ট্রাম্প কাহিনী...
জুলাই, ২০১৬ সাল। লন্ডন। প্রতিবারের মত সেবারও পর্যটকরা ভীড় জমাচ্ছে টেমস পাড়ের ঐতিহাসিক নগরীতে। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। বিরামহীন সে মনুষ্য স্রোতকে আসুন অক্সোফোর্ড স্ট্রীট ও পিকাডেলি সার্কাস গড়িয়ে নিয়ে যাই আপস্কেল এলাকার একটা শুঁড়িখানায়। খদ্দেরদের ভীড় সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে বার কর্তৃপক্ষ। বারের এক কোনায় নিভু নিভু আলোতে দুজন সাদা খদ্দের খুব নীচু গলায় কিছু একটা আলাপ করছে। যতই রাত গড়াচ্ছে কিছুটা কৃষ্ণ বর্ণের খদ্দের মদ্যপানের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রীক অরিজিনের এ খদ্দেরের নাম জর্জ পাপাডোপোলিস। টেবলের ওপাশে বসে আলেক্সজাণ্ডার ডাউনার। গ্রীক অরিজিন হলেও জর্জের জন্ম ও বাস আটালন্টিকের ওপারের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আলেক্সজাণ্ডার ডাউনার বৃটেনে হাই প্রোফাইল অস্ট্রেলিয়ান ডিপ্লোম্যাট। মাতলামির এ পর্যায়ে জর্জ পাপাডোপোলিস এমন একটা তথ্য প্রকাশ করবে যার কারণে আটলান্টিকের ওপারে বইতে শুরু করবে রাজনৈতিক ঝড়।
বলাই বাহুল্য গ্রীষ্মের এ সময়টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বইছিল নির্বাচনী বাতাস। দেশটার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুদলের মনোনয়ন নিয়ে একদিকে হিলারী ক্লিনটন এবং অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প স্ব স্ব এজেন্ডা নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে। আলোচ্য জর্জ পাপাডোপোলিস ট্রাম্প নির্বাচনী ক্যাম্পেরই বিদেশ বিষয়ক উপদেষ্টা। ঘটনাপ্রবাহে বৃটিশ এম আই ৬'এর গোয়েন্দা ক্রিস্টোফার ষ্টী্লের কাছে তথ্য আসে মার্কিন নির্বাচনে রুশ গোয়েন্দা সংস্থা হস্তক্ষেপ করার রাস্তা খুঁজছে। গোটা ব্যপারটা নিয়ে ষ্টীল একটা ডসিয়ে তৈরী করে যা পরে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার হস্তগত হয়। হোয়াইট হাউস হতে এফবিআইকে এলার্ট করা হয়। কিন্তু এফবিআই তাতে খুব কমই গুরুত্ব দেয়। ব্যাপারটা নজরে আসে আলেক্সজাণ্ডার ডাউনারের। অস্ট্রেলিয়ান এ ডিপ্লোম্যাট এফবিআই'এ কর্মরত পুরাতন এক বন্ধু্কে ফোন করে অবহিত করে জর্জ পাপাডোপোলিসের সাথে তার আলাপের সারমর্ম। যার সারমর্ম ছিল রুশদের কাছে হিলারী ক্লিনটনের জন্য ক্ষতিকর ব্যাপক তথ্য আছে, যা ট্রাম্প ক্যাম্পের কাছে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে। দুদিন পর ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কংগ্রেসের ড্যাটাবেজ হ্যাক করে রুশরা। চুরি করে নেয় হিলারী ক্লিনটনের হাজার হাজার ই-মেইল। ইতিমধ্যে সজাগ হয়ে উঠে এফবিআই। তার ট্রাক করতে সক্ষম হয় ট্রাম্প নির্বাচনী ক্যাম্পের অন্য এক সদস্য কার্টার পেইজের গতিবিধি। তারা আবিস্কার করতে সক্ষম হয় ট্রাম্প ক্যাম্পের এই হোমরাচোমরাকে রুশরা তাদের এজেন্ট হিসাবে নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করছে। এফ বি আই নিয়ম অনুয়ায়ী কোর্টের অনুমতি নিয়ে (ফাইজা ওয়ারেন্ট) কার্টারের গতিবিধি নিরুপনে সার্ভেলেন্স শুরু করে। ইতিমধ্যে নিউ ইয়র্কস্থ ট্রাম্প টাওয়ারে মঞ্চস্থ হয় অন্য এক নাটক। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দফতরে কর্মরত জনৈকা ল'ইয়ারের সাথে গোপন বৈঠকে মিলিত হয় ট্রাম্পের বড় ছেল এরিক ট্রাম্প, জামাতা কুশনার সহ আরও অনেকে। আলোচনার মূল বিষয়বস্তূ হ্যাক করা হিলারীর ই-মেইল। ধারণা করা হয় এ মিটিংয়েই দয়াকষাকষির মাধ্যমে ঠিক করা হয় চুরি করা ই-মেইলের মূল্য। এ মিটিংয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে উইকিলিক্স প্রকাশ করে দেয় কয়েক হাজার ইমেইল। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে আসতে থাকে ইমেইলের কনটেন্ট। এসব ইমেইলে এমন সব ব্যাক্তিগত তথ্য ছিল যা আমেরিকান ভোটারদের দ্বিধান্বিত করে ফেলে। এবং এর প্রভাব প্রতিফলিত হয় নির্বাচনী ফলাফলে। এক অর্থে এটাই ছিল মার্কিন নির্বাচনে রুশদের হস্তক্ষেপ।
