ব্যক্তি গাফফার চৌধুরীকে নিয়ে লেখার কথা ছিলনা। কথা ছিল তার সৃষ্ট সাহিত্য নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করার। আমি যেহেতু সাহিত্য সমঝদার কাতারের কেউ নই তাই কেবল গাফফার কেন, কোন চৌধুরীর সাহিত্য কর্ম নিয়েই কথা বলার অধিকার রাখিনা। তবে একটা আশ্চর্যজনক সত্য আবিষ্কার করা যায় গাফফার চৌধুরীর লেখালেখি ঘাঁটলে। আলতাফ হোসেনের সুর দেয়া ’আমার ভাইয়ের রক্তে রা-রাঙ্গানো ২১শে ফেব্রুয়ারি’ গান ছাড়া চৌধুরী সাহেবের দ্বিতীয় কোন সাহিত্য কর্ম আমার মত গলির ধারের সাহিত্য ফ্যানদের চোখ অথবা কর্ণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে বলে মনে হয়না। যতদূর মনে পড়ে শেখ মুজিব আমলে কি একটা চটি সাপ্তাহিক বের করে তাতে ক্ষমতাসীন দলের অহরহ সমালোচনা করতেন। খোদ শেখ মুজিবও তা হতে বাদ যেতেন না। দেশীয় রাজনীতির কোন প্রেক্ষাপটে এই ব্যক্তি বিলাত পাড়ি জমিয়েছিলেন এবং কোন গ্রাউন্ডে ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেছিলেন তা আমার জানা নেই। ভাগ্যের সন্ধানে প্রবাসে স্থায়ী হতে গেলে আমাদের হরেক রকম মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। জনাব চৌধুরী এমন কিছু করে থাকলে অবাক হবোনা এবং তাতে দোষেরও কিছু দেখিনা।
যারা র্যাগে গান ভালবাসেন তাদের নিশ্চয় মনে আছে ৭০ দশকের শেষ দিকে ব্রিটিশ গ্রুপ ইউবি-৪০’র কথা। ইংলিশ, আইরিশ, স্কটিশ, ইয়েমেনী এবং জামাইকানদের নিয়ে গড়া এই ব্যান্ডের সাফল্য নিয়ে যে কেউ ঈর্ষা করতে পারে। বিশেষ করে ’রেড রেড ওয়াইন’ ’ফুড ফর থট’ অথবা ’ক্যান্ট হেল্প ফলিং ইন লাভ’এর মত সফল ও শ্রুতিমধুর গান গুলোর জন্য। র্যাগে গানের ভক্ত আমি নিজেও, তবে ইউবি৪০ আমাকে আকর্ষণ করেছিল অন্য কারণে, তার নাম। ইউবি, তৎকালীন ইংলিশ প্রেক্ষাপটে তা ছিল আন-এমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট এবং ৪০ ছিল ফর্ম নাম্বার। এ ফর্ম পূরণ করে বেকার ভাতা ক্লেইম করতে হত। বাংলাদেশিদের এই ভাতা ভোগ করার অনেক ন্যক্কারজনক কাহিনীর সাথে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ৭০ এবং ৮০ দশকে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন শহরে বাস করার সুবাদে। বলাই বাহুল্য আমাদের চৌধুরী সাহেব ছিলেন সে ভাতারই একনিষ্ঠ গ্রাহক এবং ঐ সময় কলমের খোঁচায় সে সমস্ত সাহিত্য কর্ম সৃষ্টি করেছেন তাতে রয়ে গেছে ইউবি৪০’র বিশাল অবদান। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় যারা সরকারী ডোল খেতে অভ্যস্ত ব্যাপারটা তারা ভাল বর্ণনা করতে পারবেন।
ভুল না হলে সময়টা ১৯৮৮ সালের গ্রীষ্মকাল। ছুটি কাটাতে লন্ডন অবস্থান করছি। থাকছি উডগ্রীনের একটা বাসায়। বাসার মালিক বিবিসি বাংলা বিভাগের জনাবা উর্মি রহমান। রহমান হতে উর্মি বোস হওয়ার অনেক আগের কথা। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ির হয়েছে কেবল। নাবালক পুত্র নিয়ে লড়াই শুরু করছেন নতুন করে বেঁচে থাকার। অলস এক রোববার সকাল। কলিং বেলের কড়া আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মুল ফটকের কাছের রুমটায় আমি ঘুমাই। তাই আমাকেই উঠতে হল। ইউরোপ আমেরিকায় যারা সোম হতে শুক্রবার পর্যন্ত কাজ করেন তাদের জন্য শনি ও রোববারের সকালটা একান্ত নিজের। এ সময় কারও আগমন খুব একটা কাম্য হয়না। আমি ছুটি কাটাচ্ছি, কিন্তু বাসার বাকিদের কথা ভেবে খুবই বিরক্ত হলাম। আধো ঘুম নিয়ে দরজা খুলতে গেলাম। খুলেই অবাক। সামনে দাড়িয়ে ’আমার ভাইয়ের রক্ত রা-ানো’ গাফফার চৌধুরী। এক হাতে বেতের লাঠি এবং অন্য হাতে কাগজের একটা