চলুন ১৯৯৪ সালের আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় ফিরে যাই। দেশটায় পশু হত্যার মত মানুষ হত্যা চলছে। একই দেশের হুতু গোত্রের মিলিশিয়ারা স্বদেশী তুতসি গোত্রকে পৃথিবীর বুক হতে মিশিয়ে দেয়ার মিশনে নেমেছে। কারণ তাদের বিচারে তুতসিরা ইঁদুর। আর ইঁদুর নিধন তাদের জাতীয় কর্তব্য। ১০০ দিনের গৃহযুদ্ধে ৮ হতে ১০ লাখ তুতসির রক্তে রঞ্জিত হয় রুয়ান্ডার মাটি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভরা যৌবনে মানব সভ্যতার চোখের সামনে সংগঠিত হয় এ পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ। কেউ এগিয়ে আসেনি। জাতিসংঘ নামের ঠুটা জগন্নাথ নিজেদের প্লাস্টিক দাঁত নিয়ে কামড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। গোটা বিশ্ব তাকিয়েছিল আমেরিকার দিকে। বিল ক্লিনটন ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। আফ্রিকার এ জাতিগত সংঘাত আমেরিকার জাতীয় স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, তাই গাঁটের পয়সা খরচ করে দাঙ্গা ঠেকানোর দায়িত্ব নিতে অপরাগতা প্রকাশ করলেন। সমালোচনার সুনামি বয়ে গেল বিশ্বব্যাপী। যারা কথার আগে পিছে সাম্রাজ্যবাদ আর শোষকের বিশেষণ লাগিয়ে আমেরিকাকে তুলো-ধুনো করতেন তারাও মুখ খুললেন। শত সমালোচনার মুখেও ক্লিনটন প্রশাসনের মন গলেনি। মার্কিন কোন সৈনিকের বুটের দাগ লাগেনি রুয়ান্ডার মাটিতে। ফলাফল যা হবার তাই হল। গোটা বিশ্ব অবাক হয়ে গেল বন্দুক, তলোয়ার, দা, কুড়ালের ঝনঝনানি। ময়লা ফেলার মত ট্রাকে ট্রাক লাশ ফেলা হল ডাস্টবিনে।
২০১১ সাল। বসন্তের শুরু কেবল। গোটা মধ্যপ্রাচ্য গ্রাস করে নিয়েছে আরব বসন্তের দাবানল। এ দাবানলের শুরু সুদূর উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনেশিয়া হতে। যার ঢেউ আছড়ে পড়েছে মিশর, ইয়েমেন, জর্ডান, ওমান হয়ে সিরিয়ায়। কানাঘুষা চলছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মত রাজতন্ত্রে। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামছে। পাশাপাশি দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতার স্বাদ নেয়া স্বৈরাচারী শাসকের দল উস্কে দিয়েছে গোত্রীয় বিভাজন, কুকুরের মত লেলিয়ে দিয়েছে রুটি হালুয়ায় লালিত পুলিশ তথা সেনাবাহিনী। লাশের মিছিল বইছে কায়রো, মাস্কাট, এডেন আর দামেস্কের রাজপথে। সিরিয়ার আসাদ গুষ্টির সর্বশেষ সংযোজন বাশার আল আসাদ কেবল ক্ষমতার স্বাদ নিতে শুরু করেছেন। যুগ যুগ ধরে ভোগ করা এ স্বাদ এত সহজে ছেড়ে দেবেন কেউ আশা করেনি। কিন্তু তা টিকিয়ে রাখতে এতটা পশু হবেন তাও কেউ স্বপ্নে দেখেনি। মানব সভ্যতা নতুন করে সাক্ষী হল রুয়ান্ডা গণহত্যার। ইরাক ও আফগানিস্তান অভিজ্ঞতার তিক্ততা হতে মার্কিন জনগণ তখনো মুক্তি পায়নি। দেশটার অর্থনীতি স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয় কাটিয়ে পায়ের উপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে কেবল। এরই মাঝে বাজতে শুরু করেছে যুদ্ধের নতুন দামামা। অগণতান্ত্রিক মধ্যপ্রাচ্যের ভোগ বিলাসী রাজা-বাদশাহদের সাথে আমেরিকার প্রণয় কোনদিনই সহজভাবে নেয়নি সে মার্কিন জনগণ। তাই বিরোধী দল সহ মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক অনেক বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিলেন সুযোগ হারানো উচিৎ হবেনা ওবামা প্রশাসনের। কিন্তু ওবামা প্রশাসন ক্লিনটন প্রশাসনের মতই নির্বিকার। দুই যুদ্ধের কোমর ভাঙ্গা খরচ মিটিয়ে নতুন করে যুদ্ধে যাওয়ার সংগতি ছিলনা দেশটার। কিন্তু প্রতিদিন এ দেশের জনগণ টিভি পর্দায় দেখছে বাশার আল আসাদের নির্মমতা। দেখছে শিশুর লাশ। দেখছে লাখ লাখ সিরিয়ান দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। এবার জনগণের ভেতর হতেই দাবি উঠলো নাক গলানোর। তবে তার জন্য বেধে দেয়া হল সীমানা। মার্কিন কোন সৈন্য পা রাখবে না সিরিয়ার মাটিতে। বরং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত দেশটার বিভিন্ন গ্রুপকে একত্র করে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে। এবং তাই করা হল। হয়ত এমন তত্ত্বের জরায়ুতেই জন্ম নিয়েছিল আইসিস নামের ক্যান্সার। যড়যন্ত্রের অনেক তত্ত্ব ভেসে বেড়ায় বিশ্ব বাতাসে। এই যেমন, ইসরায়েলিদের সহযোগিতায় ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য আইসিসের জন্ম দিয়েছে আমেরিকা। আবার কারও মতে মধ্যপ্রাচ্যের তেলই এখানে