কথা বাইরের কাউকে নিয়ে নয়। অধমের নিজের চক্ষুতে দেখা ও নিজের কানে শ্রবণ করা। ঘটনা একজন মহিলাকে নিয়ে। নির্দিষ্ট করে বললে একজন অথবা একাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি গৃহবধূকে নিয়ে। পৃথিবীর অর্থনৈতিক রাজধানী নিউইয়র্কের কুইন্স নামের এলাকা। বাইরের পৃথিবী হতে কাউকে চোখ বেঁধে এখানে ছেড়ে দিলে হঠাৎ করে তার বুঝতে অসুবিধা হবে সে কোথায়! একজন ভারতীয় ভাববে সে কেরালায় অথবা গুজরাটে। পাকিস্তানী ভাববে করাচীর কোন গলিতে। রুশ দেশের সের্গেই ভাববে হয়ত সেন্ট পিটার্সবার্গের নেভস্কি প্রসপেক্টে। এমনটাই কুইন্সের সার্বিক চেহারা। এলাকার ৫৯ স্ট্রীটের উপর দোতলা একটা বাড়ি। মালিক একজন বাংলাদেশি। দোতলা হলেও বেইসমেন্ট বলে মাটির নীচে আরও কিছু স্পেইস আছে যেখানে হিটার, ওয়াশিংমেশিন, ড্রায়ার সহ নিত্য ব্যবহারের যন্ত্রপাতি থাকার কথা। অন্য দশটা মালিকের মত এ বাড়ির মালিকও বেইসমেন্টকে ব্যবহার উপযোগী করে ভাড়া দিয়ে থাকেন। বেইসমেন্টের দুই রুমের এক রুমটায় আমি ভাড়া থাকি। অন্য রুমটা খালি। মালিক নিউ ইয়র্ক শহরের সফল ক্যাব চালক। দ্বিতীয় রুমটা তিনি কেন খালি রাখেন তা বুঝতে অবশ্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। নিয়মিত জুয়ার আসর বসে ওখানটায়। সে আড্ডার ভাড়া হতে যা আয় তা একজন রক্তমাংসের ভাড়াটে হতে অনেক বেশি। সপ্তাহে অন্তত একদিন কাজ শেষে ঘরে ফিরে মোকাবেলা করতে হয় এ ঝামেলা। বাড়িওয়ালা বিনয়ের সাথে ক্ষমা চেয়ে জানালেন পছন্দ না হলে যেন চলে যাই। যাওয়াটা খুব সহজ ছিলনা। তাই মেনে নিয়ে জুয়ার সাথে সহবাস শুরু করে দিলাম। ৮-১০ জন বাংলাদেশি ইয়োলো ক্যাব ড্রাইভার আড্ডার নিয়মিত গ্রাহক। শুরু হয় বিয়ার দিয়ে এবং শেষ হয় হোটেল হতে আনা গরম গরম বিরানি দিয়ে। কেউ হারে কেউ জেতে। এ নিয়ে তেমন কোন মাতামাতি নেই।
জুয়ার আসর, আসরের হৈচৈ অথবা সিগারেটের ধোঁয়া যতটা না বিরক্তিকর তাঁর চেয়ে ঢের বিরক্তিকর ছিল মোবাইল ফোনের বিরামহীন রিং। এবং তা মিনিটে মিনিটে। খেলোয়াড়দের দুয়েকজন সব সময়ই দাড়িতে থাকতো আমার দরজার সামনে এবং ফোনে কথা বলতো। ইচ্ছা করলেও তাদের ফোনালাপ এড়ানো সম্ভব ছিলনা। আলাপের প্রায় সবটাই তাদের স্ব স্ব স্ত্রীর সাথে। বেইসমেন্টের জুয়ার আসরে বসে অবলীলাক্রমে নিজের অবস্থান নিয়ে মিথ্যা বলে যেত। কখনো যাত্রী নিয়ে ট্রাইবরো ব্রিজের উপর, কখনো আবার লাগোয়ারডিয়া এয়ারপোর্টের ক্যাব লাইনে... এভাবেই ঘরে অপেক্ষমাণ স্ত্রীদের বুঝাতো নিজের প্রফেশনাল এক্টিভিটির গতিপথ। বাড়িওয়ালার একমাত্র সন্তানের জন্মদিনে সবাই একত্রিত হল সপরিবারে। আমিও সম্মানিত অতিথি হিসাবে যোগ দিলাম। স্ব স্ব স্ত্রীদের অনেককেই পরিচয় করিয়ে দিল আমার সাথে। জুয়ার আসরে বিয়ার হাতে যাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যায় করতে দেখি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম তাদের স্ত্রীদের সবার মাথায় হীজাব এবং সাথে দুই তিনটা করে সন্তান। আলাপচারিতায় বুঝা গেল অনেকেই উচ্চশিক্ষিত। রহস্যটা বুঝা গেল দুদিন পর।
নতুন দিন, নতুন আসর। অন্যদিনের মত আজও ফোন বাজছে এবং জুয়াড়ি অনর্গল মিথ্যা বলে যাচ্ছে। করিডোরে একজনকে পেলাম আলাপ শেষে ফিরে যাচ্ছে আড্ডায়। ব্যক্তিগত দুয়েকটা কথা শেষে করে বসলাম আসল প্রশ্ন:
- ভাই, আপনি এখানে অথচ এইমাত্র স্ত্রীকে বললেন কেনেডি এয়ারপোর্ট হতে যাত্রী নিয়ে নিউজার্সি যাচ্ছেন। নিয়মিত মিথ্যা বলছেন। রহস্যটা কি?
