অভিজ্ঞতাটা সুখের নয়। শুনলে অনেকে কষ্ট পাবেন। সাম্প্রদায়িক ভেবে কেউ কেউ হয়ত বাতিলের খাতায়ও ফেলে দিতে চাইবেন। আমি ধার্মিক নই, তাই সাম্প্রদায়িক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে যারা পরজন্মে বিশ্বাসী এবং ধর্মভীরু কেবল এই কারণে তাদের অসন্মান করার মত অযৌক্তিক মানুষ আমি নই। আপনি বটগাছকে খোদা ভেবে যদি তার পদতলে নিজকে সপে দেন, পছন্দ আপনার এবং আমি কুর্নিশ করি আপনার পছন্দকে। তবে দেখতে হবে এই বটগাছ ভীরুতা আপনার চৌকশ কোন ভণ্ডামি কিনা অথবা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সমাজের ক্ষতি করছেনা কিনা। যাই হোক, চলুন ফিরে যাই আসল ঘটনায়। ৭০ দশকের মাঝামাঝি কোন একটা সময়। সোভিয়েত সরকারের বৃত্তি নিয়ে আমরা কজন তরুণ বর্তমান ইউক্রেনের কোন এক শহরে ভাষা শিখছি। নতুন দেশ। নতুন সমাজ ও নতুন নতুন মানুষ। প্রতিদিন নতুন কিছু শিখছি, অবাক করার মত অনেক কিছু দেখছি। চোখে পড়ার মত ঘটনা যা উল্লেখ না করলেই নয় তা হল ধর্মীয় বাস্তবতা। দেশটায় কেউ ধর্ম চর্চা করেনা। চর্চা করেনা বললে নিশ্চয় ভুল বলা হবে, করতে দেয়া হয়না। সরকারী ভাবে ধর্মচর্চার উপর রয়ে গেছে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। সরকারের দাবী তারা রাষ্ট্রকে ধর্ম হতে আলাদা করতে সক্ষম হয়েছে। ধর্ম গাজার মত একটি নেশা, ইনিয়ে বিনিয়ে এমনটাই আমাদের শেখানো হচ্ছে। প্রভাব খুব দ্রুত গ্রাস করে নিলো আমাদের। বেশ কজন স্বদেশীর মত আমি নিজেও উপসংহারে চলে আসলাম বেঁচে থাকার জন্য ঈশ্বরের বাস্তবতা অপরিহার্য নয়। চিন্ময় কুমার সরকার আমার মতই একজন। কট্টর হিন্দু ধর্মের পরিসর হতে উঠে আসা বগুড়ার এই ছেলে খুব দ্রুতই আমাদের বন্ধু হয়ে গেল। বন্ধুত্বের ফাউন্ডেশন, এন্টি-ধর্ম।
প্রবাসের প্রথম ঈদ। মা-বাবা, ভাইবোন সবাইকে ফেলে পৃথিবীর নির্জন প্রান্তে ঈদের আনন্দ হতে বঞ্চিত হওয়া কতটা কষ্টের ছিল তা এখন আর বুঝাতে পারবোনা। নাস্তিকতার পুণ্যভূমিতে ঈদের নামাজের আয়োজন করে সে কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘবের চেষ্টা করলাম। নামাজ হবে আমাদের ডর্মের হল ঘরে। ইমামতি করবে কিছুটা হুজুর প্রকৃতির সহপাঠী আবুল হাশেম। অনেকটা দেশীয় কায়দায় সকাল সকাল গোসল সেরে অস্থায়ী জুমাঘরে হাজির হলাম। সবার পরনে কড়া ইস্ত্রি করা কাপড়। সময় মতই নামাজ শুরু হল। হলরুমের দরজা বন্ধ করতে হল পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা ভেবে। নামাজ শুরুর দুমিনিটের মাথায় দরজায় কেউ একজন নক করতে শুরু করল। প্রথমে আস্তে। তারপর পাগলা কুকুরের কায়দায়। নামাজ ক্ষান্ত দিয়ে আমিই খুলে দিলাম দরজা। ওপাশে চিন্ময় কুমার সরকারকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমরা সবাই নামাজ পড়ছি সেটা সে ভাল করেই জানে এবং নামাজে বিরতি দিয়ে দরজা খোলা কোনভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয় তাও অজানা নয়। তারপরও সে কড়া নাড়ছে। এবং পাগলের মত। আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে ভেতরে ঢুকে গেল। এবং তার হাতের জিনিষটা দেখে আমরা সবাই বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম। শূয়রের হাড্ডি। ঝড়ো গতিতে সামনে এলো এবং কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাড্ডি গুলো ইমামের সামনে রেখে বেরিয়ে গেল। নব্য নাস্তিকের এহেন আচরণে সবাই ব্যথিত হলেও এ নিয়ে বাড়াবাড়ির সুযোগ ছিলনা।