১৯৭২ সাল হতে শুরু করে পরবর্তী প্রায় এক দশক বাংলাদেশ হতে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপক হারে ছাত্র পড়তে গিয়েছিল। শুরুটা ছিল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করে বাঘা বাঘা অনেক ছাত্র পাড়ি জমিয়েছিল পূর্ব ইউরোপের ঐ দেশটায়। ১৯৭৫ সালে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ভাটা লাগে সরকারী স্পন্সরে। শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসে দেশের সোভিয়েত ঘেঁষা রাজনৈতিক দলগুলো। অধ্যাপক মোজাফর আহমেদের ন্যাপ বোধহয় এ দৌড়ে কিছুটা এগিয়ে ছিল। মনি সিং'এর কম্যুনিস্ট পার্টিও পিছিয়ে ছিলনা। মেধা যাচাইয়ের কোন ক্যাটাগরিকে প্রধান্য দিয়ে ছাত্র বাছাই করা হয়েছিল তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য অন্তত আমার মত অনেকের কাছে ছিলনা। তবে এটাও সত্য পড়তে আসা সব ছাত্রই নিজেদের মেধার প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। হতে পারে তা অযোগ্যতা অথবা সামাজিক পট পরিবর্তনে নিজকে খাপ খাইয়ের নেয়ার ব্যর্থতা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ নামক দেশের চাঞ্চল্যকর একাডেমিক শুরুটা থিতু হয়ে আসতে সময় লাগেনি। সোভিয়েতরা বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো হতে কেন গণহারে ছাত্র আমদানি করতো তার বহুমুখী ব্যাখ্যা রয়েছে। সরকারী ব্যখ্যা হচ্ছে, বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোকে সাহায্য ও সহযোগিতা করা। নিন্দুকেরা অবশ্য অন্যকথা বলেন। তাদের ভাষ্য, ধোলাই পূর্বক মগজে সমাজতন্ত্রের বীজ বুনে তা দেশে দেশে রপ্তানি করাই ছিল সোভিয়েতদের মূল উদ্দেশ্য। পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার প্রশ্ন সামনে আনলে প্রথমেই আসবে বিনিময় বাণিজ্য। বাজার খুলে দিয়ে দুদেশের জনগণ তথা সরকারকে ব্যবসা করতে দিলে তা হয় সত্যিকার সাহায্য। তৎকালীন সোভিয়েত অর্থনীতির সে ক্ষমতা কতটা ছিল তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। বাংলাদেশের মত দেশের সাথেও তাদের বাণিজ্য ছিল বার্টার চুক্তি ভিত্তিক। অর্থাৎ পণ্যবিনিময়। সেই মোগল আমলের চালের বদলে ডাল বাণিজ্যের মতই ছিল সোভিয়েত বাণিজ্য। পণ্যের বিনিময়ে পণ্য। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এ ধরণের অর্থনৈতিক বিকাশ কতটা অসাড় ও অলৌকিক তার প্রমাণ ছিল সোভিয়েতদের দৈনন্দিন জীবন। খনিজ সম্পদের অফুরন্ত ভাণ্ডারের উপর ভাসমান সোভিয়েত দেশে একজন সুস্থ মানুষকে তার প্রত্যাহিক জীবনে একটা বিশাল অংশ ব্যায় করতে হতো চাল-ডাল-তেল আর নুনের সন্ধানে। সেন্ট্রালাইজড বিপণন ব্যবস্থা কেবল অর্থনৈতিকভাবেই দেশটাকে দুর্বল করেনি, বরং কোমর ভেঙ্গে দেয় মেধা বিকাশের রুশ ঐতিহ্যে। পুশকিন, চেখভ, দস্ত্যায়েভস্কি আর টলষ্টয়ের দেশে বলশেভিক শাসন জন্ম দিতে পারেনি সমপর্যায়ের নতুন কোন প্রতিভা। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের আহারের সন্ধানে পথে নামিয়ে বহির্বিশ্বের সাথে বৈরিতার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল গায়ে সুপার পাওয়ার তকমা লাগিয়ে। অথচ কোন বিচারেই সোভিয়েতরা সুপার পাওয়ার হিসাবে গণ্য করার যোগ্যতা দেখাতে পারেনি। পশ্চিমা দুনিয়ার সাথে ঠাণ্ডা লড়াইকে যদিও সোভিয়েতরা বলত আদর্শিক, আসলে তা ছিল জনগণের সাথে প্রতারণা করার একটা মোক্ষম অজুহাত। সম্পদের সুসম বণ্টন বনাম চাহিদা ও চাওয়া পাওয়ার কল্পকাহিনী ফেঁদে জনগণকে মানসিক ও মানবিকভাবে পঙ্গু করার যে দৈত্যাকৃতি যন্ত্র দেশটার সচল ছিল তার নাম ছিল কম্যুনিস্ট পার্টি। ছোট একটা ঘটনা দিয়ে সমাপ্তি টানছি আমার লেখায়।
বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদ নামের একটা সাবজেক্ট আমাদের সবার জন্য ছিল বাধ্যতামূলক। বিষয়টার সমাপ্তি ছিল রাষ্ট্রীয় পরীক্ষার মাধ্যমে। বিশেষ একটা কমিশনের সামনে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলেই কেবল প্রফেশনাল লাইনের বাকি পরীক্ষা সমাধা পূর্বক বিশেষজ্ঞ হওয়ার সুযোগ ছিল। এ পরীক্ষায় ফেল তো সোজা দেশে ফেরত! ক্লাস চলছে সাম্যবাদের। হরেক রকম কল্পকাহিনী সাজিয়ে শিক্ষক অনেকটা হুমকির সূরে ঘোষণা দিলেন এমন দিন খুব একটা দূরে নেই যেদিন গোটা বিশ্ব চলে আসবে সমাজতান্ত্রিক সমাজের আওতায়। এবং পাশাপাশি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। দেশ হতে উঠে যাবে মনিটরি সিস্টেম। অর্থাৎ টাকা পয়সার ব্যবহারের আর দরকার হবেনা। আমার প্রয়োজনে আমি দোকানে যাব এবং চাহিদা মত পণ্য উঠিয়ে আনবো। আমার মাথায় দেখা দিল আউলা চক্কর। হাত তুলে শিক্ষককে প্রশ্ন করতে চাইলাম। শিক্ষক থামলেন ঠিকই কিন্তু আমাকে প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলেন; তুমি কি বাংলাদেশের ছাত্র? হ্যাঁ বলতে খেঁক খেঁক করে হেসে উঠলেন। জানালেন আমাদের অনেকের সাথে নাকি অতীত তর্কাতর্কির অভিজ্ঞতা আছে। তাই বাকিদের সামনে এর উওর দিয়ে সময় নষ্ট করতে অপরাগতা প্রকাশ করলেন। বিরতিতে কথা বলার আমন্ত্রণ জানালেন। কথা হল বিরতিতে।
- তুমি কি মুসলমান?
- জন্মগত-ভাবে নিশ্চয়। কিন্তু এরসাথে সাম্যবাদের সম্পর্ক কোথায়? আমি জানতে চাই দেশ হতে রুবেল উঠে গেলে বিদেশের সাথে বিনিময় বাণিজ্য হবে কোন পদ্ধতিতে?
- তোমাদের ধর্মে আছে মৃত্যুর পর মমিন মুসলমানদের হুর-পরী দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে। তাই বেশি বেশি ধর্মকর্ম করা বাধ্যতামূলক। আমি এতক্ষণ যা পড়ালাম তা অনেকটা হুর-পুরী পাওয়ার মতই দিবাস্বপ্ন। গোটা দুনিয়ায় কোনদিনই সমাজতন্ত্র কায়েম হবেনা। এসব কথা নিতান্তই ঠকবাজী, যার সুফল ভোগ করছে দলীয় নেতারা। সমাজতন্ত্র হচ্ছে একটা ধর্ম। আর মনিটরী প্রথা বিলোপের কাহিনী হুর-পরী কাহিনীর মতই অলীক ও অবাস্তব। উপসংহারে হুশিয়ার করে দিল ডিগ্রীটা ভালয় ভালয় শেষ করতে চাইলে নীরবে হজম করতে হবে এ কাহিনী। কোন প্রশ্ন নয়, প্রতিবাদ নয়...