- জুয়ার ব্যাপার কি স্ত্রীকে বলা যায়। আর তা ছাড়া আমি কোথায় এ নিয়ে তার মাথা ব্যথা থাকার কথা নয়। দিনশেষে টাকাটা হাতে পেলেই যথেষ্ট।
- আপনার স্ত্রী তো দেখলাম খুব ধার্মিক, মিথ্যা বলতে খারাপ লাগেনা?
- আরে ধার্মিক তো তাকে আমি বানিয়েছি, খারাপ লাগবে কেন।
- একটু ব্যখ্যা করবেন কি?
- ভাই আপনার তো স্ত্রী নেই, তাই এসব বুঝবেন না।
- বুঝালে নিশ্চয় বুঝবো।
- আমার বউ জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট। উচ্চশিক্ষিতা। সুন্দরী। বিয়ে করে দেশ থেকে নিয়ে আসার পর প্রথম প্রথম খুব ভয়ে থাকতাম। এই বুঝি কারও দিকে চোখ ফেললো। ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। ঘরে বিশ-বাইশ ঘণ্টা একা রেখে ক্যাব চালানো অনেক ড্রাইভারই বৌ হারাচ্ছে। সমবয়স্ক একজনের হাত ধরে পালিয়ে যাচ্ছে। কাজে পাঠালে ওখানেও তৈরি করছে লাইলী-মজনুর উপন্যাস। তাই প্ল্যান করে নামিয়ে দিয়েছি ধর্মের রাস্তায়। নিয়মিত তাবলীগ করে।
- কিন্তু আপনার তো দুই সন্তান এবং তৃতীয় জনের অপেক্ষা করছেন। ধর্ম-কর্মের সময় কোথায়?
- টু এন্ড হাফ সন্তানও প্ল্যানের অংশ।
- কেমন করে?
- দেশ হতে আসার সাথে সাথে পেটে সন্তান ধরিয়ে দেই যাতে চোখ ও মন অন্যদিকে না যায়।
আমি একেবারে থ!
এর একমাস পরের ঘটনা। জমজমাট আসর চলছে। সাথে বিয়ার। সাথে মিথ্যা বলার ম্যারাথন। মূল দরজায় নক করছে কেউ। জুয়ারিদের কেউ শুনতে পাচ্ছেনা হৈচৈয়ের কারণে। আমিই খুলে দিলাম। কম করে হলেও তিন-চারজন মহিলা। আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রীতিমত ধাক্কা মেরে ঢুকে গেল। তারপরের ইতিহাস গুলশানের আর্টিজান অথবা শোলাকিয়ার ঘটনাকেও হার মানানোর ইতিহাস। বিপুল বিক্রমে পূর্ণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো 'জাপানি-ইতালিয়ান' স্বামীদের উপর। যাদের মাথায় চুল বলতে কিছু একটা ছিল তাদের বেশী ভুগতে হল। 'বাংলাদেশি' বলে আমাকে রেহাই দেয়া হল। শেষমেশ পুলিশ এসে তাদের 'থান্ডার কোল্ড' অপারেশনের মাধ্যমে থামাতে সক্ষম হল বাংলাদেশি মহিলা 'জঙ্গিদের'।