একজন প্রতারক ও তার প্রতারণা!

Submitted by WatchDog on Wednesday, October 3, 2018

১৯৮১ সাল। স্থান নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের আটলান্টিক সিটি। কুয়াশার ফাঁক ফোকর গলে দিনের আলো মুখ খুলতে শুরু করেছে কেবল। পাপের এ নগরী এক অর্থে কখনো ঘুমায় না। জুয়ারিদের ভিড়ে ২৪ ঘণ্টা জমজমাট থাকে ক্যাসিনোর স্লট মেশিন গুলো। রুলেট ও পোকার টেবিল গুলোর আড্ডা একটু দেরী করে শুরু হয়। আটলান্টিক মহাসাগর হতে ভেসে আসা শো শো গর্জন আর ভেতরে জুয়ারিদের চাপা কোলাহল, সব মিলিয়ে পারফেক্ট একটা দিনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। পোকার অথবা রুলেট টেবিলগুলোর ব্যস্ততা শুরু হতে বেশ কিছুটা দেরী তখনও। সাধারণত জুয়ার এ দিকটা জমে উঠে রাত গড়ানোর সাথে পাল্লা দিয়ে। কিন্তু আজ কি এক অজানা কারণে একটা পোকার অসময়ে খোলা হয়েছে। জনশূন্য টেবিলের ডিলার বার বার হাতের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে এবং উদগ্রীব হয়ে চোখ ঘোরাচ্ছে এন্ট্রান্সের দিকে। লক্ষ্য করলে বুঝা হবে কারও অপেক্ষায় আছেন ভদ্রলোক। ঘণ্টা খানেক পর কালো একটা ক্যাডিলাক এসে থামল ভ্যালেট পার্কিংয়ে। রিসেপসনিষ্ট এগিয়ে এসে খুলে দিল কালো কাঁচের নীচে ঢাকা পড়া সামনের দরজা। মাথায় কাউবয় হ্যাট ও হাতে কালোমতো একটা ছড়ি নিয়ে গাড়ি হতে বেরিয়ে এলেন মধ্যবয়স্ক একজন। হাতের হাতব্যাগটা প্রয়োজনের চাইতেও বড় দেখাচ্ছে। সাধারণত জুয়ারিদের এ ধরনের ব্যাগ বহন করতে দেখা যায়না। ডান-বা না তাকিয়ে আগন্তুক সোজা চলে গেলেন পোকার টেবিলে। পকেট হতে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে তাতে আগুন ধরালেন খুব আস্তে ধীরে। বুঝাই যাচ্ছে কোন তাড়া নেই আগন্তুকের। এবার বেশ সতর্ক চোখে চারদিকে চোখ ঘোরালেন। কেউ লক্ষ্য করছে কিনা যাচাই বাছাই করলেন। সন্তুষ্ট হলেন চারদিকের পরিবেশে। এবার রহস্যময় একটা হাসি উপহার দিয়ে হাতের ব্যাগটা এগিয়ে দিলেন ডিলারের দিকে।

- না, তোমাকে গুনতে হবেনা। যাদের দরকার তারা আগেই গুনে নিয়েছে। পাক্কা ৩.৩৫ মিলিয়ন।'
- উপরের নির্দেশ আমি রাতেই পেয়েছি। তাই গোনা গুনতির ঝামেলায় যাচ্ছিনা। তা চিপসগুলোর কোন এমাউন্টের হলে আপনার সুবিধা হয়?
- তোমার তো তা আগ হতে জানার কথা, নতুন করে তা জানতে চাইছো কেন? কথা ছিল প্রতিটা চিপস ৫ হাজার ডলারের হবে। অবশ্য তোমাদের যদি এর চাইতে বড় কোন অংকের থাকে তাহলে আরও ভাল। কমের হলে বহনে অসুবিধা হবে।
- না, ৫ হাজার ডলারের চিপসই গুনে রাখা হয়েছে। আসুন হাতবদল করা যাক।

