রাত ১১টা ৫৫ মিনিট। মস্কোর লেলিনগ্রাদস্কি বোকজাল হতে ছেড়ে যাচ্ছে শেষ ট্রেনটা। মিস করলে সারা রাত ষ্টেশনে কাটাতে হবে। স্থানীয় হোটেলে বিদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। রুম ভাড়া করতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চাই। সমাজতান্ত্রিক আইনে এক শহর হতে অন্য শহরে ভ্রমণ করতেও ভিসা লাগে বিদেশিদের। এ ভিসা অবশ্য হোটেলে রুম পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। ঝামেলা এড়াতে কাজ যা ছিল তা সেরে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই হাজির হলাম ষ্টেশনে। মূর্তির মত প্লাটফর্মের আধো অন্ধকারে আবিষ্কার করলাম ঝকঝকে ট্রেনটাকে। ভেতরের সবকিছু ছবির মত পরিপাটি । প্রতি কামরায় চারজনের ঘুমানোর ব্যবস্থা। সাথে ধোলাই করা ধবধবে সাদা বিছানা। প্রতিটা বগিতে একজন করে গার্ড। যার কাজ শুরু হতে শেষ পর্যন্ত যাত্রীদের আরাম নিশ্চিত করা। ফ্রি গরম চা এর অন্যতম। বসন্তের শুরু কেবল। প্রকৃতিতে শীতের দাপট কমতে তখনো অনেক দেরী। চারদিকে ইতস্তত তুষারের স্তূপ বিগত যৌবনা শীতের ভয়াবহতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। লম্বা সালাম দিয়ে টিকেটটা গছিয়ে দিলাম গার্ডের হাতে। ৬০/৬৫ বছরে এক মহিলা। চেহারায় মধ্য এশীয় ছাপ। হবে হয়ত উজবেক অথবা চেচেনদের কেউ। সাদর আমন্ত্রণ জানালো কামরায়। হাতে বালিশ ও চাদর ধরিয়ে আরাম করে বসার জন্য অনুরোধ করল। আমিও ধন্যবাদ জানিয়ে গরম এক কাপ চায়ের অনুরোধ করলাম। ভাগ্য বোধহয় এ যাত্রায় সুপ্রসন্ন। কারণ ১১টা ৩০ পর্যন্ত চার জনের কামরায় দ্বিতীয় কাউকে দেখলাম না। সাধারণত এ ধরনের যাত্রায় রুশ সহযাত্রীরা ভদকার আসর জমায় এবং পানাহারে শেষে নিদ্রায় গিয়ে শুরু করে নাক ডাকার সমুদ্র গর্জন। মহিলা চা নিয়ে দরজায় নক করলো। খুলতেই মুচকি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো পানাহার শুরু করেছি কিনা। তার কাছে লবণ দেয়া শুটকি মাছ এবং শূয়রের সালামি আছে। চাইলে কিনতে পারি। স্বল্প বেতনের এসব চাকরিজীবীদের বেঁচে থাকার জন্যে অনেক কিছুই করতে হয়। যদিও প্রাইভেট ব্যবসা এ দেশে বেআইনি। ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা বন্ধ করে শোয়ার ব্যবস্থা শুরু করে দিলাম। ১১টা ৫০ মিনিট। ট্রেন ছাড়ার প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণ। এমন সময় দরজা খোলার শব্দে উঠে বসলাম। নিশ্চয় গার্ড। সাথে হয়ত শেষ মুহূর্তের যাত্রী। আমার আশংকা মিথ্যা হলোনা। হাতে ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে কামরায় যে প্রবেশ করলো তাকে দেখে টলে উঠলো আমার পৃথিবী। অনিত্য সুন্দরী এক যুবতী।
বয়স আমার মতই হবে। গায়ের রং কিছুটা ঘোলাটে। গার্ড নিজ হাতে বিছানা পেতে দিল। যাওয়ার সময় মুচকি হেসে বলে গেল মেয়েটা রুশ জানেনা। সুযোগ পেয়ে আমি যেন আবার ঝাঁপিয়ে না পরি। দুশ্চিন্তার চেপে বসলো আমার চোখে মুখে। এমন ভয়াবহ সুন্দরী এবং এত কম দূরত্ব গোটা রাত কাটানো যে কোন পুরুষের জন্য সাধনার ব্যাপার। মনে হল আমার ধৈর্যের পরীক্ষা করতে ঈশ্বর যেন কোন দেবী পাঠিয়েছেন। পরনের কাপড় লজ্জা শরমের বালাই না দেখিয়ে চোখের সামনেই বদলে নিলো। এক ঝটকায় মাথার টুপিটা সরিয়ে নিতেই এলিয়ে পড়লো ঘন কালো চুল। লম্বা, ভীষণ লম্বা। কথা হলোনা অনেকক্ষণ। কোন ভাষায় শুরু করবো তাও বুঝতে পারলাম না। অনেকক্ষণ পর নীরবতা সেই ভাঙল। খুব নিচু গলায় জানাল কিছুটা রুশ জানে। নতুন এক প্রস্ত চা দিয়ে গেল গার্ড। ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে রাতের ট্রেন। আলাপের শুরুটা এখানেই। এবং চলতে থাকলো সারা রাত। রেবেকা আলভারাদো। বাড়ি নিকারাগুয়ার রাজধানী মনাগুয়ায়। এ দেশে আসা মূলত চিকিৎসার জন্যে। গায়ে তার কম করে হলেও তিনটা বুলেট।