, কারণ এদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে এন্টি-ধর্ম লালন করা হয়। চেপে গেলাম কষ্ট গুলো। দিন যায়...মাস যায়...। আমরা অনেকেই ভুলে গেছি সেদিনের সে ঘটনা। এরই মধ্যে একদিন ঘটে গেল বিস্ময়কর এক ঘটনা। প্রতিদিনের মত সেদিনও চিন্ময়ের রুমে গেলাম আড্ডা দেব বলে। ঢুকে একেবারে থ! গভীর ধ্যানে পূজা করছে সে। ধুপের ধোয়ায় রুম অন্ধকারাচ্ছন্ন। মন খারাপ করে নিজের রুমে ফিরে এলাম। নতুন করে কষতে শুরু করলাম ধর্মহীনতার সমীকরণ। আরও অনেক পরে চিন্ময়ের কথাবার্তা, আচার ব্যবহারে বুঝতে পারলাম তার কাছে ধর্মহীনতা কেবল মুসলমানদের বেলায়ই প্রযোজ্য। মার্কসবাদ তথা দ্বান্ধিক বস্তুবাদের লড়াইটাও কেবল ইসলামের বিরুদ্ধে।
আরও অনেক পরের কথা। হতে পারে সর্বসাকুল্যে ৫ বছর। সোভিয়েত দেশে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে আসার জন্য মস্কোতে জমা হচ্ছি আমরা। উল্লেখ্য, ভাষা কোর্স শেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স শুরু করার জন্যে আমরা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন শহরে চলে গিয়েছিলাম। এতদিন কারও সাথে দেখা নেই। মস্কোর একটা ডর্মে সরকারী খরচে সাময়িক ভাবে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে আমাদের। এত বছর পর পুরানো সবার সাথে দেখা হবে সে উত্তেজনায় টগবগ করছিলাম। খুব ভোরে সেরেমেতভো এয়ারপোর্ট হতে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। গ্রীষ্মকাল। রাতের স্থায়িত্ব খুবই সংক্ষিপ্ত। আগেই আন্দাজ করেছিলাম কেউ ঘুমাতে যাবেনা। আড্ডা, মদ আর মেয়ে মানুষের গল্পে কাটিয়ে সাড়া রাত। ডর্মে ঢুকেই দেখলাম থমথমে অবস্থা। সবাই জেগে। কিছু একটা ঘটে গেছে এখানে। সবকিছু উলটপালট হয়ে আছে। আমাকে দেখে জলিল এগিয়ে এলো। আস্তে করে টেনে নিয়ে গেল তার রুমে। দরজা বন্ধ করে শুরু করল রাতের গল্প। সন্ধ্যায় পাশের পার্কে গিয়ে সবাই মিটিং করেছিল। বাদ ছিল কেবল চিন্ময়। ওখানেই সিদ্ধান্তটা নেয়া হয়। মদ খাইয়ে মাতাল করা হবে তাকে এবং তারপর ধোলাই। আস্তিক নাস্তিক কেউ বাদ গেলনা। সবাই যোগ দিয়েছিল গণধোলাইয়ে। শরীরের কোন অংশ আস্ত রাখা হয়নি। পাঁচ বছরের জমানো ক্ষোভ বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত ভাসিয়ে নিলো সবাইকে। আমার জন্য রাখা হয়েছিল শেষ পর্ব, তার রুমেই আমারা থাকার ব্যবস্থা । খুব আস্তে করে রুমে ঢুকে চিন্ময়ের চেহারা দেখে আঁতকে উঠলাম। অনেকটা শূয়রের হাড্ডির মতই দেখালো তার শরীরের হাড্ডি গুলো। যে হাড্ডি গুলো সে নামাজের সামনে রেখে নিজের ধর্মহীনতা প্রকাশ করতে চেয়েছিল।