পাঠকদের অনেকের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্প নামটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে অনেকগুলো কারণে। প্রথমত, এমন একটা নাম বাংলাদেশি পাঠকদের অনেকের কাছে অপরিচিত মনে হতে পারে। আবার যারা নামটার সাথে পরিচিত তাদের জন্য লোকটাকে নিয়ে লেখালেখি আদার ব্যপারী হয়ে জাহাজের খবর নেয়ার মত শোনাবে। অনেকে আবার এ ভেবে এড়িয়ে যাবেন মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি অপ্রাসঙ্গিক ভেবে। ধরে নিলাম সবই ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি হাসিনা-খালেদার দেশে বাস্তবেই অখাদ্য লাগতে পারে। আমরা সাধারণ নাগরিকেরা ভিন দেশের এসব ব্যাপার স্যাপার এড়িয়ে যেতে চাইলেও দেশের স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ঠিকই মাথা ঘামাচ্ছেন। প্রফেসর ইউনুসকে অনেকদিন বাঁশ দেয়া হয়নি, যা হীরক রাজ্যে একেবারেই বেমানান। বেহায়াপনার ধারাবাহিকতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে তিনি অনেকটা জ্যোতিষ কায়দায় ভবিষৎবাণী করেছেন, নোবেল জয়ী ইউনুস স্যার নাকি হিলারি ক্লিনটনের বিজয়ের অপেক্ষা করছেন। আর এ বিজয় অর্জন করা গেলে ক্লিনটন-ইউনুস জুটি নাকি বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পরবেন হীরক রাজ্যের উপর। ফেইসবুক, টুইটার, হোয়াটসয়াপ, ভাইবারের মত সোস্যাল মিডিয়া বন্ধ করে অবৈধ ক্ষমতার ফাঁক ফোঁকর অনেকটাই বন্ধ করে ফেলেছেন। তাই আগত দিনের এ জুটির ঝামেলা সামলে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কিভাবে পাকা করবেন তা নিশ্চয় ভাবনার খোরাক যোগাচ্ছে। এখানেই চলে আসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম। সামনের বছর নভেম্বরের ৪ তারিখ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। চার বছর পর পর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে বর্তমান ডেমোক্রেট দলীয় প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তাই দলটাকে মনোনয়ন দিতে হবে নতুন একজন প্রার্থীর। সব বিচারে হিলারি ক্লিনটন মনোনয়ন দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে। দৈব কিছু না ঘটলে মার্কিন নাগরিকদের প্রথমবারের মত একজন মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য অনুরোধ করবে ডেমোক্রেটিক পার্টি। পাশাপাশি রিপাবলিকান মনোনয়নের জন্য লাইন ধরেছে বেশ কজন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের অন্যতম। বিলিয়নিয়ার রিয়েলর, সফল এন্টারটেইনার ডোনাল্ড রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য কোন ব্যাক্তি নয়। নির্বাচন আসলেই তিনি গর্ত হয়ে বেরিয়ে মাঠে নামেন। গরম গরম কথা বলেন, মাঠ উত্তপ্ত করেন। সময় গড়ানোর সাথে আবার ফিরে যান গর্তে। এভাবেই চলছে বেশ ক'বছর। এবারেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মেক্সিকানদের এক হাত নিয়েই নির্বাচনী মাঠে নামেন। যারা প্রতিবেশী দেশটা হতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে তাদের সবাই নাকি র্যাপিষ্ট, বদমাইশ। আর তাতেই সবার কাছে বার্তা পৌঁছে যায় ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন মাঠে। ২০১২ সালে সোরগোল তুলেছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্ম নিয়ে। অভিযোগ করেছিলেন প্রেসিডেন্টের জন্ম এ দেশে নয় এবং হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে ইস্যু করা বার্থ সার্টিফিকেট ছিল ভুয়া। যারা ট্রাম্পকে ভালভাবে চেনে তারা গুরুত্ব দেয়নি তার বার্থার ইস্যুকে। খোদ ওবামা পাগলের কাজ পাগলে করে ভেবে ডোনাল্ডের পিছু নেননি ডোনাল্ডের। ফলে নির্বাচনী দৌড়ে পানি পায়নি বার্থ ইস্যু। হঠাৎ গর্জে উঠা ট্রাম্প যে পথে এসেছিলেন সে পথেই ফিরে যান আপন গর্তে।
