স্থানীয় একটা চ্যানেলে ঘণ্টা-খানেক ধরে ডকুমেন্টারিটা দেখলাম। এক নিঃশ্বাসে দেখার মত একটা উপস্থাপনা। থাইল্যান্ডের ১২ জন স্কুল বালক ও তাদের ফুটবল কোচকে গুহা হতে উদ্ধারের কাহিনী। জানা না থাকলে মনে হবে এডভেঞ্চার অথবা থ্রিলার জাতিয় হলিউডের নতুন কোন চমক। বাস্তব এ কাহিনী গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। মিডিয়া, খেলার মাঠ সহ এমন কোন ভেন্যু ছিলনা যেখান হতে হারিয়ে যাওয়া ১৩ জনের জন্যে প্রার্থনা করা হয়নি। দূরের দেশ ব্রিটেনের এক ডুবুরি প্রথম আবিষ্কার করতে সক্ষম হন হারিয়ে যাওয়া ১৩ জনের সবাই বেচে আছে। উদ্ধারকাজে অংশ ও সহায়তা করতে পৃথিবীর প্রায় সব কোনা হতে ছুটে আসে ডুবুরি, ডাক্তার, মনোবিজ্ঞানী সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। বিশ্বভাতৃত্বের অনুপম সমাহার ঘটে থাইল্যান্ডের মাটিতে। রাজনৈতিক, সামাজিক, আর্থিক, গায়ের রঙ, এথনিসিটির পার্থক্য ভুলে ডুবুরি, ফায়ার ফাইটার, ডাক্তার সহ সবাই ঝাঁপিয়ে পরে এক ও অভিন্ন মিশনে; দুর্গম ও কঠিন এক পথ পেরিয়ে ১৩ জনকে ডুবন্ত গুহা হতে বের করে আনা। শেষপর্যন্ত ওরা সফল হয়। একে একে উদ্ধার করা হয় ১২ জন কিশোরকে। এবং সবশেষে তাদের কোচকে। সবশেষে গুহা হতে বেরিয়ে আসেন উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া স্থানীয় ও বিদেশীরা। একই সময় মস্কোতে চলছিল বিশ্বকাপের ফাইনাল। আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফা ১৩ জনের সবাইকে আমন্ত্রণ জানায় ফাইনাল দেখার জন্যে। যদিও থাই সরকার তাদের যেতে দেয়নি স্বাস্থ্যের কথা ভেবে। আমাদের বসুমতী এখনো যে বাসোপযোগী একটি বিশাল পরিবার তার চমৎকার একটা ডিসপ্লে হয়ে গেল থাইল্যান্ডের দুর্গম গুহায়।
কি এবং কি ঘটেছিলো থাইল্যান্ডের গুহায় তা কমবেশি সবার জানা। এ নিয়ে নতুন কিছু লেখার নেই। লেখার তাগাদাটা আসলো অন্য একটা কারণে। থাইল্যান্ডে ডুবুরিদের সাফল্যে যখন গোটা-বিশ্ব হেসেছিল তৃপ্তির হাসি পৃথিবীর আরেক প্রান্তে মঞ্চস্থ হচ্ছিল অন্য এক ট্রাজেডি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনপুষ্ট সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহম্মদ বিন সালমানের যুদ্ধ-বিমান বোমা মেরে ছিন্নভিন্ন করছিল চল্লিশ জন ইয়ে্মেনী শিশুকে। ধর্ম নিয়ে আমাদের আবেগ, উচ্ছ্বাস আর গর্বের অন্ত নেই। বিশেষকরে সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটলে মনে হবে ইসলামই পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম যেখানে ন্যায় ও মানবতার মত উপাদানগুলো নিশ্চিত করা আছে। সৌদি আরব হচ্ছে সে ধর্মের ধারক ও বাহক। থাইল্যান্ডের গুহায় যখন বিশ্বমানবতা একহয়ে নিজদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে ব্যস্ত ছিল সেখানে শান্তি আর ন্যায়ের ধর্ম ইসলামের কোন প্রতিনিধিকে দেখা যায়নি। ওখানে যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পরেছিল আমাদের বিচারে তারা সবাই ছিল বিধর্মী, ইহুদি, নাসারা। আর ১.২ বিলিয়ন মানুষের ধর্ম ইসলামের রক্ষকরা তখন ব্যস্ত ছিল অসহায়, নিষ্পাপ আর ক্ষুধার্ত ইয়েমেনী শিশুদের হত্যাযজ্ঞে। এক সৌদিরাই যে এ পাপাচারে ব্যস্ত ছিল তা নয়। তাদের ছিল কোয়ালিশন। প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাতও ছিল তাদের সাথে। আমিরাতের প্রিন্স মোহম্মদ বিন জায়েদ আর সৌদি প্রিন্স মোহম্মদ বিন সালমানের অভিন্ন দর্শনের বলি হয়ে শতাব্দীর সবচাইতে ভয়াবহ নির্মমতার শিকার হয়ে হাজার হাজার ইয়েমেনী প্রাণ হারাচ্ছে। প্রশ্ন আসবে কেন এই বর্বরতা?