সানদিনিষ্টা লিবারেশন ফ্রন্টের সন্মুখ সৈনিক। ট্রেনিং নিয়েছিল কিউবার কোন এক ক্যাম্পে। মার্কিন মদদ পুষ্ট আনাস্তাসিও সামোসা দেবাইলের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। নিকারাগুয়ার জংগলে বিনাচিকিৎসায় মারা যাচ্ছিল প্রায়। ওখান হতে গেরিলা বাহিনীর কমান্ডারের সহযোগিতায় পাঠানো হয় কিউবার রাজধানী হাভানায়। একাধিক সার্জারিতে কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ার ট্রান্সফার করা হয় মস্কোতে। ছ’মাস ধরে চলে উন্নত চিকিৎসা। এক বছরের মত পঙ্গু থাকার পর এখন সে হাঁটতে শুরু করেছে। নিয়মিত ব্যায়াম ফিরিয়ে আনছে আত্মবিশ্বাস। সাথে রপ্ত করেছে কিছুটা রুশ ভাষা। এবং সে বিশ্বাস করছে আগামী মাসেই ফিরে যেতে পারবে নিজ ব্রিগেডে। কোন নোটিশ না দিয়েই উঠিয়ে ফেলল পরনের কাপড়। সমস্ত শরীর জুড়ে হরেক রকম কাটাকাটি। আঙ্গুল দিয়ে দেখাল শরীরে আটকে থাকা বুলেট গুলোর জায়গা। চোখে এক ধরনের শূন্যতা। মুখ ভাবলেশহীন। কথা প্রসঙ্গে বেরিয়ে এলো ডাক্তারদের বিচারে সে আর কোনদিনই ফ্রন্টে যেতে পারবেনা। তাই সহসাই ফেরত পাঠানো হচ্ছেনা মানাগুয়ায়। বরং এখানে আটকে রাখা হচ্ছে ডাক্তারি পড়ার জন্যে। লেলিনগ্রাদ মেডিক্যাল কলেজ তার গন্তব্য। দ্যানিয়েল ওর্তেগার কথা জিজ্ঞেস করতেই উদ্ভাসিত হল তার চোখ মুখ। যুদ্ধের মাঠে একজন সহযোদ্ধা এবং কমরেড কতটা প্রিয় হতে পারে রেবেকার মুখ হতে না শুনলে বিশ্বাস করতে হয়ত কষ্ট হতো। দ্যানিয়েলকে মনে হল তার দেবতা, তার সাধনা, তার নতুন দিনের স্বপ্ন।
সকাল সাড়ে সাতটায় আমরা পৌছেগেলাম। শহরের মস্কোভস্কি ষ্টেশনে রেবেকার জন্য একদল নিকারাগুয়ান অপেক্ষা করছিল। সবার হাতে লাল গোলাপ। খুব সাবলীল ভঙ্গিতে গালে একটা চুমু দিয়ে আমাকে বিদায় জানালো। এরপর কোনদিন দেখা হয়নি রেবেকার সাথে। আমি জানতাম সে কোথায় আছে। কিন্তু ইচ্ছা করেনি একজন গেরিলার সাথে যুদ্ধের পৈশাচিকতা নিয়ে আলাপ করতে। তাই আর যোগাযোগ করিনি। তবে সামোসার হাত হতে নিকারাগুয়ার মুক্তি, সান্দিনস্তাদের উত্থান পতনের কাহিনী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি খবরের কাগজে। ফ্রন্টের বাস্তবতার সাথে পরিচিত হয়েছি টিভির মাধ্যমে। সানদিনস্তাদের জয় হয়েছিল। জংগলে বেড়ে উঠা রেবেকাদের প্রজন্ম ফিরে গিয়েছিল ঘরে। বুকে ছিল স্বপ্ন, ছিল নতুন জীবনের হাতছানি। দ্যানিয়েল ওর্তেগা হয়েছিল দেশটার নেতা। রেকেবার দেবতা ওর্তেগা নির্বাচনে জয়ী হয়ে বসেছিল প্রেসিডেন্টের চেয়ারে। মার্কসইজমের দীক্ষায় দীক্ষিত সান্দিনিস্তাদের কমান্ডার ক্ষমতায় গিয়েই বদলে যান। সীমাহীন দুর্নীতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত চরিত্রেও লাগে কলঙ্কের লেপ। তার ৩০ বছর বয়সী সৎকন্যা জইলামেরিকা নারভায়েস অভিযোগ আনে্ন বলৎকারের। অভিযোগে বলা হয় ১১ বছর বয়স হতেই শুরু হয় ধর্ষণ পর্ব। এমনকি তার প্রথম বিয়ের পরও থামেনি পিতা ওর্তেগার পশুত্ব। ওর্তেগা যথারীতি অস্বীকার করেন এসব অভিযোগ।
এত বছর পর ঘটনা ঘাটতে গেলাম একটা কারণে। আজ শেখ মুজিবের জন্মদিন। যাকে স্বাধীনতার স্থপতি মেনে এ দেশের মানুষ দেবতার আসনে বসিয়েছিল সেই শেখ মুজিব ক্ষমতায় বসে লাল ঘোড়া দাবড়ে রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছিলেন এ দেশে। তারই ধারাবাহিকতায় তার কন্যা এখন একজন প্রফেশনাল খুনি। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে লাশ নিয়ে উপহাস করেন।