্ম নেয় বাঁচার জন্য, চার বছর বয়সে মারা যাওয়ার জন্য নয়। প্রত্যেকটা মা-বাবা তাই করার চেষ্টা করে। মা-বাবার পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও অলঙ্ঘনীয় দায়িত্ব শিশুকে আগলে রাখা। অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, চিকিৎসা, শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া। এসব নিশ্চিত করার জন্যই একটা দেশে সরকারের প্রয়োজন হয়। দরকার হয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির। এজন্যই নাগরিকরা ভোট দেয়। পছন্দের মানুষকে দায়িত্বে বসায়। শুধু জেহাদ কেন, দেশের মাটিতে জন্ম নেয়া প্রত্যেকটা শিশুর অভিভাবক কেবল তার পিতা-মাতা নয়, বরং সব বিবেচনায় রাষ্ট্র তার মূল অভিভাবক। দুঃখজনক সত্য হচ্ছে মৃত্যু এ দেশে এখন গলির ধারের ফুচকার মত সহজলভ্য উপাদেয় পণ্য। প্রতিদিন জেহাদের মত শত শত শিশু মরছে। কেবল দুর্ঘটনায় নয়, মরছে অনাহারে, অবহেলায়, বিনা চিকিৎসায়, মরছে রাষ্ট্র তথা সরকারের বুটের তলায়। জেহাদের মৃত্যুর পার্থক্যটা হচ্ছে রাজনীতি তথা সরকারের নামে এ দেশে যে ভয়াবহ অরাজকতা ও অযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে তার আসল চেহারা কিছুক্ষণের জন্য হলেও নেংটা করে দেখানো। আমরা দেখেছি কতটা যোগ্যতা নিয়ে সরকারী চাকরি করছেন আজকের প্রশাসন ও তার প্রফেশনাল মেকানিজম। মুক্তিযোদ্ধার কোটা, দলীয় কোটা, পারিবারিক কোটার নামে দুদিন আগের রাস্তার সন্ত্রাসী এখন চাকরিতে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে জিহাদ উদ্বার পর্বে। ২৩ ঘণ্টা চেষ্টা করে যে কাজটা তারা করতে পারেনি তা আধা ঘণ্টায় করেছে কজন সাধারণ মানুষ। এখানেই উন্মোচিত হয় জাতি হিসাবে আমাদের আসল পরিচয়। এ পরিচয় রাজনীতির নষ্ট গলিতে পথভ্রষ্ট হলেও একেবারে যে তলিয়ে যায়নি তাই প্রমাণ করেছেন কজন সাহসী যুবক। এ বাংলাদেশকেই আমরা আবহমান কাল ধরে চিনে আসছি। এ বাংলাদেশকেই আমরা বুকে লালন করে ভালবেসে গেছি। লাখো মানুষের পতাকা রেকর্ড অথবা চেতনার বেলুনে মুক্তিযুদ্ধের ঝাণ্ডা উড়ালেই যে দেশপ্রেমিক হওয়া যায়না তার প্রমাণ রেখেছে জিহাদ উদ্ধারের শ্বাসরুদ্ধর কয়েক ঘণ্টা।
একদিকে অবৈধ মন্ত্রী, আগাগোড়া পচনশীল আমলাতন্ত্রে, সরকারের পোষ্য ও নিকট অতীতে লালিত পেটোয়া বাহিনীর সমন্বয়ে ঘটিত উদ্বার বাহিনী, অন্যদিকে এ দেশের কোটি মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা এবং সাথে ফারুক, লিটু, বকর, মজিদ, সুজনদের মত নিঃস্বার্থ কজন সাধারণ মানুষ। এ বাংলাদেশ নিয়েই আমরা গর্ব করতে পারি। আর যে বাংলাদেশের পরতে পরতে দুর্নীতির কুষ্ঠ রোগ, পিতার মাজারে লালসালুর ব্যবসা আর মজিদ, সুজন ও লিটুদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে হানিফ, হাসান মাহমুদ আর সুরঞ্জিত চোরাদের জন্য গড়া হয় স্বর্গের লীলাভূমি সে বাংলাদেশ আমার, আপনার কারও নয়। আর কিছু না পারি আসুন ঘৃণা করতে শিখি এমন রাষ্ট্রকে।