গত বছর এ সময়টায় দেশে ছিলাম। শীতের শেষ এবং বসন্তের শুরুতে অন্যরকম একটা আমেজ থাকে প্রকৃতিতে। ভোগ করতে চাইলে এটাই বোধহয় উত্তম সময়। আমরাও প্রাণ ভরে উপভোগ করেছি ঋতু বদলের এই মাদকতা। গিন্নীর জন্য এ ছিল অন্যরকম অভিজ্ঞতা। আর আমার দেড় বছর বয়সী কন্যার জন্য তা ছিল বিশাল বিস্ময়ের নতুন এক দিগন্ত। এন্ড-লেস ট্রাফিক, বিষাক্ত বাতাস ও গগনবিদারী কোলাহলে ডুবন্ত ঢাকা শহরে উপভোগ করার মত জিনিষ বলতে গেলে হাতেগোনা। হতে পারে তা আমার জন্য, কিন্তু আমার বিদেশী স্ত্রীর জন্য এ ছিল জীবনকে খুব হতে দেখা। তার বিচারে এটাই নাকি আসল জীবন, যে জীবনে আছে গতি, আছে ছন্দ, আছে সমাজ সংসার নিয়ে যুদ্ধ করা কতগুলো মানুষের জীবন স্পন্দন। যতটা সম্ভব উপভোগ করার চেষ্টা করেছি। সম্ভাব্য এমন কোন গলি নেই যেখানে হানা দিইনি। রাস্তার হকার হতে শুরু করে সাতমসজিদ রোডে গড়ে উঠা অস্থায়ী মাছের বাজারে দরাদরি, সবই ছিল আমাদের ম্যানুতে। গহীন পাড়াগাঁয়ের দাদা বাড়ি এবং গোধূলি বেলায় মেঘনা নদীতে নৌকা ভ্রমণ দিয়ে ইতি টেনেছিলাম এক মাসের এডভেঞ্চার। সবকিছুতে ছিল সুখের ছোঁয়া। খুব শীঘ্রই ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে এসেছিলাম জীবন-যুদ্ধের গতানুগতিক লড়াইয়ে। গিন্নী প্রায়ই জানতে চায় আবার কবে যাচ্ছি আমরা। আমার কাছে এর কোন উত্তর নেই। যে মেঘনা নদীতে সূর্যের রক্তিম বিদায় প্রাণভরে উপভোগ করেছিলাম সে নদীতে এখন বেওয়ারিশ লাশ ভেসে বেড়ায় এসব গিন্নীকে বুঝানো যায়না। সে বিশ্বাস করতে চায়না। কোন মতেই মানতে চায়না একজন অদেখা বিদেশির জন্য যাদের হ্রদয়ে থাকতে পারে এত বিশালতা এই তারাই আবার হয়ে উঠে ভয়ংকর খুনি। আমি শুধু বলি, সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। মেয়েটাও বেড়ে উঠছে। দু’একটা শব্দ উচ্চারণ করতে শুরু করেছে। কর্পোরেট জীবন হতে সাময়িক বিরতির তাগাদাটা বেশ কিছুদিন ধরে অনুভব করছিলাম। প্রস্তাবটা ছিল আমার। ছুটি এবং গন্তব্য দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু। আমার জন্য তা একান্ত ভ্রমণ হলেও পরিবারের বাকি সবার জন্য ছিল জন্মভূমিতে ঘুরে আসা। বিশেষ করে গিন্নীর জন্য।
পৃথিবীর এ অংশে শেষবার এসেছিলাম ২০০৬ সালে। এন্ডিসের বাঁকে বাঁকে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতার অনেকটাই ভাগাভাগি করেছি ভার্চুয়াল দুনিয়ার সাথে। পেরু দিয়ে শুরু। তারপর বলিভিয়া, কলম্বিয়া ও ইকুয়েডর। কলম্বাস নিশ্চয় অনেককিছু আবিষ্কার করে গেছেন। কিন্তু আমার জন্য এসব আবিষ্কার একান্তই তার নিজস্ব। যতক্ষণ নিজের চোখে না দেখছি আমার জন্য তা কেবলই গল্প। আমি গল্পের পুজারি নই। তাই যখনই সুযোগ পাই বেরিয়ে পরি আবিষ্কারের সন্ধানে। এ যাত্রায় পেরুতে আবিষ্কারের কিছু ছিলনা। ছিল জীবন হতে কটা দিন পালিয়ে থাকার পরিকল্পনা। টিকেট কেটেছিলাম অনলাইন পোর্টাল এক্সপিডিয়া হতে সেই জানুয়ারিতে। সস্তায় পাওয়ার আশায়। সস্তার আশা কতটা পূরণ হয়েছিল বলতে পারবোনা, তবে এ পোর্টাল হতে যে আর কোনদিন টিকেট কিনতে যাবনা তা প্রায় নিশ্চিত। আসছি সে প্রসঙ্গে।
