আমেরিকার ব্যপার-স্যাপার সবসময়ই একটু আলাদা যা বুঝতে ও হজম করতে একটু সময় লা্গে। দেশটায় বাস না করলে তার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বুঝা একটু কষ্টকর। বিশেষকরে বাংলাদেশের মত মাসলকন্ট্রোলড রাজনীতির কনটেক্সটে। এই যেমন দেশটার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্টের সাথে কংগ্রেসের লড়াই। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্যে এখানে একসাথে কাজকরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট কংগ্রেস। সদ্য সমাপ্ত একটা লড়াইয়ের বর্ণনা দিলে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যাবে সত্যিকার গণতন্ত্র কিভাবে কাজকরে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় সরকার চালানোর জন্যে যে অর্থের দরকার হয় তা বরাদ্দের ক্ষমতা খোদ প্রেসিডেন্টেরও নেই। এই বরাদ্দের সূত্রপাত হয় কংগ্রেসের যেকোন একটা কক্ষে। অর্থাৎ হয় হাউস অব রিপ্রেজেনেনটেটিভে অথবা সিনেটে। প্রস্তাব পাশ হতে হাউসে দরকার হয় সাধারণ সংখ্যাগরিষ্টতার। ৪৩৫ সীটের অর্ধেকের বেশি ভোট পেলে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপর একই প্রস্তাব যায় সিনেটে। এখানে সদস্য সংখ্যা ১০০। সিম্পল মেজরিটি এখানে কাজ করেনা। তার জন্যে চাই ৬০টি ভোট। কাংখিত ভোট পাওয়া গেলেই প্রস্তাব পাশ হয়ে এবং তা ফাইনাল করার লক্ষ্যে পাঠানো হয় প্রেসিডেন্টের কাজে। প্রেসিডেন্ট স্বাক্ষর করলেই তা রাষ্ট্রের আইন অথবা এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ চূড়ান্ত হয়।
একমাস আগে ফেডারেল সরকারের তহবিল শেষ হয়ে যায়। সাড়ে আটলাখ কর্মকর্তা ও কর্মাচারীর বেতন পরিশোধে তহবিল ঘাটতি দেখা দেয়। যার আওতায় আসে দেশটার এফবিআই, সিআইয়ে, এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি সহ অনেক সংগঠন। বন্ধ হয়ে যায় পার্ক, চিড়িয়াখানা, লাইব্রেরী সহ অনেক প্রতষ্ঠান। স্বভাবতই প্রয়োজন দেখা দেয় নতুন বরাদ্দের। বলে রাখা ভাল, গেল নভেম্বরের মিড-টার্ম নির্বাচনের আগপর্যন্ত মার্কিন এক্সিকিউটিভ ব্রাঞ্চের সবকটা কক্ষ ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল রিপাব্লিকানদের দখলে। কিন্তু নভেম্বরের নির্বাচলে বদলে যায় সে সমীকরণ। হাউসে ব্যপক ব্যবধানে পরাজিত হয় রক্ষণশীল এই দল। ডেমোক্রেটিক কন্ট্রোলড হাউস প্রস্তাব করে নতুন বরাদ্দের। রিপাব্লিকানদের সিনেট ভোটেই পাঠায়নি সে প্রস্তাব। থমকে যায় ফেডারেল গভার্নমেন্ট। হাউসের স্পীকার ন্যনসি পলোসি ও সিনেটের সংখ্যালঘুদের নেতা চাক সুমের হোয়াইট হাউসে যান প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলতে। প্রেসিডেন্ট হুমকি দেন এমন কোন বিলে তিনি স্বাক্ষর করবেন না যে বিলে ভোটারদের কাছে তার নির্বাচনী ওয়াদা ইউএস-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মানের অর্থ থাকবেনা। এবং এ অর্থের পরিমাণ হতে হবে ৫ বিলিয়ন ডলার। ডেমোক্রেট দলীয় নেতারা প্রেসিডেন্টকে নিশ্চিত করেন এমন অর্থ কোনভাবেই তারা বরাদ্দ করেবনা। প্রেসিডেন্টও তার দাবিতে অনঢ়। শুরু হয় গণতান্ত্রিক ক্ষমতার টাগ অব ওয়্যার।
