চারদিকে শুনশান নীরবতা। যতদূর চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড়। তামাটে পাহাড়ের বুকে অমল ধবল তুষার। শীতের তীব্রতায় পৃথিবীর এ অংশের জনজীবন থমকে যায়। লস আলামোস। নিউ মেক্সিকোর অঙ্গরাজ্যের উত্তর দিকের একটি ছোট শহর। ওখানে পৌঁছতে উচ্চতা ডিঙ্গাতে হয়। পাহাড়ের বুক কেটে তৈরি করা বিপদজনক রাস্তা পাড়ি দিতে বুকের পাটা শক্ত রাখতে হয়ে। তুষার জমে বরফ হয়ে গেলে ওপথে ড্রাইভ করা বিপদজনক। গাড়ির স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সান্তা ফে হতে এক ঘণ্টার জার্নি। এক সপ্তাহের জন্য দায়িত্ব নিতে হয়েছে কলিগ ও বন্ধু ডেভিড ছুটিতে যাওয়ার কারণে। এটমিক সিটিতে মানুষ পায়ে হাটেনা। বিলাস বহুল গাড়ির ছড়াছড়ি। জনসংখ্যার আনুপাতিক হিসাবে এ শহরেই আমেরিকান মিলিওনিয়রদের সংখ্যা সবচাইতে বেশি। হতে পারে শহরের কোলাহল হতে পালিয়ে থাকার নিরাপদ আশ্রয়। জন-মানবহীন রাস্তায় তাদের দুজনকে দেখে ব্রেক কষলাম। পথ না হারালে এ পথে কারও হাঁটার কথা নয়। - পথিক, তোমরা কি পথ হারিয়েছ? কিভাবে উপকারে আসতে পারি? - ন্যাশনাল ল্যাবের রাস্তাটা খুঁজছি। হাতের ম্যাপটা কাজে দিচ্ছেনা। লোকাল ট্রান্সপোর্ট বলতেও কিছু দেখছিনা। - চাইলেও গাড়িতে তোমাদের উঠাতে পারছিনা। অফিসের নিয়ম। একটু হাঁটতে হবে। সামনের বাঁকটা পার হলেই দেখা যাবে ল্যাবের প্রবেশপথ। কি মনে করে এ অচিন শহরে? - ছুটি কাটাতে। এসেছি দূরের দেশ জাপানের ওসাকা হতে। আমি হিদাকি এবং এ আমার বান্ধবী সাকিকো। সান্তা ফে হতে বাসে করে এসেছি। বিকেলের দিকে ফিরে যাব। - ওহো তাই! ওসাকা!! পনের বছর আগে দুদিনের জন্য গিয়েছিলাম ওখানটায়। তা তোমাদের হাতে সময় থাকলে চল কোথাও বসি। একটু হাঁটলে সামনে স্টারবাক্সের একটা দোকান পরবে। ওখানটায় অপেক্ষা করবো তোমাদের জন্য । হিদাকি ও সাকিকো জুটির সাথে কফির আড্ডায় পরিচয়। এত জায়গা থাকতে সুদূর জাপান হতে জনশূন্য এ শহরে কেন এসেছে তার সঠিক উত্তর তাদের কাছে ছিলনা। থাকলেও হয়ত বলতে চায়নি। তবে কিছুটা হলেও আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। বিশেষ করে ন্যাশনাল ল্যাবের সন্ধানের কারণে। হিরোশিমা নাগাসাকি! পাহাড়ের নির্জনতায় লোকচক্ষুর অন্তরালে এ শহরেই বাস্তবায়িত হয়েছিল ম্যানহাটন প্রকল্প। এখানেই জন্ম নিয়েছিল আণবিক বোমা। হিরোশিমা নাগাসাকি ধ্বংসযজ্ঞের বীজ বপিত হয়েছিল ন্যাশনাল ল্যাবেরই সূতিকাগারে। - তোমাদের কাছের কেউ কি প্রাণ হারিয়েছিল? - না, তেমন কিছু নয়। আমরা এসেছি আসলে ইতিহাস হাতড়াতে। - জাতি হিসাবে মার্কিনীদের কতটা ঘৃণা তোমাদের অন্তরে? - আমরা নিজেরা ভিক্টিম নই। তাই ঘৃণা পোষণ করার মত স্মৃতি নেই আমাদের। তাছাড়া ঘটনা অনেকদিন আগের। জাতি হিসাবে আমরা কাটিয়ে উঠেছি সে ক্ষত। - শুরুটা তো ছিল তোমাদেরই। পার্ল হারবার ম্যাসাকার না হলে কে জানে হয়ত হিরোশিমা নাগাসাকি অধ্যায়েরই জন্মই হতোনা। - আমরা আসলে এসব নিয়ে ভাবিনা। যুদ্ধ আমাদের শিক্ষা দিয়েছে। সে শিক্ষা নিয়েই জাতি হিসাবে আমরা এগিয়ে গেছি। মার্কিনীদের জন্য আমাদের স্থায়ী কোন ঘৃণা নেই। থাকলে আমরা কোনদিনই বন্ধু হতাম না। ধ্বংসযজ্ঞের উপর দাঁড়িয়ে আমরা খুঁজে নিয়েছি বেচে থাকার পথ। সে পথে ঘৃণা নেই। আছে উন্নতির তাগাদা, ক্ষুধা। আজকের জাপান তারই প্রতিচ্ছবি। সমসাময়িক পৃথিবী অর্থনীতির পৃথিবী। পূঁজি হিসাবে এখানে আবেগের স্থান নেই, আছে পিছিয়ে পড়ার ধাক্কা। আমরা পিছিয়ে পড়তে রাজী নই। - হঠাৎ করে লস আলামোস আসা কেন? দেখার মত আরও অনেক জায়গা আছে এ দেশে। - জাপান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উপর আমরা একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। তাতে স্বাভাবিক নিয়মেই চলে আসছে হিরোশিমা নাগাসাকি অধ্যায়। কিছু ছবি দরকার। - তোমরা চাইলেই ল্যাবে ঢুকতে পারবে বলে মনে হয়না। আমি শহরের টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার। ন্যাশনাল ল্যাব আমাদের সবচাইতে বড় গ্রাহক। আমার প্রবেশও নিয়ন্ত্রিত। - আমরা যোগাযোগ করেই এখানে এসেছি। অনুমতি আছে আমাদের। - তাহলে তো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বন্ধু লরেনজোকে ফোন করে সাহায্য চাইলাম। সে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা ও আমাদের টেকনিশিয়ান। দু'মিনিটের ভেতর হাজির হল ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে। কথা দিল প্রয়োজনে সান্তা ফে পর্যন্ত নিয়ে যাবে তাদের। জাপান নিয়ে শহরের প্রতিটা মানুষের ভেতর বাস করে এক ধরণের দায়বদ্ধতা। তা হতে লরেঞ্জোও মুক্ত নয়। সেদিন ফেরার পথে হাদাকি সাকিকো জুটির কথাতেই আচ্ছন্ন ছিলাম সারাক্ষণ...আজকের পৃথিবী অর্থনীতির পৃথিবী, এখানে আবেগ কোন পুঁজি হতে পারেনা। তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, চেতনা, ৩০ লাখ...সবই কি তাহলে বিনিয়োগ!