নষ্ট সমাজের নষ্ট রাজনীতির নষ্ট ফসল...
সালমা খাতুন বনাম নুনজেরুল মোহসীন মীম। একজন এডভোকেট, অন্যজন চিকিৎসক। একদিকে অর্থ ও ক্ষমতা, অন্যদিকে শক্তিশালী প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক। প্রয়োজনে এই দুই শক্তি কতটা ভয়াবহ হতে তার তার প্রমাণ অতীতে আমরা বহুবার পেয়েছি। তাই এ দুই মহিলার ব্যক্তিগত বৈরিতাকে হালকা ভাবে নেয়ার উপায় নেই। এরই মধ্যে দেশের কথিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী জন্ম দিয়েছেন অল-আউট বিতর্কের। বিদেশ হতে বার্তা পাঠিয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন ডাক্তার মীমকে চাকরি হতে বহিষ্কার করার। অপরাধ, কথিত জনপ্রতিনিধি এডভোকেট সালমা খাতুনকে নিজ চেম্বারে যথাযথ সন্মান দেখাতে পারেননি। এ মুহূর্তে আধিপত্য বিস্তার হচ্ছে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরা একটি স্বদেশী রোগের নাম। কদিন আগে একই রোগের শিকার হয়ে মায়ের গর্ভ হতে অকালে জন্ম নিতে বাধ্য হয়েছে জনৈক শিশু। ক্ষমতার রুটি-হালুয়া ভাগাভাগি নিয়ে দুই প্রতিপক্ষের বন্দুক যুদ্ধে বাই-ষ্ট্যাণ্ডার্ড এক গর্ভবতী মা গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশে এটাও সম্ভব। এ মুহূর্তে দেশে এ ধরনের গোলাগুলি রাজনীতিরই অংশ এবং আমরা তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার অভ্যাস করে নিয়েছি। গর্ভবতী মার পেটে গুলি করা নিশ্চয় অপরাধ, তবে তা হতে ক্ষমতাসীন দলের তৃতীয় সারির নেতারাও যে দায়মুক্ত সরকারের নীরবতা তাই প্রমাণ করে। এ ঘটনায়ও সরকারের সাথে চিকিৎসকদের একটা সুক্ষ্ম দন্ধ চাইলে খুঁজে বের করা যাবে। গুলি করেছে সরকার সমর্থক একটি দলের ফিল্ড ক্যাডার, আর গুলিবিদ্ধদের বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমেছে চিকিৎসক সমাজ। বিশেষ করে শরীরে গুলি নিয়ে পৃথিবীর মুখ দেখতে আসা শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকদের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন উল্লেখ করার মত। অতীতে আমরা বহুবার সাক্ষী হয়েছি এমন সব ঘটনার যেখানে মৃত্যুপথযাত্রী রুগীকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করছেন আমাদের চিকিৎসক মহল। কারণ এ ধরনের রুগীদের চিকিৎসা আইনের চোখে ক্ষমতাসীনদের বৈধ খুনে বাধা দেয়ার শামিল। এ ’অপরাধের’ শাস্তি কি হতে পারে তা জানতে আমাদের আইন বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার হয়না। বলতে গেলে গোটা জাতিই আজ সে শাস্তির মুখোমুখি। মাস দুয়েক আগে দুরের দেশ বিলাতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরন লন্ডনের এক হাসপাতালে গিয়েছিলেন অসুস্থ কাউকে দেখতে। হাসপাতালের ডাক্তার-অন-ডিউটি প্রধানমন্ত্রীকে ওখান হতে তাৎক্ষণিক ভাবে বের করে দেন চিকিৎসা আইনের প্রতি দায়বদ্ধতা হতে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সে আইনের প্রতি শ্রদ্বা জানিয়ে বেরিয়ে আসেন বিতর্কে না জড়িয়ে। আসলে এখানে বিতর্কের কোন অবকাশই নেই। অন্তত চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি যাদের নূন্যতম শ্রদ্বা আছে