ব্যাগ। ব্যাগের মুখ গলিয়ে উঁকি দিচ্ছে লাল মদের একটা বোতল। আমাকে দেখ মুখ কুচকে রাজ্যের বিরক্তি প্রকাশ করলেন। আমিও গায়ে পরে চেনার উপলক্ষ হতে সড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে? এমন একটা প্রশ্ন করার অধিকার আমার ছিল কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন করা যাতে পারে, কিন্তু উত্তরে জনাব চৌধুরী যা বললেন তা কোনভাবেই এখন বিখ্যাত ব্যক্তির ভাষা হওয়ার কথা ছিলনা। আমিও নাছোড় বান্দা। বললাম আন্টি ঘুমচ্ছেন, আপনাকে রান্না ঘরে অপেক্ষা করতে হবে। কারণ বৈঠকখানার সোফায় আমার বিছানা। মনে হল খুব হতাশ হয়েছেন অনাকাঙ্ক্ষিত কাউকে দেখে। সদ্য তালাকপ্রাপ্তা একজন মহিলার সাথে রোববার সকালে লাল মদের বোতল নিয়ে দেখা করতে আসার ভেতর কি উদ্দেশ্য হতে পারে তা বুঝার মত যথেষ্ট পানি ততদিনে জমা হয়ে গেছে অণ্ডকোষে। দ্বিতীয় কোন সুযোগ না দিয়ে আমি বিছানায় ফিরে গেলাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলেন। সাথে ছিল লাল বোতলের পানি। রান্না ঘরে বসেই আড্ডা দিলেন। পাশের ঘরে বসে আমাকে শুনতে হল একজন ইউবি৪০ খেকো বাংলাদেশির বিশ্বজয়ের প্রলাপ।
গাফফার চৌধুরীকে নিয়ে এমন একটা লেখার প্রয়োজন ছিলনা যদিনা তিনি জাতিসংঘের বাংলাদেশি স্থায়ী মিশনে বসে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে কিছু না বলতেন। জানিনা এ যাত্রায়ও তিনি লাল বোতল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন কিনা, তবে যা বলেছেন তাতে ঐ ধরণের বোতলের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল বলেই মনে হয়। তিনি আল্লাহর ৯৯ গুনগত নামের অনুবাদ করে তাতে বিড়ালের বাবা ও ছাগলের বাবার সন্ধান পেয়েছেন। আমার আরবি জ্ঞান নেই, তাই আবু বকর অথবা আবু হুরায়রার বাংলা অর্থ জানা থাকার কথা না। নামের রহস্য প্রত্যেক জাতির নিজস্ব সংস্কৃতির ভ্রূণে জন্ম নেয়। এই যেমন রুশ দেশে অনেকের পারিবারিক নাম থাকে কাজলভ, অর্থ ছাগল মিয়া, অনেকের আবার বারানভ, যার অর্থ ভেড়া মিয়া, ইত্যাদি। ব্যাপাটা নিয়ে তামাশা করার কিছু নেই। আমরা যদি আমাদের সংস্কৃতিকে ভালবাসতে পারি প্রতিটা জাতিরও সে অধিকার থাকার কথা। তাই সৌদি আরবের নামকরণ সহ আল্লার নাম নিয়ে জনাব চৌধুরীর প্রশ্ন অবান্তর, অপ্রসাঙ্গিক ও অনধিকার চর্চা। তিনি রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর পেয়ারে মশগুল এবং তাতেই তিনি বা-বাংগালী হয়ে বেঁচে থাকার সার্থকতা দেখেন তা একান্তই উনার নিজস্ব পছন্দ এবং তিনি তা করতেই পারেন। তিনি গওহর রঞ্জন চক্রবর্তী হওয়ার স্বাধীনতা রাখেন কারণ তিনি বা-ালী। অর্থাৎ ধর্ম পরিবর্তনশীল কিন্তু বা-বাঙ্গালিত্ব নয়। প্রাসঙ্গিক ভাবে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, হাতে লাল মদের বোতল নিয়ে সদ্য তালাকপ্রাপ্তা নারীর দুয়ারে রোববার সকালে হানা দেয়ার সংস্কৃতিও কি গওহর রঞ্জন হওয়ার সংস্কৃতি? দেশের নাম ভাঙ্গিয়ে, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ইউবি৪০ খাওয়ার সংস্কৃতির নামই কি রবীন্দ্র পূজা, বঙ্গবন্ধু বন্দনা? শোনা যায় যৌবন কালে তিনি শেখ হাসিনার দিকেও হাত বাড়িয়েছিলেন যা শেখ মুজিবের হস্তক্ষেপের কারণে থামাতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাঙালী, বাঙালি-ত্ব, রবীন্দ্র আর শেখ মুজিব বন্দনা এবং পাশাপাশি আল্লাহর ৯৯ নাম বিশেদগারের আগে নিজের আসল চেহারাটা আয়নায় ভাল করে দেখে নিলে তিনি নিজের যেমন উপকার করতেন তেমনি আমাদের রক্ষা করতেন ধর্মীয় উন্মাদনায় বিভোর কিছু মানুষের নব উন্মাদনা হতে।