এফ বি আই কখনোই পিছিয়ে আসেনি রুশদের সাথে ট্রাম্প ক্যাম্পের যোগাযোগের তদন্ত হতে। যার ফলে একে এক প্রাকশ হতে থাকে জড়িতদের নাম। প্রথম বিদায় নিতে বাধ্য হন ট্রাম্প মন্ত্রীসভার প্রধান সিকিউরিটি এডভাইজর মাইক ফ্লিন। প্রকাশ হয়ে যায় পুতিনের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের তথ্যাবলী। এটর্নী জেনারেলের সংম্পৃক্ততা প্রকাশ পাওয়ার পর তিনি বাধ্য হন রুশ অনুসন্ধান প্রক্রিয়া হতে সরে দাঁড়াতে। দায়িত্ব হতে সরিয়ে দেয়া হয় এফ বি আই প্রধানকে। কারন প্রধান কোমি ট্রাম্পের পক্ষ হয়ে অন্যায় কাজে সহযোগীতা করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। ইতিমধ্যে ফেডারেল কোর্ট রুশদের পক্ষ হয়ে কাজ করার জন্য ক্যাম্প প্রধান পল মেনাফোর্ট সহ আরও দুজনকে অভিযুক্ত করে, যাদের খুব শীঘ্রই বিচারের সন্মুখিন করা হবে। সাবেক এফ বি আই প্রধান মালারকে দায়িত্ব দিয়ে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিশন। এই কমিশন একে একে হাত বাড়াচ্ছে ট্রাম্প পরিবারের সবার দিকে। এবং সর্বশেষ টার্গেট হবেন খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বয়ং।
ডোনাল্ড জন ট্রাম্প। নামটা আমেরিকানদের জন্য নতু নয়। বহু বছর ধরে এই রিয়েল এস্টেট মোগলের নাম ঘুরাফেরা করছে মিডিয়াতে। ৬০'র দশকে ট্রাম্প ও তার পিতাকে অভিযুক্ত করা হয় বর্ণবাদের কারণে। ঐ সময়টায় ট্রাম্প সাম্রাজ্যের হোটেল গুলোতে কালো আমেরিকানদের ঢুকতে দেয়া হতোনা। তারপর তাকে আদালতে যেতে হয় ভূয়া ট্রাম্প ইউনিভার্সিটি খুলে শত শত ছাত্রের অর্থ আত্মসাতের কারনে। খবর বেরিয়েছি নির্বাচনকালীন সময়ে জনৈকা পতিতাকে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার দিয়ে মুখ বন্ধ করা হয়েছিল অতীতের অবৈধ সম্পর্ক প্রকাশ না করার শর্তে।
ট্রাম্পের সাথে রুশদের গোপন সম্পর্কের এখনো ধোয়াশা। তবে অনুমান করা হচ্ছে এর পেছনে রয়েছে ট্রাম্প পরিবারের সাথে রুশ সরকারের অর্থ লেনাদেনার ঘটনা। বলা খোদ ডোনাল্ড ছাড়াও তার ছেলে এরিক, মেয়ে, জামাতা জেরেড কুশনারকে রুশরা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দিয়েছে জার্মান ডইচে ব্যাংকের মাধ্যমে। রুশদের স্বার্থ এখানে ইউক্রেইন হস্তক্ষেপের কারনে মস্কোর উপর চাপিয়ে দেয়া পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধ। তারা ট্রাম্পকে নির্বাচিত হতে সহযোগিতা করেছিল এ অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার আশায়। এ ছাড়াও অনেকে আশংকা করছেন বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহন করতে মস্কোয় অবস্থানকালীন জনাব ট্রাম্প রুশ পতিতা নিয়ে হোটেলে সময় কাটিয়েছিলেন। ঐ সময় হয়ত রুশ গোয়েন্দারা তার অবৈধ সম্পর্কের ভিডিও করে থাকবে। এখানে হয়ত রুশদের ব্লাকমেইল জড়িত থাকতে পারে। এক কথায় চরিত্রহীন এই প্রেসিডেন্টের পৃথিবী ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। স্পশাল কমিশন রবার্ট মালার সুই হয়ে ঢুকে সাপের মত হিস হিস করছে ট্রাম্প পরিবারের ঘাড়ের কাছে। সামনের কয়েক মাস হবে আমেরিকান ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস। অনেকে আশংকা করছেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন যেপথে সমাহিত হয়েছিলেন একই পথে হাটছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার পরিবার।