তাদের জানা থাকার কথা হাসপাতাল নিজের আধিপত্য বিস্তারের জায়গা নয়। হাসপাতাল ভূমি-দস্যুতার চারণভূমি নয় যেখানে ক্ষমতা ও পেশী শক্তির মহড়া দেখিয়ে পদানত করা যাবে ভূমি মালিকদের কায়দায় চিকিৎসক অথবা রুগীদের। এডভোকেট সালমা খাতুন কাম জনপ্রতিনিধি তাই করতে গিয়েছিলেন। অবৈধ ক্ষমতার জরায়ুতে জন্ম নেয়া এসব চোর বাটপারের দল এখন হাসপাতালেও নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে ব্যস্ত। কারণ তাদের জন্য পৃথিবী এখন আর আগের পৃথিবী নেই। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরায় এসব জনপ্রতিনিধি যদি মনে করেন তাদের সমস্যা হচ্ছে সেখানেও তা্রা দাপট দেখাবে, দাপট দেখাবে ক্ষমতার, অর্থের, পেশী শক্তির। দিনশেষে আমরা সবাই জানি এ ক্ষমতা অবৈধ, এ অর্থ চুরির, আর এ পেশী ভাড়া করা, যা সময়ের জোয়ার ভাটায় আসে এবং যায়।
প্রায় দু-সপ্তাহ আগে দেশের অবৈধ সরকারের জনৈক মন্ত্রী আলসারের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গেছেন এবং অদ্যাবধি সেখানে অবস্থান করছেন। মধ্যরাতে অসুস্থ হয়ে পড়ায় জরুরী ভিত্তিতে ট্রান্সফার করতে বাধ্য হয় সরকার। এবং তার জন্য ভাড়া করতে হয় এয়ার এম্বুলেন্স। রাষ্ট্র প্রধান হতে শুরু করে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট খোর যে কেউ এখন চিকিৎসার জন্য দেশের উপর ভরসা না করে বিদেশ চলে যাচ্ছেন। কারণ দেশীয় চিকিৎসা তথা ডাক্তারদের উপর ভরসা রাখতে পারছে না। খুব কি দোষ দেয়া যাবে তাদের? একে তো কাঁচা পয়সার ঝনঝনানি, তার উপর দেশের অকার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থা। নুনজেরুল মোহসীন মীমদের মত দেশীয় ডাক্তারদের ইতিহাস ঘাঁটলে যে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে তা নিয়ে আমরা কেন, খোদ ডাক্তাররাও গর্ব করতে পার্নবেন না। বাকি সব খাতের মত চিকিৎসা খাতও এখন মাল কামানোর হাতিয়ার। এ হাতিয়ার ব্যবহার করে দেশীয় ডাক্তারদের প্রায় সবাই এখন ব্যস্ত আখের গোছাতে। এবং এ অসুস্থ প্রতিযোগিতার নিয়মিত বলি হচ্ছে দেশের সাধারণ জনগণ। চিকিৎসার নামে কেবল মাত্র মাল কামানোর ধান্ধায় রুগীদের পাঠানো হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষায়, ধরিয়ে দিচ্ছে অতিরিক্ত পথ্য। কমিশনের বিজয় নিশান উড়িয়ে চেপে বসছেন অক্ষমদের ঘাড়ে। প্রতিবাদ করতে গেলে বেরিয়ে অকথ্য গালিগালাজ, অনেক সময় শারীরিক নির্যাতন। অনেকে বলবেন সবাই তো আর এক নয়। হ্যাঁ, স্বীকার করি। তবে এ ব্যাপারে কলেজ জীবনে শোনা তৎকালীন নেতা নুরে আলম সিদ্দিকির একটা কথা তুলনা না টানলেই নয়ঃ ‘আম বাগানে একটা কাঁঠাল গাছ থাকলে তা কাঁঠাল বাগান হিসাবে নয়, আম বাগান হিসাবেই গণ্য হয়’। আমাদের গোটা ডাক্তার সমাজ এখন একটা কাঁঠাল বাগান। খুঁজলে এ বাগানে দুয়েকটা অন্য গাছ নিশ্চয় পাওয়া যাবে, তবে তাতে হিসাবের কোন হেরফের হবে বলে মনে হয়না।
চোর বাটপারদের প্রতিনিধি সালমা খাতুন এবং নষ্ট চিকিৎসক সমাজের প্রতিনিধি নুনজেরুল মোহসীন মীমের দ্বিপক্ষীয় বাহাস নিয়ে পক্ষাবলম্বন কোন অবকাশ নেই। এরা দুজনই আমাদের নষ্ট সমাজের নষ্ট রাজনীতির নষ্ট ফসল।