সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ, নব্য উপনিবেশবাদ, সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র, এ জাতীয় ঢাউস ঢাউস কিছু কথা বলে হাঁটু পানিতে আমাকে চুবিয়ে মারতে পেরেছেন অনুভব করতে পেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন। বলাই বাহুল্য মহামান্য এই তিনি বহু-ঘাটের পোড়-খাওয়া একজন তামাটে বাম সেনা। অনেকটা অণু-পরমাণু, বিভাজন-সংযোজনার মত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বিশেষ একটা রাজনৈতিক দলের প্রথম সাড়ির নেতা। সংসার বলতে কেবল দুটো বেড়াল। তারাও বয়সের ভারে নুয়ে পরেছে। যে কোন সময় পাড়ি জমাবে না ফেরার দেশে। প্রায় অকৃতদার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। পাঁচ বছরের মাথায় সেটাও টেকেনি। দুই সন্তান সহ স্ত্রী অন্যের হাত ধরে পাড়ি জমিয়েছিলেন নতুন সাম্রাজ্যের সন্ধানে। তাও অনেকদিন আগের ঘটনা। এ নিয়ে আলোচনা করতে চান না তিনি। দেখা হলে আমার ১২ বছরের সোভিয়েত জীবন নিয়ে নানান প্রশ্ন করেন। আমিও আগ্রহ ভরে উত্তর দেই। অবশ্য আমার কোন উওরই তিনি বিশ্বাস করেন না। বলেন আমি নাকি পেটি-বুর্জুয়া সমাজের প্রতিনিধিত্ব। মিথ্যা আমাদের জাত স্বভাব। ওনার চোখে আজকের দুনিয়া খুবই বিষ্ফোরন্মুখ। এবং যে কোন সময় আগ্নেয়গিরির লাভা এসে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেবে। যেন-তেন লাভা নয়, সমাজতন্ত্রের লাভা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম মুখ আনার সাথে প্রায় ৩০ সেকেন্ড ব্যায় করেন অতিমানবীয় কিছু বিশেষণ সংযোগ করে। ওনার বেড়াল দুটোর অসুস্থতার জন্যও দায়ী করেন কথিত এই সাম্রাজ্যবাদী শয়তানকে। খুব দ্রুতই নাকি পতন আসছে তাদের। অনেকটা গণকের কায়দায় সময়, কালও বলে দিতে পারেন। বেশিক্ষণ তর্ক করলে ওনার হ্রদ-স্পন্দন বেড়ে যায়। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তাই ইচ্ছা সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রের উপর তর্কে জড়াতে চাইনা। ফ্যান্টাসি-ল্যান্ডে বাস করে কেউ যদি তৃপ্তি পায় সে তৃপ্তি হতে বঞ্চিত করার আমি কে! সেদিনও তাই হল। কথা আর স্বপ্নের সিঁড়ি ডিঙ্গাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলেন। কাজের বুয়া পড়িমরি করে ঔষধের কৌটাটা এগিয়ে দিল। ঔষধ খেয়ে কিছুটা শান্ত হলেন। বিছানার পাশে এলোমেলো টেবিলটায় পড়ে থাকা ঔষধের কৌটাটা নড়াচড়া করতে গিয়ে বুদ্ধিটা মাথায় এলো। প্রশ্ন করলাম, দাদা এই যে ঔষধ খাচ্ছেন জানেন তো কোথায় আবিষ্কৃত হয়েছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আপনার ছোট এই ঘরটার উত্তর-দক্ষিণ, পূব-পশ্চিম, ঊর্ধ্ব-অধঃ যে দিকেই তাকান সবখানেই সাম্রাজ্যবাদের প্রেতাত্মা। ব্যাপারটা এ রকম, ওরা কেবল যুদ্ধই করেনা, সমসাময়িক মানব সভ্যতার যতটুকু বিবর্তন প্রায় সবটাই তাদের অবদান। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, শিক্ষা, মানব সম্পদ উন্নয়ন সহ সমাজের সবকিছু এগিয়ে নেয়ার কাজে ওরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যায় করছে। ওরা আবিষ্কার করছে আর আমি আপনি তার সুফল ভোগ করছি। এমনকি আপনার বেড়াল-দ্বয়ও এর বাইরে নয়। তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিলেন, একেই বলে নব্য-উপনিবেশবাদ। এবং আমাকে থামিয়ে দিলেন এ বিষয়ে স্বল্প জ্ঞানের অভিযোগ এনে। বুঝালেন কি করে বিভিন্ন পণ্যের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের দোসররা দখল নিচ্ছে বাংলাদেশের মত উর্বরা দেশ গুলোকে। থেমে যাওয়ার মানুষ আমি নই। বিশেষ করে তা যদি হয় আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কন্ট্রাডিকশন। জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম, পণ্যই যদি হয় নব্য-উপনিবেশবাদের সংজ্ঞা, তাহলে হিসাব করুন আমেরিকায় তৈরি কটা পণ্য আপনি ব্যবহার করছেন, আর স্বপ্নের চীনে প্রস্তুত কটা ব্যবহার করছেন না। বরং আমরাই আমাদের পণ্য দিয়ে মার্কিন বাজার সয়লাব করছি। নব্য উপনিবেশবাদের আওতায় কাউকে লাইন-আপ করতে গেলে বাংলাদেশকে আনতে হবে প্রথম কাতারে। কারণ এ দেশের পণ্য এখন পৃথিবীর অনেক দেশে সূই হয়ে ঢুকছে আর সাপ হয়ে বের হচ্ছে। আবারও সীমিত জ্ঞানের অভিযোগ আনলেন। মহামতি লেনিন ও কার্ল মার্ক্সের মহান কিছু উক্তি সামনে তুলে ধরে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখালেন। এবং আমাকেও দেখতে বললেন। উত্তরে ওনার স্বপ্নের প্রশংসা করলাম। বললাম, স্বপ্নের নয়, বাস্তবের ও দেশে আমি ১২ বছর কাটিয়ে এসেছি।
হঠাৎ করে মোবাইলটা বেজে উঠায় তর্কে ইতি টানতে হলো। অনেকক্ষণ ধরে কার সাথে যেন কথা বললেন। শারীরিক ভাষা পড়েই বুঝে গেল অতি প্রিয় কারও সাথে। ক্ষণে ক্ষণে চেহারায় পরিবর্তন ধরা পড়লো। ফোনটা রাখলেও সুখের রেশ অনেকক্ষণ আটকে রইল সর্বাঙ্গে। মুখ বিস্মৃত হাসি দিয়ে জানালেন, ছোট মেয়ের ফোন। থাকে আমেরিকায়। বোস্টনের কোন এক ইউনিভার্সিটিতে মাইক্রোবায়োলজির উপর গবেষণা করছে।