মুখ্য। এক কথায়, মানব সভ্যতার এক কলঙ্কিত দানব এই আমেরিকা এবং তার স্বার্থেই দেশে দেশে তালেবান, আইসিস, বকোও হারেম, আনসারুল ইসলামের মত দানব জঙ্গি গুষ্টির জন্ম। দিন শেষে আমেরিকাও একটা দেশ। এবং পৃথিবীর অন্যতম উন্নত ও শক্তিশালী দেশ। এ দেশেও পৃথিবীর আর দশটা দেশের মত দুই হাত, দুই পা ও ঘাড়ের উপর মাথাওয়ালা মানুষ বাস করে। আর এ মানুষরাই সময় হলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সরকার নির্বাচিত করে। আমেরিকাকে ভালবাসা অথবা ঘৃণা করা দুটোই মানুষের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার কেড়ে নেয়ার অপর নাম স্বৈরতন্ত্র। আজকের মানব সভ্যতা যে বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে তাতে আমেরিকার অবদান কতটুকু তা নির্ণয় করতে খুব একটা দূরে যাওয়ার দরকার হয়না। ক্যান্সার আক্রান্ত কোন পরিবারের কেউ যদি থমকে দাঁড়িয়ে চিকিৎসার উপাদান গুলো পরখ করতে চায় সেখানে মার্কিন অবদানের বাইরে দ্বিতীয় কোন দেশের অবদান খুব একটা চোখে পড়ার কথা নয়। আমরা যারা মার্কিন দেশে ট্যাক্স দিয়ে চাকরি করি সে ট্যাক্সের বিরাট একটা অংশ চলে যায় গবেষণা খাতে। আর এসব গবেষণার ফল ভোগ করে গোটা মানব জাতি। যে প্রযুক্তি গোটা পৃথিবীকে একটা পরিবারে আবদ্ধ করতে সহায়তা করছে তার মূলেও আছে মার্কিন গবেষণা। মুসলিম বিশ্বের দেশে দেশে একটা প্রবাদ প্রচলন আছে ইহুদিরাই নাকি মার্কিন পলিসির নিয়ন্ত্রক। এবং তাদের স্বার্থের জন্যই ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়ার সহ গোটা মুসলিম বিশ্বে দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধাচ্ছে। সন্দেহ নেই মার্কিন ইহুদিদের হাতেই অর্থনীতির অনেক কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে তা গায়ের জোরে অথবা অস্ত্রের মুখে কারও কাছ হতে ছিনিয়ে নেয়া হয়নি। সুযোগের দেশ আমেরিকা। যোগ্যরাই এখানে প্রস্ফুটিত হয়। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ হতে আসা ইহুদি অভিবাসীরাও নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে আমেরিকায় স্থান করে নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হিটলার ছিল তাদের জন্য শিক্ষা। সে শিক্ষার ফসল ভোগ করছে মার্কিন ইহুদিরা। সুরঞ্জিত বাবুদের ক্ষমতায় বসিয়ে আমরা যদি দাবি করি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েলের মুখোমুখি করার দাবিও প্রায় এক। প্যালেস্টাইন সমস্যার দায়-দায়িত্ব কেবল মার্কিনীদের উপর চাপিয়ে তা হতে আত্মসন্তূষ্টি লাভ করা হয়ত খুব সহজ, কিন্তু আমরা যদি এ সমস্যার গভীরে প্রবেশ করি তার আসল কালপ্রিট হিসাবে যাদের নাম বেরিয়ে আসবে তা হল সৌদি রাজা-বাদশাহদের কুৎসিত চেহারা, জর্ডানের রাজতন্ত্র, ইজিপ্টিয়ান সামরিক স্বৈরতন্ত্র, কুয়েতি, কাতারি, ওমানি আমিরদের ক্ষমতার লোভ। মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক দেশ বলতে কেবল ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনকেই বুঝায়। পশ্চিম তীর ও গাজায় ক্ষমতায় আসতে চাইলে স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমেই আসতে হয়। আর এখানেই সমস্যা মদ্যপ, নারীলোভী আমির আর বাদশাহদের। গণতান্ত্রিক প্যালেস্টাইন রাজতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ হুমকি। এক সৌদি যুবরাজ তালাল বিন আবদুল আজিজ বিন সাউদের কাপড় ধরে টান দিলেই বেরিয়ে আসবে প্যালেস্টাইন সমস্যার আসল কারণ।
কথিত মুসলিম উম্মার অংশ দাবি করে আমরা যদি বাকি বিশ্ব হতে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করি তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। কারণ মুসলিম উম্মা নামের কোন উম্মা নেই। সবটাই মধ্যপ্রাচ্যের চরিত্রহীন রাজা-বাদশাহদের ধাপ্পাবাজি। আর এসব ধাপ্পাবাজিতে রসদ যোগাই আমরা নিজেরা। সৌদি অর্থনীতিতে বছরে ৮ বিলিয়ন ডলার যোগান দেই হজ্বের নামে। আর সে অর্থে সৌদি বাদশাহ ও আর বৈধ অবৈধ সন্তানেরা পৃথিবীর দেশে দেশে মদ, নারী বিলাসে উড়ায়। সমসাময়িক পৃথিবীতে অর্থনৈতিক দৌড়ে টিকে থাকতে চাইলে আমাদের পছন্দ নিশ্চিত করতে হবে। উম্মার অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক লেনদেন নেই, আছে মানব লেনদেন। পশ্চিমা দুনিয়া যদি এতই পাপের দুনিয়া হয় তাহলে আমাদের স্বাধীনতা আছে সে দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে উম্মার দুনিয়ায় পা রাখা। কেউ আমাদের বাধা দেবেনা।