এবং এ লড়াই চলে এক মাসের উপর। নাটকের ক্লাইমেক্স চরমে পৌছায় যেদিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কংগ্রেস নেতাদের গোপন আফগানিস্তান সফরে সরকারী ট্রান্সপোর্ট সরবরাহে ভেটো দেন। তামাশা হিসাবে তিনি অপেক্ষা করেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। স্পীকার ন্যান্সি পলোসি সহ সবাই যখন এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা দিয়েছেন তখন হোয়াইট হাউস হতে ঘোষণা আসে, ফ্লাইট বাতিল! এমন ঘোষণা মার্কিন ইতিহাসে খুবই অস্বাভাবিক ও বিরল। ডোনাল্ড ট্রাম্প তৃপ্তির হাসি হাসেন আঘাত করতে পেরে। তবে প্রত্যাঘাত করতে হাউস স্পীকার বেশি দেরী করেননি। বছরের এ সময়টায় মার্কিন প্রেসিডেন্টরা কংগ্রেসের যৌথসভায় ভাষন দেন এবং ঐ ভাষণে নিজের সাফল্য ও ভবিষৎ কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। একজন প্রেসিডেন্টের জন্যে এটাই হচ্ছে সবচাইতে গৌরবময় মুহুর্ত। দেশের কোটি কোটি মানুষ সেদিন চোখ রাখে টেলিভিষনের পর্দায়। ন্যান্সি পলোসি ট্রাম্পের ইগোতে চরম আঘাত হেনে ঘোষণা দেন, যতদিন কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে ততদিন জনাব ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য কংগ্রেসের দরজা বন্ধ...এক কথায়, ...*এফ অফ মিঃ প্রেসিডেন্ট! ট্রাম্পের জন্যে এছিল গালে জুতা মারার শামিল। জীবনে তাকে এমন অপমান হজম করতে হয়েছে কিনা তা হয়ত ইতিহাসের বিষয় হয়ে থাকবে। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট হারাতে থাকেন পপুলার সমর্থন। নিজ কর্মকাণ্ডে মার্কিনিদের এপ্রুভাল রেটিং নেমে আসে শতকরা ৩৪ ভাগে। অর্থাৎ এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে ভোটারদের শতকরা ৩৪ জন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দেবে। যার প্রায় শতকরা ৯০ ভাগই চল্লিশার্ধ্ব সাদা ভোটার। অবস্থা বেগতিক তা বুঝাতে ব্যার্থ হয়ে তার কেবিনেট সদ্যসরা একে একে বিদায় নেন। হোয়াইট হাউসের এক নির্জন কক্ষে বসে একাধিক টিভির সামনে নিজের গুনকীর্তিন শোনায় অভ্যস্ত প্রেসিডেন্ট হতাশ হয়ে পরেন। নিজের অযোগ্যতা প্রমানে বার বার ঘোষণা দেন দরকার হলে বছর ধরে তিনি সরকার বন্ধ রাখবেন। সীমান্তে দেয়াল তৈরীর ৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ না দিলে দেশ অচল রাখবেন যতদিন দরকার হয়। বেতন না পেয়ে একে একে বেকে বসতে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীরা। হুমকি আসে ধর্মঘটের। বেতনের উপর নির্ভরশীল শত শত পরিবারের করুণ কাহিনী উঠে আসতে শুরুকরে প্রচার মাধ্যমে। দৈনিক ১২ ক্যান ডায়েট কোক পানকারী এই প্রেসিডেন্ট শেষপর্যন্ত হার মানতে বাধ্যহন ন্যান্সি পলোসির কাছে। তার স্বপ্নের দেয়ালে কানাকড়িও বরাদ্দ দেয়নি কংগ্রেস। সামনের ৩ সপ্তাহের জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের ফান্ড হাউসের দুই কক্ষই অনুমোদন করেছে। যদিও প্রেসিডেন্ট হুমকি দিয়েছেন ৩ সপ্তাহ পর তার ৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ না দিলে আবারও বন্ধ করে দেবেন ফেডারেল সরকার। ডেমোক্রেটদের একটাই কথা, সন্ত্রাষবাদীদের কায়দায় সাড়ে আটলাখ কর্মচারীর জীবন জিম্মি রেখে যে কোন দাবি আদায়ে তারা বিরোধীতা করবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্সিতে গবেষণার কোন সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের বয়স শত শত বছর। পৃথবীর সবচাইতে ক্ষমতাধর এই পদে একজন অযোগ্য, অপদার্থ, সাদা ন্যাশনালিষ্টকে বসিয়ে দিলে কি হয় তার ফল কিছুটা হলেও ভোগ করতে শুরু করেছে গোটা পৃথিবী। বাকিটার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সামনের আরও দুটা বছর।