ডিলার ব্যাগ হতে টাকার বাণ্ডিলগুলো বের করে টেবিলের উপর রাখলেন। ভাব দেখালেন যেন তিনি গুনতে শুরু করেছেন। টেবিলের অন্যপাশের ভদ্রলোক দুহাত বাড়ালেন চিপসগুলোর দিকে। তিনিও গোনার ভাব করলেন। দুজনই যে অভিনয় করছেন তা কাছ হতে লক্ষ্য করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। মিনিট পনেরর ভেতর হাতবদল স্থায়ী হয়ে গেল। দুজনেই মুচকি হেসে বিড় বিড় করে কি যেন একে অপরকে বললেন। ভদ্রলোক খালি ব্যগটায় চিপসগুলো ভরলেন এবং হাতের কাউবয় হ্যাটটা আলতো করে মাথায় ঝুলিয়ে উঠে পরলেন। সোজা হাটা দিলেন অপেক্ষমাণ ক্যাডিলাকের দিকে। ভ্যালেট পার্কিয়ের হোষ্ট দরজা খুলে আহবান জানালেন সাইজে ছোট ও টেকো মাথার ভদ্রলোককে। আবারও মুচকি হাসি বিনিময় এবং এ যাত্রায় একে অপরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন। কালো ক্যাডিলাক নিকস কালো ধোঁয়া উড়িয়ে নিমিষেই মিলিয়ে গেল নিউ ইয়র্কের পথে।

এখানে এইমাত্র কি ঘটে গেল তা সীমাবদ্ধ ছিল হাতেগোনা কিছু বিস্বস্ত কর্মচারীর মাঝে। এবং তা লম্বা সময়ের জন্য। ১৯৮১ সালের এই ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে ২রা অক্টোবর, ২০১৮ সালে। দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক বছরের ইনভেষ্টিগেশনে বেরিয়ে এসেছে চমকপ্রদ এসব তথ্য। আটলান্টিক সিটির ট্রাম্পস ক্যাসেল টাওয়ার অর্থ সংকটে ধুকছে তখন। ব্যবসার অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। দেউলিয়া ঘোষণা সময়ের ব্যাপার মাত্র। দিনটা ছিল ব্যাংকের বেধে দেয়া শেষদিন। একদিন দেরী হলে ক্যাসিনোর মালিকানা চলে যাবে ব্যাংকের কাছে। মালিক ডোনাল্ড ট্রাম্পের কপালের কুচকি দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে দিন দিন। কোথাও কোন তলা না পেয়ে শেষপর্যন্ত হাত পাতলেন পিতা ফ্রেড ট্রাম্পের দিকে। ফ্রেড ছেলের বিপদের দিনে মুখ ফিরিয়ে নেবেন এমনটা যে হবেনা ডোনাল্ড তা জানতেন। ৩.৩৫ মিলিয়ন হলেই উদ্ধার পাওয়া যায় এ যাত্রায়। বাপ ছেলে মিলে অভিনব প্রতারণার আশ্রয় নিলেন অর্থ বিনিময়ের কাজে। মূল উদ্দেশ্য ট্যাক্স ফাঁকি। পিতা ফ্রেড যদি সরাসরি পুত্র ডোনাল্ডকে এ টাকাটা দিতেন তা হত ট্যাক্সের পরিভাষায় উপহার। যা মার্কিন ট্যাক্স আইনে শতকরা ৫১ ভাগ কর আরোপের যোগ্য। অর্থাৎ, ৩.৩৫ মিলিয়ন ডলারের সিংহভাগই চলে যেত সরকারী খাজাঞ্চিখানায়। প্রতারণার সূত্রপাত এখানেই। যে ভদ্রলোক ব্যাগে করে টাকাটা নিয়ে ক্যাসিনোতে প্রবেশ করেছিলেন তিনি ছিলেন পিতা ফ্রেডের বিশ্বস্ত লোক। ক্যাসিনোতে এমন একটা ভাব করলেন যেন তিনি জুয়া খেলতে এসেছেন। আর দশটা জুয়াড়ির মত টাকা দিয়ে চিপস কিনলেন। কিন্তু জুয়া খেলার ধারে কাছেও গেলেন না প্রি-প্লান মাফিক। ব্যাগ ভর্তি চিপস নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ক্যাসিনো হতে। ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আয় করলেন ৩.৩৫ মিলিয়ন এবং এ টাকা দিয়ে উদ্ধার পেলেন দেউলিয়া হতে। অথচ সত্যিকার এ অর্থে এ ছিল ছেলের জন্যে পিতার উপহার। সবকিছু পানির মত সহজভাবে সমাধা হয়ে গেল। মাঝখান হতে সরকার মহাশয় বঞ্চিত হলেন প্রায় ১.৭ মিলিয়ন ডলারের ট্যাক্স হতে। আমেরিকার আইনে এ ধরণের প্রতারণা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

কর্পোরেট আমেরিকায় ট্যাক্স প্রতারণা নতুন কোন ঘটনা নয়। হরহামেশাই তা ঘটছে। তবে যারা এসব করছে তাদের কেউই কোনদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া দূরে থাক স্বপ্ন দেখারও সাহস পায়না। অথচ একজন প্রফেশনাল প্রতারক এখন উন্নত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসে আছেন। সমস্যাটা এখানেই।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন