অপরাধ ও শাস্তি...সুন্দ্রাটিকির বাচ্চু মিয়া ও ঢাকার বখতিয়ার আলম রনি!

Submitted by WatchDog on Saturday, February 27, 2016

Crime

পাঠকদের কি মনে আছে বখতিয়ার আলম রনির কথা? এই সেই রনি যে কিনা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গত বছরের ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে প্রাডো গাড়ি থেকে তাঁর পিস্তল দিয়ে চার-পাঁচটি গুলি ছোড়েন। এতে রিকশাচালক আবদুল হাকিম ও দৈনিক জনকণ্ঠর অটোরিকশাচালক ইয়াকুব আলী আহত হন। হাকিম ১৫ এপ্রিল ও ইয়াকুব ২৩ এপ্রিল মারা যান। আরেকটু খোলাসা করলে ব্যপারটা এ রকম দাঁড়ায়; ইয়ার দোস্তদের নিয়ে মহিলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও তথাকথিত সাংসদ পিনু খানের সন্তান বখতিয়ার আলম রনি স্থানীয় বারে পানাহার শেষে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাস্তায় বের হন। সাথে ছিল সাংসদ সুবিধায় কেনা মার প্রাডো গাড়ি ও লাইসেন্স করা পিস্তল। ইস্কাটন এলাকায় আসতেই আটকে যান থমকে যাওয়া ট্রাফিক জ্যামে। মা'র ক্ষমতায় বলিয়ান এ 'মহামানবের' পছন্দ হয়নি এ জ্যাম। অস্থির হয়ে অপেক্ষা করেন কিছুটা সময়। এক সময় উপায় নে দেখে কোমর হতে বের করে আনেন লোডেড পিস্তল এবং এলোপাথাড়ি গুলিতে প্রকাশ করেন নিজের বিরক্তি। সমস্যা দেখা দেয় অন্য জায়গায়; ছোড়া গুলিতে মারাত্মক আহত হয় 'উটকো ঝামেলার' দুই স্বদেশী। একজন রিকশাচালক ও অন্যজন যাত্রী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীক্ষিত একজনের হাসিনা সৈনিকের হাতে কোথাকার কোন রিকশাওয়ালারা প্রাণ হারাবে আর তা নিয়ে থানা-পুলিশ অথবা মিডিয়া মাথা ঘামাবে এতটা অকৃতজ্ঞ নয় এ জাতি। তাই সাংসদ পুত্রের এ মৃগয়া নিধন চেতনা নামক পাহাড়ের তলায় চাপা পরে যায় প্রকৃতির নিয়মে। তবে বাধ সাথে নষ্টের গোঁড়া সেই সোশ্যাল মিডিয়া। হা-ভাতে দলের অনেকের হাতেই আজকাল স্মার্ট ফোন দেখতে পাওয়া যায়। অসময় ও অপ্রয়োজনে এসব 'উটকো ঝামেলা'র দল যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় এবং ফ্রেম-বন্দী করে ফেলে মহামান্য মন্ত্রী, এম্পি তথা তাদের চৌদ্দ গুষ্টির মার্জনীয় অপরাধ। যথারীতি ফ্রেম-বন্দী হয় রনির বাংলাদেশ নামক ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্টের কাউবয় এডভেঞ্চার। ফেসবুকে মহামারীর মত ছড়িয়ে পরে এ 'গৌরবোজ্জ্বল' অধ্যায়। পাবলিক নামক নাছোড়বান্দাদের খুশি করতে পুলিশের মেহমানিতে ঘর-বন্দী করা হয় জাতির এ 'সূর্যসন্তান'কে। দুদিন পর পুলিসি মেহমানখানার স্যঁত স্যঁতে পরিবেশ হতে মুক্তি দিতে স্থানান্তর করা হয় তারই আদর্শ গুরুর নামে স্থাপিত হাসপাতালে। ওখানে ডিভিশন দিয়ে রাষ্ট্রীয় এ অতিথিকে দেখানো হয় যথাযথ সন্মান। আমি আপনি যখন এ লেখাটা পড়ছি আদর্শের সৈনিক রনি তখন হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে উপভোগ করছেন সরকারী মেহমানদারীর যাবতীয় সুবিধা। বলাই বাহুল্য, ইখতিয়ার উদ্দিন বিন মোহম্মদ বখতিয়ার খিলজির মত এ বখতিয়ারের হাতও লম্বা। এতটাই লম্বা যার কারণে রক্তের নদীতে প্রমোদ-তরী ভাসিয়েও খুলতে পারেন থানা-পুলিশ, জেল-হাজতের দরজা। এর জন্য তাকে হাত ব্যবহার করতে হবে এমন কোন বাধ্য বাধকতা নেই। উনি শুধু বলেন 'হও', আর তাতেই হয়ে যায়।

সিলেটের হবিগঞ্জ। হবিগঞ্জের বাহুবল। এবং বাহুবলের সুন্দ্রাটিকি গ্রাম। ক'দিন আগেও এ গ্রাম ছিল আর দশটা গ্রামের মতই অজানা, অচেনা, অখ্যাত। কিন্তু তা বদলে দিয়েছে জনৈক আব্দুল আলী বাগাল ও তার দলবল। সুন্দ্রাটিকি গ্রামেও রাজত্ব করত চেতনা। তবে এ চেতনার সাথে মুক্তিযুদ্ধ চেতনার যোগসূত্র না থাকায় থানা-পুলিশদের মাথা ঘামাতে কোন অসুবিধা হয়নি। গ্রাম্য পঞ্চায়েতের আধিপত্য, অহমিকা ও প্রতিশোধ পর্ব সমাধা করতে গিয়ে বাগাল ও তার পরিবার পশুর মত হত্যা করে বৈরী প্রতিবেশীদের চার অবুঝ শিশু। গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে ভোতা অস্ত্র দিয়ে শরীর ক্ষতবিক্ষত করতে বিবেকের কাছে এতটুকু জবাবদিহি করতে হয়নি এসব নরপশুদের। রনির খুন এডভেঞ্চারের মত এ খুনও কালবৈশাখীর তাণ্ডব বইয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। গোটা জাতি শিউরে উঠে বাগাল পরিবারের লোমহর্ষক কাহিনীর সাথে পরিচিত হয়ে। হায়েনার মত শুকে শুকে একে একে সবাইকে খাচাবন্দী করে পুলিশ। সহযোগী বাচ্চু মিয়াকে দেয়া হয় 'স্পেনসর ফর হায়ার' কায়দায় সৃষ্ট 'হায়ার ফর মার্ডার'এর বীর সেনানী র‍্যাবের হাতে। একদিন পর তারা বাচ্চু মিয়াকে নিয়ে যায় বধ্যভূমিতে এবং মধ্যরাতের গভীর অন্ধকারে দুহাত দূর হতে অটোমেটিক রাইফেলের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় তার বুক। রাত পোহাবার সাথে জাতিকে উপহার দেয়া হয় বাচ্চু মিয়া নাটক। নাটকের বাচ্চু মিয়াকে দুদিন আগেই নেয় হয়েছিল কিলিং মেশিনের আওতায়। কিন্তু তথ্যটা গোপন রাখা হয়েছিল হয়ত 'ন্যাশনাল সিকিউরিটির' কথা ভেবে। চার খুনের আসামী বাচ্চু মিয়া নাকি প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আঁটছিল। তাই সময়ের দাবী পূরণ করতে র‍্যাবের বীর সেনানীরা বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। ওদিকে ওঁত পেতে থাকা বাচ্চু ডিভিশনের বাকী সৈনিকেরাও কম যায়নি। তারাও না-কি 'আধুনিক' অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল কিলার মেশিনের বিরুদ্ধে। শেষপর্যন্ত দুই মেরুর দুই চেতনা সৈনিকদের যুদ্ধে প্রাণ হারায় বাচ্চু মিয়া। বাচ্চু মিয়া এন্ড গং যে কায়দায় চার শিশুকে হত্যা করে মাটিতে পুতে রেখেছিল একই কায়দায় রাষ্ট্রও বাচ্চু মিয়াকে হত্যা করে পুতে রাখে খোলা আকাশের নীচে। নষ্ট জাতির নষ্ট মগজের অনেকেই হয়ত আনন্দিত হয়েছে বাচ্চু হত্যাকাণ্ডে। বিরাট সংখ্যার জনগণ ধরে নেবে অপরাধ ও হত্যা পর্বের কাঙ্ক্ষিত সমাধান করেছে রাষ্ট্রীয় কিলিং মেশিন। ঘরে ঘরে প্রশংসার প্লাবন বয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা। বিচার ব্যবস্থার স্থায়ী পঙ্গুত্বের যুগে বিনা বিচারে হত্যা নিশ্চয় তড়িৎ বিচারের ছায়া খুঁজে পেয়েছে জাতি। রাতের আধারে হত্যা মামলার আসামীকে বিনা বিচারে হত্যার নাম যদি বিচার হয় তাহলে বাগাল পরিবার ও রাষ্ট্রের মাঝে তফাৎটা রইল কোথায়? আব্দুল আলী বাগালও বিচারের রাস্তা খুঁজছিল এবং তা যথাসম্ভব দ্রুত। তাকে নাকি বৈরী পঞ্চায়েতের লোকজন অপমান করেছিল। বিচার হিসাবে বাগাল গং চার অবুঝ শিশুকে পুড়িয়ে ফিরিয়ে দেয় প্রতিশোধ পর্ব। রাষ্ট্র কি বাচ্চু হত্যার মাধ্যমে একই কাজ করেনি?

বিনা বিচারে হত্যাই যদি রাষ্ট্রীয় বিচারের ফয়সালা হয় তাহলে আর হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টের মত মাথাভারি কোর্টের প্রয়োজনটা কোথায়? সরকারের ধারক বাহক এসব কোর্ট একই অপরাধে বখতিয়ার আলম রনিকে পাঠাচ্ছে হাসপাতাল নামক রাষ্ট্রীয় মেহমান খানায় আর বাচ্চু মিয়ার খুন মেনে নিচ্ছে পবিত্র দায়িত্ব হিসাবে। আমারা হয়ত ভুলে যাই আব্দুল আলী বাগালদের জন্ম কিন্তু রাষ্ট্রের অপশাসন, কুশাসন, লুটপাট, হত্যা, গুম আর বিচার ব্যবস্থা ধ্বংসের জরায়ুতেই। রাতের আধারে র‍্যাব নামক কিলিং মেশিন দিয়ে একজন বাচ্চুকে খুন করালেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে এমনটা যারা ভাবেন তারা দলকানা জলদাস বৈ অন্যকিছু নন। বাচ্চু মিয়ার অবৈধ হত্যার রক্তেই জন্ম নিচ্ছে আরও দশটা বাচ্চু মিয়া। পাশাপাশি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে লালিত রনিদের রক্ত হতে গজাচ্ছে এমন সব অপরাধী যারা কেবল খুন করেই ক্ষান্ত থাকছে না, সাথে লুটে নিচ্ছে রক্ত, মাংস, হাড্ডি... সহ রাষ্ট্রের গোটা শরীর।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/783220/

ভালো লাগলে শেয়ার করুন