২০১৫ সাল। এক বছর পর আমেরিকান নির্বাচন। দুই পার্টির স্ব স্ব প্রাইমারী নির্বাচন সিদ্ধান্ত দেবে কে হবে দলীয় প্রার্থী। আগের বারের মত এবারও রিপাবলিকান প্রাইমারীতে এগিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবার ইস্যু করেছেন মেক্সিকানদের, ইস্যু করেছেন মুসলমানদের। প্যারিস ও ক্যালিফোর্নিয়ার সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে মুসলমান ইস্যু যে বাজারে ভাল বিকাবে ট্রাম্প ভাল করেই জানতেন। তাই মিস করেননি এ সুযোগ। এখানে একটা ব্যাপার না টানলেই নয়, রিপাবলিকান পার্টির ব্যাক-বোনের অনেকটা জুড়ে আছে ককেসিয়ান সাদা আমেরিকানরা। যাদের অনেকের কাছে ইমিগ্রেশন মানেই সমস্যা, হোক তা বৈধ অথবা অবৈধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইমেডিয়েট পর জন্ম নেয়া বিত্তশালী মধ্যবয়স্ক আমেরিকানরা, যারা সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে বেবি বুমার হিসাবে পরিচিত, তাদের অনেকেই বিভিন্ন কারণে রিপাবলিকান পার্টির একনিষ্ঠ সমর্থক। তার মধ্যে রয়েছে যেমন গর্ভপাতের মত সোস্যাল ইস্যু, তেমনি রয়েছে অবাধ অস্ত্র বহনের মত শাসনতান্ত্রিক স্বাধীনতা ভোগ। এদের প্রায় সবাই কট্টর ধার্মিক এবং বেশির ভাগ ইভানজেলিষ্ট। ধর্মীয় কারণে ইসরাইল এবং ইহুদিদের প্রতি রয়েছে ঐতিহাসিক সমর্থন। এদের কাছে কালো আমেরিকানরা যেমন সমস্যা, তেমনি সমস্যা ইসলাম ধর্ম। পাশাপাশি রয়েছে প্রতিবেশী মেক্সিকানদের প্রতি জাত ঘৃণা। আমেরিকা শুধু বিত্তশালী সাদাদের, এমন একটা অলিখিত বাস্তবতাকে ঘিরে আবর্তিত হয় রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতি। ডোনাল্ড ট্রাম সে রাজনীতিরই ধারক বাহক। পার্টির প্রাইমারী ইলেকশন জিততে চাইলে ঘৃণা ছড়ানোর রাজনীতি অপরিহার্য। যে যত বেশি ছড়াবে জনপ্রিয়তাও হবে ততবেশি। তবে তা সীমাবদ্ধ থাকে প্রাইমারীর ভেতর। ইমিগ্রান্টদের দেশ আমেরিকায় ঘৃণা ছড়িয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে জয়লাভ করার মত অবস্থানে নেই রিপাবলিকান পার্টি। তাই দলীয় নমিনেশন পাওয়ার পর মুহূর্তেই নমিনিকে নামতে হয় ডেমেজ রিবিল্ডের কাজে। কারণ আমেরিকায় দুই দলীয় সমর্থকের বাইরেও রয়েছে কোটি কোটি নির্দলীয় সমর্থক। মুসলমান ঠেকানোর মত আন-আমেরিকান ইস্যু দিয়ে এসব ভোটারদের মন জয় করার মত অবস্থানে নেই দুই পার্টির কেউ। চেতনা বেসাতির দেশ আমেরিকা নয়। দেশটার ফাউন্ডেশনে রয়েছে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও এর মূল্যবোধ, যার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে অর্থনীতি। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আমেরিকায় মুসলমানদের প্রবেশ ও চলাফেরায় নিয়ন্ত্রনের ঘোষণা দিয়েছেন। ডোনাল্ড নিজেও জানেন এসব ঘোষণা স্রেফ ষ্ট্যান্টবাজী ছাড়া আর কিছু নয়।