পারফেক্ট না হলেও অংকে একেবারে কাঁচা ছিলাম না। বিশেষ করে প্রাইমারী ও স্কুল লেভেলে। তো একটা অংক মাঝে মধ্যে মগজে চেপে বসে। মুখে মুখে সমাধানের চেষ্টা করেও কামিয়াব হতে পারিনি। ক্যালকুলেটরের প্রয়োজন হয় বিধায় এ নিয়ে বিশেষ ঘাটাঘাটি করিনি। এত সময় কোথায়! আমার হয়ত সময়ের একটু টানাটানি থাকতে পারে, তাই বলে সবার যে একই অবস্থা তা বলা যাবেনা। এই যেমন বাংলাদেশের চেতনাও-গ্রস্ত নতুন প্রজন্মের লাখ লাখ আদম সন্তান। যে অংকটার কথা বলতে যাচ্ছি তা কাগজে কলমে দূরে থাক, মুখে উচ্চারণ করাও দণ্ডনীয় অপরাধ। বাংলাদেশের ভেল্কিবাজির সরকার তা আইন করে নিষেধ করে দিয়েছেন। যেহেতু 'ভাল্লাগে, খুশির ঠেলায়, ঘোরতে...' সরকারের লম্বা হাত আমার পর্যন্ত পৌছতে সাতসমুদ্র তের-নদী পাড়ি দিতে হবে, তাই নিজকে অনেকটাই নিরাপদ বোধ করতে সাহস করি। অবশ্য লন্ডন হতে তারেক জিয়াকে ধরে আনতে তেরেসা মে'র সরকারের সাথে চুক্তির মত আমাকে ধরতে ডোনাল্ড ট্রাম্প এন্ড গংদের সাথে যদি চুক্তি করে ফেলে তাহলে হালুয়া টাইট! যদিও বাইন মাছের মত ট্রাম্প সরকারের খপ্পর হতে ফসকে যাওয়ার অনেক রাস্তা আমার সামনে খোলা থাকবে। আপাতত আমি আমার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব শহরের বুক চীরে বয়ে যাওয়া রিও গ্রান্ডে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি। তাই এ নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। আসুন অংকটার দিকে চোখ ফেরাই।
১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে কতজন প্রাণ হারিয়েছিল?
আমরা যারা ৭১'কে জাফর ইকবালদের মত খাটের তলায় লুকিয়ে থেকে কাটিয়ে দিয়েছি তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানেই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের 'চরমপত্র', টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীর বীরত্ব কাহিনী আর বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠানের মরহুম সেরাজুর রহমানের উপস্থাপিত 'প্রবাহ' অনুষ্ঠান। খাটের তলার পৃথিবী হতে এসব শুনতে কোন বাধা ছিলনা। সেরাজুর রহমান ছিলেন শেখ মুজিবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজনদের একজন। ভদ্রলোকের স্মৃতিচারণ হতে জানা যায় পাকিস্তান হতে দেশে ফেরার পথে লন্ডনে যাত্রাবিরতির সময় একজনের সাথে আরেকজনের দেখা হয়েছিল। লন্ডন প্রবাসী রহমানের কাছেই নাকি পাকিস্তান প্রবাসী রহমান জেনেছিলেন '৭১'রে বিভীষিকার কথা। বিবিসির প্রাথমিক হিসাব ছিল যুদ্ধে কম করে হলেও তিন লাখ বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছে। তো রাজনীতির ভালমন্দে তুষ্ট তুখোড় রাজনীতিবিদ শেখ মুজিব নিজের স্মার্টনেস প্রমাণের ধারাবাহিকতা হিসাবে লাখকে মিলিয়নে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নেন। লন্ডনের প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে আবেগঘণ কণ্ঠে ঘোষণা দেন ৩ মিলিয়ন স্বদেশী হত্যার খবর। লাখের ইংরেজি মিলিয়ন, এমনটাই নাকি ভেবেছিলেন শেখ মুজিব। সেরাজুর রহমান তাই সাক্ষী দিয়ে গেছেন। যেহেতু শেখ মুজিবের মুখ হতে বের হয়েছে, তার কোন হেরফের হওয়া মানে রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ।