আপনি যদি পশ্চিমা বিশ্বের বড় কোন জুয়ার আসরে ঢুঁ মারেন কো-জুয়ারি হিসাবে যাদের কাছে পাবেন তার আর কেউ নয়, গায়ে সাদা আলখাল্লা ও হাতে তসবিহ সহ সৌদি ও আমিরাতের ধনকুবের দল। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পতিতালয়ের মুল খদ্দেরও ওরা। পকেট-ভর্তি অর্থ নিয়ে ওরা পাড়ি দেয় আরব সাগর। নিজেদের পাপাচার হালাল করার জন্যে কাজী ডেকে একরাতের জন্যে বিয়ে করে নাবালক কিশোরীদের। ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন কোনায় ভাসমান বিলাসবহুল প্রমোদতরীগুলো থামিয়ে আপনি যদি উঁকি মারেন দেখবেন আল্লার ঘর রক্ষকদের আসল চেহারা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই পাপাচারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্যেই ইয়েমেন যুদ্ধ। ইয়েমেনের বিদ্রোহী হুতিরা ইরানের সহায়তায় যুদ্ধ করছে তাদের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে। এই ইরানই হচ্ছে সৌদি ও আমিরাতি রাজা-বাদশাহদের সিংহাসন টলিয়ে দেয়ার একমাত্র হুমকি। ইরান গণতান্ত্রিক দেশ। সেখানে নির্বাচন হয়। জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে তাদের প্রতিনিধি। সৌদি ও আমিরাতিদের ভয় এখানেই। গণতন্ত্র মানে রাজতন্ত্রের কবর। জুয়া, মদ আর পতিতা-সেবী সৌদি ও আমিরাতি রাজা ও রাজপুত্রদের তখত তাউস তাসের ঘরের মত ভেসে যাবে যেদিন গণতন্ত্র পা রাখবে তাদের মাটিতে। এ ভয় হতেই এক হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের একদল লম্পট। যেখানেই ইরানী গন্ধ সেখানেই বাজপাখির মত হামলে পরছে ওরা। ধর্মীয় লেবাসের এসব লুচ্চাদের লুচ্চামির ফসল ঘরে তুলছে আরেক লুচ্চা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প সাম্রাজ্যের যখন নিভু নিভু অবস্থা তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছিল সৌদি প্রিন্সরা। উদ্ধার করেছিল দেউলিয়া হওয়ার রাস্তা হতে। ট্রাম্প হোটেলগুলোর অন্যতম খদ্দের সৌদি রাজপরিবার। পকেট-ভর্তি প্রেট্রোডলার নিয়ে ওরা আসে মার্কিন মুলুকে। জুয়া, মদ আর মেয়ে মানুষ নিয়ে নিরাপদে উপভোগ করে যায় পশ্চিমা জীবন। সৌদি-আমিরাতি প্রিন্সদের এই সিন্ডিকেটে ইদানীং যোগ হয়েছে নতুন এক প্রিন্স, জেরেড কুশনার! প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কন্যা ইভাঙ্কার স্বামী। ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক জামাল খাসোগীকে বিদেশী কনস্যুলেটে হত্যা ও এসিড দিয়ে গলিয়ে ড্রেনে ভাসিয়ে দেয়ার মত নিকৃষ্ট অপরাধের পরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট কিছু বলা ও করার মত সাহস পাননি এক কারণে, লেনাদেনা। তবে দিন ঘনিয়ে আসছে। ছোট হয়ে আসছে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সৌদি রাজা-বাদশাহদের হানিমুন। জানুয়ারিতে মার্কিন কংগ্রেসের এক কক্ষে ক্ষমতা নিতে যাচ্ছে প্রতিপক্ষ ডেমোক্রেটরা। জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।