কথিত গণজাগরণ মঞ্চ ব্যর্থ হলেও ব্যর্থ হয়নি এর উদ্যোক্তাদের ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার হিসাব। অনেকেই এখন সেলেব্রিটি। নামের আগে পিছে রাজনীতিবিদদের মতই ব্যবহার করতে পারছেন মঞ্চ বিশেষণ। পাশাপাশি সমাজের প্রথাগত জীবন হতে বেরিয়ে যাপন করছেন ঐচ্ছিক জীবন। নীলাদ্রি-আশামনির সংসার তারই প্রতিচ্ছবি। বিয়ে নামক সমাজের যে বাধ্যবাধকতা তা হতে অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে পশ্চিমা সমাজ। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মানুষকে দিচ্ছে পছন্দের স্বাধীনতা। এবং সে পছন্দ সমাজে যেমন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে তেমনি রাষ্ট্রের সাথেও তৈরি করছেনা কোন বৈরিতা। একটা দেশের শাসন-তান্ত্রিক কাঠামোর ভেতর প্রথাগত বিয়ের সাথে বুঝাপড়ার সংসারের কোন দ্বন্ধ না থাকলে আমরা নাগরিকরা যতই হৈ চৈ করিনা কেন তা কোন অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবেনা। বুঝাই যাচ্ছে আশামনি ও নিহত ব্লগার হিমাদ্রির সংসার ছিল তেমনি এক সংসার, যেখানে সামাজিক, ধর্মীয় রীতিনীতি ও মূল্যবোধ কাজ করেনি। এক কথায়, ওরা বুঝাপড়ার ভেতর সাময়িক একটা সংসার পেতেছিল। হতে পারে তা জৈবিক চাহিদা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা অথবা ধর্মীয় সমীকরণের ফসল। বাঙালীর হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্যের আলোকে মঞ্চ নায়কদের এহেন জীবন সহজেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। প্রশ্ন উঠবে, আইনের চোখে এটা কি কোন অপরাধ? এমন কোন আইন দেশে আদৌ আছে কিনা তাও আমার মত অনেকের জানা নেই। সময় বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের চাহিদা, চাওয়া পাওয়া। বিয়ের মানে এখন আর সম্প্রদানের ভেতর সীমাবদ্ধ নেই। নেই আজীবন টিকিয়ে রাখার দায়বদ্ধতাও। তাই সমাজে পারিবারিক পছন্দের বিয়ে যেমন ফিকে হয়ে আসছে, তেমনি বিচ্ছেদকেও মেনে নিতে হচ্ছে বিয়েরই অংশ হিসাবে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একজন নারী অথবা পুরুষকে সমাজ সংসারের প্রতি তার কমিটমেন্টেরও স্বাধীনতা এনে দেয়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এ মনোভাব সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি করবে। হতে পারে তা সত্য। কিন্তু মানবিক বিচারে এ স্বাধীনতা একজন মানুষের তিন বেলা দুমুঠো আহারের মতই অপরিহার্য। কাগজে সই করলেই দুটো মানুষ আজীবন একত্রে থাকতে বাধ্য সে দায়বদ্ধতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এখানে হাজারো ফ্যাক্টর কাজ করে। দুজনের ভিন্ন মনোজগৎ তার অন্যতম। আইনি বিয়ে এবং পরিবর্তীতে বিচ্ছেদের যে বিশাল জটিলতা তা এড়াতে পশ্চিমাদের অনেকেই এখন লিভিং টু-গেদার বেছে নেয়। আমি আপনি তার কঠোর সমালোচনা করতে পারি ধর্মীয় তথা সামাজিক অনুশাসনের ভয় দেখিয়ে, কিন্তু বাস্তবতার আলোকে বিবেচনা করলে এ ধরণের ইউনিয়নের বিরুদ্ধাচরণ করার খুব বেশী দরজা খোলা নেই।
একজন ব্লগার খুন হয়েছে। ব্লগারের চাইতেও তার আসল পরিচয় একজন রক্তমাংসের মানুষ হিসাবে। একদল খুনি তাকে দিন দুপরে নিজ বাড়িতে কুপিয়ে হত্যা করেছে। কেউ বলছে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কাজ, কেউ বলছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সরকার নিজেই খুন করেছে, কেউ আবার আঙ্গুল তুলছে আশামনির দিকে। হতে পারে এই তিনজনের যে কেউ একজন করেছে কাজটা। ঠাণ্ডা মাথার একটা পৈশাচিক খুনকে সমালোচনার করার মত মূল্যবোধ হতে আমরা কি তাহলে বেরিয়ে এসেছি? বাবু নীলাদ্রি ধার্মিক ছিলেন না। হয়ত অনেকের মত ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না। লেখালেখিতেও হয়ত অনেক সময়ে সীমানা অতিক্রম করেছিলেন। তাই বলে এভাবে পশুর মত মারতে হবে? ব্লগ দুনিয়া নতুন এক দুনিয়া। এখানে আমরা সবাই নতুন। হরেক রকম বৈরিতা নিয়ে এখানে সময় কাটাই। নিজের মনোভাব স্বাধীনভাবে প্রকাশ করি। নিজদের শিক্ষিত বলেও দাবী করি। আমাদের শিক্ষা সমীকরণের ফসল কি তাহলে রক্ত? নীলাদ্রি-আশামনির অ-প্রথাগত সংসার কি তাহলে বেচারার বেঁচে থাকার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল? সভ্যতার বিবর্তনে ধর্মের অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। বিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং যে কোন প্রক্রিয়ার মত ধর্মও যদি স্থবির হয়ে যায় তার জরায়ুতে জন্ম নেয় নৈরাজ্য। আল-কায়েদা, আইএস, বোকা হারেম, আনসারুল ইসলাম নামের এসব উগ্র সন্ত্রাসী দল সে নৈরাজ্যেরই অংশ মাত্র। রক্তের সমুদ্র বইয়ে দিলেও এসব খুনির দল কোনদিনই আমাদের ফিরিয়ে নিতে পারবেনা ধর্মীয় রাজত্বে। সমাজতন্ত্রের মত ধর্মও সভ্যতা বিকাশের একটা ধাপ মাত্র। এ নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি, যথাযথ সন্মান দেখাতে পারি, কিন্তু কাউকে বাধ্য করতে পারিনা ঘড়ির কাটা উলটো দিকে ঘুরাতে।