এবার আসুন অংকের একটু গভীরে ডুব দেই। ৭১'এর পঁচিশে মার্চ হতে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বরকে দিনে রূপান্তর করলে তা হবে মোট ২৩৭ দিন। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ ২৩৭ দিন পাকিস্তানীদের আগ্রাসনে রক্তাক্ত হয়েছিল। ২৩৭দিন মানে ৫,৬৮৮ ঘণ্টা। আর মিনিটের হিসাবে তা হবে প্রায় ৩,৪১,২৮০ মিনিট। এবার আসুন হিসাব কষি মিনিটে কতজন প্রাণ হারিয়েছিল পাকিদের হাতে। ৩০ লাখকে বিবেচনায় নিলে তা হবে প্রায় ৮ জনের উপর। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে এদেশে ৮ জনের উপর কিছু মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে তা হবে শতকরা ৪ জনের মত। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনে ৪ জন। ৯০ হাজার পাকিস্তানী সেনার প্রত্যেকের হাত গড়ে ৩৩ জনের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। এখানে একটা প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক; ৬৮ হাজার গ্রামের দেশ বাংলাদেশের কটা গ্রামে পাকিস্তানিরা হানা দিয়েছিল। সব গ্রামেই কি তাদের রক্তাক্ত অধ্যায় প্রসারিত হয়েছিল? এমনটা আদৌ কি সম্ভব ছিল? যদি তা না হয়ে থাকে ধরে নিতে হবে প্রতিটা বিভাগীয়, জেলা ও থানা শহরে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছিল। যা যোগ করলে ৩০ লাখে দাঁড়াবে। এটাও কি সম্ভব ছিল? ৫৫ হাজার বর্গমাইলের একটা দেশে ৩০ লাখ লাশ কবর দিলে তাতে গোটা দেশ গোরস্তানে পরিণত হওয়ার কথা। অনেকে বলবেন সবাইকে কবর দেয়ার কোন সুযোগ ছিলনা। মেনে নিলাম এ তর্ক। তাহলে তো বড় বড় শহরের আনাচে কানাচে গণকবর কিলবিল করার কথা। কই, এমন কবর নিয়ে তো কেউ কোন কথা বলেনা। এসব কবরের উপর কেন কোন সমাধি তৈরি হয়না এ নিয়েও তো কেউ প্রশ্ন করেনা। বাস্তবতা হচ্ছে এ দেশে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারানোর কোন সুযোগ ছিলনা। কারও সন্দেহ থাকলে নিজ পরিবার হতে গোনা শুরু করার অনুরোধ করব। তারপর গুনতে যাবেন প্রতিবেশীর দুয়ারে। একে একে পাড়ায়, গ্রামে, শহরে, থানায়, জেলায়। আপনি যেতে পারবেন ৩০ লাখের কাছাকাছি? চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখের তালিকা তৈরির দাবি মুখে আনলে চেতনা-গ্রস্ত দলকানা কিন্তাকুন্তির দল আপনাকে ধূলিসাৎ করে ফেলবে। এখানেই প্রশ্ন আসে, কেন?
বিশেষ একটা রাজনৈতিক দলের জন্যে ৩০ লাখের সংখ্যাটা একটা ব্যবসা। অনেকটা লালসালু উপন্যাসের সালু কাপড়ের মত। কনটেম্পোরারি কনটেক্সটে তা হবে ইদানীংকালের গায়েবি মামলার মত। মিথ্যা সংখ্যার এ মহাসাগর নতুন প্রজন্মকে বিভক্ত করায় অত্যন্ত সফল রোডম্যাপ হিসাবে কাজ করছে। এবং তা আগামী হাজার বছর ধরে কাজ করে যাবে সন্দেহ নেই। এ জন্যেই প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ বিশেষ একটা রাজনৈতিক দলের জন্যে মৃত্যু পরওয়ানার শামিল।
বাস্তবতা হচ্ছে, এ দেশের একজন মানুষকেও হত্যা করার বৈধ ক্ষমতা ছিলনা জারজ পাকিস্তানিদের। তারা হত্যা করেছে এবং আমরা প্রাণ হারিয়েছি। এ অন্যায় কোন সংখ্যা দিয়েই আন্ডার-মাইন করার সুযোগ নেই। নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে বিনাবিচারে হত্যা করার শাস্তি জাতিসংঘের জেনেভা কনভেনশনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা আছে। ৯০ হাজার পাকিস্তানীদের কজনকে আমরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে দেখেছি? ইতিহাসে মিথ্যাচারের ঠাঁই স্থায়ী হয়না। আর এ মিথ্যাচার যদি হয় মানুষের লাশ নিয়ে। প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ কোন এস্ট্রোনোমিকাল সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সময় এখনো আমাদের আওতার মধ্যে আছে। চাইলে ঘরে ঘরে কড়া নেড়ে বেরকরে নিতে পারি পাকিস্তানী ও তাদের সহচরদের হাতে নিহতদের সংখ্যা ও পরিচয়। আর এ পরিচয়ের উপর দাঁড়িয়ে আমরা লিখতে পারি আমাদের সত্য ইতিহাস। বদলে দিতে পারি শহর বন্দরের নাম। প্রতিটি রাস্তার নামে যোগ করতে পারি শহীদদের নাম। তোতা পাখির মত ৩০ লাখ শহীদের একটা সংখ্যা আওড়ে প্রকৃতপক্ষে আমরা অপমান করছি তাদের যারা সত্যিকার অর্থে প্রাণ হারিয়েছিল।