দেখতে দেখতে আগস্ট মাসও গড়িয়ে গেল। এবার ঘরে ফেরার পালা। গায়ে গতরের ক্লান্তি আজকাল মনের ভেতরও চেপে বসছে। চোখ বুজলে সামনে ভাসে ব্যস্ত শহর, রাজপথ, ধাবমান এম্বুলেন্সের চীৎকার আর আমার প্রিয় ডর্মটা। যেখানটায় আছি সেখানে সভ্যতার ছোঁয়া নেই। চারদিকে গহীন জংগল আর সুনসান নীরবতা। সবকিছু কেমন স্থবির। কান পাতলে মৃত পাতাদের উথাল পাতাল শোনা যায় কেবল। নতুন কেউ আসলে মনে হবে এ মৃত্যুপুরী। মনে হবে এখানে আসা যায়, কিন্তু ফেরত যাওয়া যায়না। দুমাস আগে প্রথম যখন জায়গাটায় পা রাখি গা শিউরে উঠেছিল। শিরদাঁড়া বেয়ে এক ধরণের ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে গিয়েছিল। আগত দিনগুলোর কথা ভেবে চমকে উঠেছিল পিলে। গ্রীষ্মের ছুটিতে কোথায় যাব মনস্থির করতে পারছিলাম না। হাতে একটা কানাকড়িও নেই। মাসের স্কলারশিপ যা পাই তা দিয়ে নাওয়া খাওয়াটা চলে যায় কোন রকম। মাকে দেখিনা প্রায় দুই বছর। ফোন দূরে থাক, এক পাতার একটা চিঠি পেতেও সময় লাগে প্রায় দেড় মাস। চিঠিতে মা প্রায়ই জানতে চান কবে আসছি। এর উত্তর আমার জানা ছিলনা। তাই স্প্রিং টার্ম শেষে দ্বিধায় পরে গেলাম।
দুমাসের ছুটি। বিশ্রাম প্রয়োজন। আবার দেশে যাতে চাইলে টাকা আয়োজনের এটাই একমাত্র সময়। ডীন অফিসের কেউ একজন ডেকে পাঠাল আমাকে। যুব কম্যুনিস্টদের একটা ব্রিগেড যাচ্ছে ওদিকটায়। চাইলে আমিও যোগ দিতে পারি। গেল বছর পর্যন্ত বিদেশীদের জন্য জায়গাটা ছিল নো-ফ্লাই জোনের মত। ষ্ট্রাটিজিক কি সব স্থাপনা আছে গভীর জঙ্গলে যা দেখার অধিকার নেই বিদেশীদের। কিন্তু এ বছরের পরিস্থিতি অন্যরকম। নির্মাণ ব্রিগেডে নাম লেখাচ্ছে না কেউ। প্রয়োজনীয় লোকবল পাওয়া না গেলে শহর কম্যুনিস্ট পার্টির ঘাড়ে ঝুলতে শুরু করবে শাস্তির খড়গ । তাই মরিয়া হয়ে বিদেশীদের দিকেও হাত বাড়াতে বাধ্য হল নির্মাণ কাজের নেতারা। গ্রীষ্মের তিনটা মাসই কেবল সময় যখন নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাওয়ার মত আবহাওয়া থাকে। বাকি ন’মাসের সবটাতে জুড়ে থাকে বৈরী প্রকৃতি। অবিরাম তুষারপাতে থমকে যায় জনজীবন। হাতেগোনা স্থানীয় যে কজন আছে তারাও পালিয়ে যায় নিরাপদ আশ্রয়ে। অথচ সোভিয়েত সরকার চাইছে সোনা, রূপা আর তেলে উর্বর এলাকার দ্রুত উন্নতি। তার জন্য চাই পাকা রাস্তা, রেললাইন, এয়ারপোর্ট, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস। সবই আছে, তবে তা মাটির তলায়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার মত অবকাঠামো নেই এলাকায়। তাই উন্নয়ন কাজে নির্ভর করতে হয় সনাতনী প্রযুক্তির উপর। শীতে তিন গুন বেতন দিয়েও নাকি কাউকে পাওয়া যায়না। তাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে বাধ্য হয় যুব কম্যুনিস্ট পার্টি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের উৎসাহ দেয়া হয় নাম লেখানোর জন্য। যদিও বলা হয় কম্যুনিজমের ডাক, আসল উদ্দেশ্য সস্তা শ্রম। প্রয়োজনের কথা ভেবে নাম লেখাতে বাধ্য হলাম।
সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে মুরমানস্ক। দুই রাত, এক দিনের ট্রেন জার্নি। পার্টি ব্যাপক আয়োজন করে আমাদের বিদায় জানালো। বাদ্য, আহার আর ঘরে প্রস্তুত ভদকার নহর বয়ে গেল প্লাটফর্মে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক সৈনিকও হাজির হল আমাদের আশীর্বাদ করতে। চোখের জল আর নাকের জলে এক করে প্রেমিকা বিদায় জানালো তার প্রেমিককে। নিজকে খুব বিশাল মনে হল। মনে হল আমিও এ যুদ্ধের সৈনিক আর যারা এসেছে তারা সবাই আমার আপনজন। এ যেন সেলুলয়েডের ফিতায় দেখা বিশ্বযুদ্ধের চিত্র। ছেলে ফ্রন্টে যাচ্ছে। মা বিদায় জানাচ্ছে। চোখ মুখে সব হারানোর কষ্ট। মুরমুনস্কের রিসিপশনটা ছিল আরও ঝমকালো। শহরের সবকটা জুনিয়র স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা হাজির। সবার হাতে ফুলের গুচ্ছ। চারদিকে ব্যান্ডের কর্কশ আওয়াজ। শহরের মেয়র আমাদের স্বাগতম জানালেন। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হল ছুটি হয়ে যাওয়া স্কুল গুলোতে। একদিন বিশ্রামের পর সবাইকে মনে করিয়ে দেয়া হল কাজের কথা। শহর হতে বেশ কিছুটা দূরে গহীন জংগলে যেতে হবে আমাদের। ওখানে অস্থায়ী ক্যাম্প হবে। চলমান পানি নেই, স্যানিটারি বলতেও কিছু নেই। যন্ত্রপাতি বলতে কেবল শাবল, কোদাল, দা আর খুন্তি। বড় বড় পাথর ঠেলে পথ পরিষ্কার করতে হবে। কেবল তারপরই শুরু হবে রাস্তার কাজ। সাত দিনের ছয় দিনই কাজ করতে হবে। ছোট ছোট গ্রুপ করে আমাদের নামিয়ে দেয়া হল যুদ্ধের মাঠে।
যতই দিন গড়াল সূর্যের স্থায়িত্ব বাড়তে লাগলো জ্যামিতিক হারে। এক সময় প্রকৃতি হতে রাত নামের শব্দটা বিদায় নিলো। চব্বিশ ঘণ্টাই দিন। রাত দুটার দিকেও রাজত্ব করে সূর্যের ম্লান আভা। তাতে বিস্ময়কর দৃশ্যের সৃষ্টি হয় গভীর জঙ্গলে। কাজ বলতে জানোয়ারের মত শারীরিক পরিশ্রম। প্রথম সপ্তাহ শেষ হতে ব্রিগেড কমান্ডারকে জানালাম আমি ফিরে যাবো সেন্ট পিটার্গবার্গে। এ ধরণের পরিশ্রমের শরীর আমারটা না। কমান্ডার সবই বুঝলেন এবং জানালেন যেতে চাইলে ফিরতি টিকেট নিজের পকেট হতে কাটতে হবে। তেমন অবস্থা ছিলনা আমার। প্রমোদ গুনলাম এবং দাঁত কামড়ে পড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। দু’সপ্তাহ শেষে মনে হল আমি পারবো। এবং শেষপর্যন্ত পারলামও। একে একে কেটে গেল দুটা মাস। পৃথিবীর অদ্ভুত এক প্রান্তে গায়ে গতরে খাটছি যেখানে রাত নেই। আবার শীত শুরু হলে সাত মাসের জন্য বিদায় নেবে সূর্য। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমাকে যেতে হল মুরমানস্কের কয়েকটা স্কুলে। স্থানীয় ছাত্রদের স্মৃতিতে বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস তখনও জীবন্ত অধ্যায়। ওরা মুখ হতে শুনতে চায় এ অধ্যায়ের ইতিকথা। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে জানতে চায় কেমন ছিল যুদ্ধের নয়টা মাস। বলতে হল জনগণের র্দুভোগের কথা, শত্রুদের নির্মমতার কাহিনী আর যুদ্ধ জয়ে বীরদের বীরত্বের গল্প। স্থানীয় দৈনিক প্রাভদা অফিসে আমাকে আমন্ত্রণ জানালো। নেয়া হল লম্বা ইন্টারভিউ। রোববার সংখ্যার প্রথম পাতায় ঠাঁই পেল আমার ছবি এবং নয় মাস যুদ্ধের খণ্ড খণ্ড স্মৃতি।
যাবার সময় ঘনিয়ে আসার সাথে মনটা কেমন দুর্বল হয়ে গেল। মনে হল মায়া লেগে গেছে এ বিরানভূমির জন্য। বনের বিশাল বিশাল গাছ গুলোর সাথে মনে হল বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। ফিরে যাচ্ছি এবং জানছি কোনদিন আসা হবেনা পৃথিবীর এ প্রান্তে। হয়ত ব্যস্ত জীবনের অবসর মুহূর্তে রোমন্থন করবো বৈচিত্র্যময় দুমাসের জীবন। বিদায়ের আগের দিন। সবকিছুতে বিদায়ের আলসেমি। সাথের দুজন মেয়ে সহকর্মী বিকিনি পরে শুয়ে আছে সূর্যস্নানের আশায়। আমার পরিধানে নির্মাণ কাজের পোশাক। মাথায় শক্ত হ্যাট। হাতের শাবলটা রেখে হাঁটুতে মাথা রেখে ঝিমচ্ছি। হঠাৎ করে মনে জঙ্গলের পাতা গুলো নড়ে উঠলো। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ একজন আসছে। এ সময় ব্রিগেড কমান্ডের কারও আসার কথা নয়। দাঁড়িয়ে পরলাম, বাকিরাও দ্রুত পোশাক বদলে তৈরি হয়ে নিলো। অপরিচিত চেহারাটা দেখে চমকে উঠলাম। বোবা হয়ে গেলাম বিস্ময়ে। এ যে আমার চেহারার কেউ একজন! মাটি ফুঁড়ে কেউ বেরিয়ে আসতে পারে তা কোনদিনও বিশ্বাস করিনি, কিন্তু আজ করতে হল। নতুন অতিথিও আমাদের দেখে হতবাক। কয়েক মিনিট চুপ করে রইলো এবং পর-মুহূর্তে পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করলো, ভাই, আপনি কি বাংলাদেশি?
আমি অবাক, বিস্মিত, অভিভূত। এ কি করে সম্ভব! বাস্তবে ফিরে আসতে একটু সময় লাগলো। পরিচয় পর্ব শেষে জানা গেল আসল রহস্য। জঙ্গলের শেষ প্রান্তে একটা মেরিন একাডেমী আছে, যা সোভিয়েত স্ট্রাটেজিক ইন্টারেস্টের আওতায়। ওখানে গোপন কি সব গবেষণা হয়। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে একজন স্বদেশীকে এখানে জায়গা দিতে রাজী হয়েছিল সোভিয়েত সরকার। এবং এ ব্যাক্তি বরিশালের জয়নাল ভাই! চলাফেরা সীমিত। চাইলেই সব জায়গায় যেতে পারেন না। কম্যুনিজমের গ্যাঁড়াকলে বন্দী একজন বাংলাদেশি।