জয়ের আনন্দে ভাসছে বাংলাদেশ। শুধু বাংলাদেশ বললে হয়ত কম বলা হবে, বরং এ আনন্দ ছড়িয়ে পরেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের ঘরে ঘরে। রাজনৈতিক ঘাত সংঘাতে ক্ষতবিক্ষত একটা জাতির আনন্দ করার উপলক্ষ খুবই সীমিত। ক্রিকেট নিশ্চয় এর ব্যতিক্রম। যে কোন জয় আনন্দের। অস্ট্রেলিয়া যখন বিশ্বকাপ জয় করে দেশে ফিরে দেশটার এককালীন ক্রিকেট প্রেমী প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড ক্রিকেটারদের ডার্লিং হারবারে সম্বর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। এ অনুষ্ঠান উপচে পরেছিল অসিদের পদভারে। এমনটাই হয়। ক্রিকেট বাদ দিয়ে ফুটবলের দিকে তাকালে সেখানেও দেখবো বিশাল আয়োজন। সে বিবেচনায় ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টাইগারদের বিজয় স্বদেশীদের আনন্দ উৎসবের খোঁড়াক যোগাবে খুবই স্বাভাবিক। তবুও এখানে দু'একটা কথা থেকে যায়।
ক্রিকেট এ দেশে সরকারী অর্থে লালিত একটি স্পোর্টিং ইভেন্ট। যোগ্য ক্রিকেটারদের বাছাই করে মাসে অবিশ্বাস্য রকমের মাসহারা দিয়ে তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেয়া হয়। সাথে দেয়া হয় কোটি টাকার ট্রেইনার, ফিজিও, এমনকি মনস্তত্ত্ববিদ। একটা উন্নয়নশীল দেশে কোটি কোটি ছিন্নমূল মানুষের ভিড়ে এসব কোটিপতি ক্রিকেটাররা নিশ্চয় ভাগ্যবান। সমস্যা হল, যে আশা, প্রত্যাশা নিয়ে এ খাতে অঢেল অর্থ বিনিয়োগ করা হয় তা লাভ হয়ে জাতির তহবিলে ফিরে আসেনা। বছরের পর বছর ধরে আমরা সাক্ষী হই অস্বাভাবিক রকমের ব্যর্থতার। ভুলে যাই কর্পোরেট দুনিয়ায় এ ব্যর্থতার স্থায়ী আসন নেই। তাই আমাদের দেখতে হয় দলকে নিয়ে হরেক তামাশা, শুনতে হয় চরম অক্রিকেটিয় মন্তব্য। বলতে গেলে গা সওয়া হয়ে গেছে আমাদের দল নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর উপহাস। এসব আমাদের কষ্ট দেয়। অনন্যোপায় হয়ে ভেতরে পুষে রাখি টেস্ট ক্রিকেটে একদিনে হারিয়ে দেয়ার মত উপহাস। অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট। এ খেলার মহত্বও এ অনিশ্চয়তার ভেতর নিহিত। ধারাবাহিক ব্যর্থতার ফাঁকে বাংলাদেশ দলও জন্ম দেয় অনিশ্চয়তার। গেল উনিশ বছরে ক্রিকেট যে অনিশ্চয়তার খেলা তার প্রমাণ খুব কমতি রাখতে পেরেছে টাইগাররা। বরং প্রেডিক্টবল ক্রিকেট খেলতে গিয়ে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে একেবারে তলানিতে। ফলস্বরূপ ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মত দলগুলো নিজেদের মাটিতে দেখতে চায়না আমাদেরকে। কারণ ফলাফল প্রেডিক্টবল। ফলে বাণিজ্যিক যোগবিয়োগও হতাশাজনক।
এই যে হঠাৎ হঠাৎ আনন্দ জোয়ারে ভাসছি আমাদের কি প্রশ্ন তোলার সময় হয়নি কেন এই আনন্দ এতটা অধরা? প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের চাইতে কোন দিক হতে আমারা পিছিয়ে? অবকাঠামো? অর্থ? দর্শক? শারীরিক গঠন? কোনটাই হয়ত না। তাহলে কেন ব্যর্থতার বলয় হতে বেরিয়ে আসতে পারছেনা আমাদের ক্রিকেটাররা? সাফল্য ধারাবাহিক হলেই হয়ত বিজয় নিয়ে আবেগীয় প্লাবন বইতোনা। খেলা কেবল খেলাই। এর জয় পরাজয়ের ফয়সালা হয় মাঠে। অথচ এ ফয়সালা আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে স্থবির করে দেয়। মোহগ্রস্থ করে ভুলিয়ে দেয় ক্রিকেট দলের প্রডিক্টবলিটি। তাই নিজেদের প্রত্যাশাকেও নিয়ে সীমাহীন উচ্চতায়। ইংল্যান্ডের সাথে বিজয়ে কেউ কেউ দেখলাম কলোনিয়াল এই দেশটার আমাদেরকে ২০০ বছরের শাসনের জবাব হিসাবে দেখছে। কেউ আবার লর্ড মাউন্টব্যাটেনদের কবর হতে উঠিয়ে ধোলাই দিচ্ছেন। সরকার অথবা গোটা রাজনীতি জুড়ে শুরু হয়েছে বিরামহীন অসুস্থ বন্দনা। পরবর্তী ফ্লাইটে দেশে ফিরলে খেলোয়াড় ভাসিয়ে দেয়া হবে অর্থকরী আর সোনাদানায়। আমি বলি কি, আসুন একটু ব্রেক কষি এ জোয়ারে। এবং ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে শুরু করি এ ধরণের বিজয়ে। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য ক্রিকেটারদের পেছনে রাষ্ট্র এত অর্থ ঢালে না। ঢালে নিজেদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য।
আসলে ক্রিকেট বিজয়ের এই মহোৎসব প্রকারান্তে খেলার মাঠে আমাদের দুর্বলতারই পরোক্ষ স্বীকারোক্তি মাত্র।