শনিবার খুব ভোরে ফ্লাইট। তাই শুক্রবার কাজের দিনটা ছিল সাধারণ দিনের চাইতে একটু বেশি ব্যস্ত দিন। কাজের ঝামেলা অগোছালো রেখে গেলে ফিরে এসে আমাকেই মোকাবেলা করতে হবে। সে পথ পরিষ্কার রেখে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল এ যাত্রায়। দুপুর বারোটার দিকে অচেনা একটা নাম্বার হতে ফোন পেলাম। রেকর্ড করা ম্যাসেজটা শেষ হতে লাইন কেটে গেল। খুব সংক্ষিপ্ত ম্যাসেজে, ’আমরা দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি তোমার পেরু যাত্রার একটা পথ ক্যান্সেল করা হয়েছে, ধন্যবাদ’। বিদেশীদের সামনে বাংলায় গাল দেয়ার এই এক সুবিধা, কেউ বুঝতে পারেনা। শুধু আন্দাজ করে নেয় এ মুহূর্তে আমি সুখী নই। গালির ওজনটা বোধহয় একটু ভারীই ছিল তাই পাশের রুম হতে বস উঠে এসে জানতে চাইলেন কোন সাহায্য করতে পারেন কিনা। আমার শহর হতে ডালাস। ডালাস হয়ে মেক্সিকো সিটি এবং সেখান হতে লিমা। জার্নির কোন পর্বের টিকেট বাতিল হয়েছে বুঝতে পারলাম না। সাত পাঁচ না ভেবে গিন্নীকে ফোন করলাম। সেও ধরল না। বরং এস এম এস পাঠিয়ে জানান দিল এ ধরনের একটা ফোন সেও পেয়েছে এবং এক্সপিডিয়া হয়ে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের সাথে কথা বলছে। ফিরতি ফোন পেতে ঘণ্টা খানেক সময় নিলো। ডালাস হতে মেক্সিকো সিটির ফçফ্লাইট বাতিল হয়েছে। তবে সুসংবাদ হচ্ছে সংশোধিত আইটেনারীতে ডালাস হতে সরাসরি লিমা যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকাল সাতটায় ডালাস পৌঁছে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ধরতে হবে লিমার ফ্লাইট। মাঝখানে লম্বা সময়। এ ছিল আমার জন্য মেঘ না চাইতেই অঝোর বর্ষণ। দুদিন আগে আমার বড় বোন এসেছেন ডালাসে। দেখা করার সুবর্ণ সুযোগ। অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বোনকে ফোন করলাম এবং জানান দিলাম অপ্রত্যাশিত আগমনের। কিন্তু উত্তরে যা শুনলাম তাতে রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। সকাল হতে ডালাস নাকি ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত এবং ভোর রাত হতে অপেক্ষা করবে তুষার ঝড়ের। স্কুল কলেজ আগাম ছুটি দেয়া হয়েছে এবং নগর কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের সবদিক হতে সাবধান করে দিচ্ছে। দমে গেলাম। উত্তেজনা থিতু হয়ে এলো। গিন্নীর সাথে পরামর্শ করে ঠিক করে নিলাম এয়ারপোর্টে লম্বা সময় কাটানোর আগাম পরিকল্পনা। বাংলাদেশ-স্কটল্যান্ড খেলা শেষ করে রাত দুটোর এলার্ম সেট করে ঘুমুতে গেলাম।
ঘুম ভাঙ্গল বেশকিছু আগে। গিন্নীকে অনুরোধ করলাম শেষবারের মত ফ্লাইট গুলো পরখ করে নিতে। পাওয়া গেল নতুন সংবাদ। সকালের ডালাস গামী ফ্লাইট বাতিল এবং আমাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে দুপর সাড়ে বারটার একটা ফ্লাইট। মনে মনে কিছুটা খুশিই হলাম। অন্তত এয়ারপোর্টে বেহুদা ঘোরাফেরা করতে হবেনা। হাতে সময় আছে, তাই কষে একটা ঘুম দিলাম।