জাহলাম ইস্যু এখন দেশের হাই ভোল্টেজ ইস্যু। অনলাইন অফলাইন মিডিয়ার সবকটায় রাজত্ব করছে এই কাহিনী। ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ মামলার মূল আসামীকে সনাক্ত করতে দুদক নাকি ভুল করেছিল। আর তাদের এই ভুলের খেসারত দিতে ৩ বছর ধরে জেল খেটেছে নিরপরাধ এক পাটকল শ্রমিক। প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে জাহলাম কাহিনী। এর ধারাবাহিকতা হিসাবে দেশের হাইকোর্ট স্বপ্রনেদিত হয়ে তার মুক্তির পথ পরিষ্কার করে দেয়। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে শেষপর্যন্ত মুক্তির নিশ্বাস ফেলতে সক্ষম হয় জাহলাম। আমরা যারা বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে এর আলো-বাতাসের ছায়াতলে বড় হয়েছি তাদের জানা আছে এ দেশের প্রতিটা কাহিনীর পেছনে আরেকটা কাহিনী থাকে। তাই দুদক যখন সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর মত ম্যাও ম্যাও করে দাবিকরে জাহলামকে চিনতে তারা ভুল করেছিল, আমি নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারি দাবীকৃত ভুলেরও হাত-পা, চোখ-কান সব ছিল। যখন যেখানে যা প্রয়োজন ভুল তার আপন মহিমায় কাউকে মহিমান্বিত করেছিল। কারও বা পকেট ভারী করেছিল সুযোগের চাহিদা মিটিয়ে।
মানুষ মাত্রেই ভুল করে। এ তর্কাতীত সত্য। কিন্তু দুদক তো মানুষ ছিলনা। এ ছিল একটি ইন্সটিটিউশন। এখানে একাধিক আদম সন্তান কাজ করে। তারা সবাই আইনের লোক। আইন নিয়ে সকাল বিকাল ঘাটাঘাটি করে। আমাদের কি বিশ্বাস করতে হবে এ ধরণের একটা প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারীর ভুলের কারণে এত বড় একটা ভুল হতে পারে? ধরে নিলাম এই কাজে নিয়োজিত দুদক অফিসার মোহাচ্ছন্ন হয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু শাস্তি তো দিয়েছে দেশের নিম্ন আদালত। বিবাদী দুপক্ষেরই ছিল উকিল। তারা আদালতে আইনি লড়াই করেছে। কেউ কি একবারের জন্যেও সন্দেহ করেনি একজন নিরপরাধ মানুষকে আমরা জেলে ভরছি? ব্যাংকের ডকুমেন্টে করা আবু সালেকের সই কি জাহলামের সইয়ের সাথে মিলিয়ে দেখার সুযোগ ছিলনা? এখানেই আসে কাহিনীর পেছনে অন্য এক কাহিনী। বাংলাদেশি কাহিনী।
এবার আসুন আমার থিওরিতে। ১৮ কোটি টাকার মামলা। তাও একটা দুইটা না, ৩৩টা। চলুন যে ব্যাংক হতে টাকাগুলো আত্মসাৎ করা হয়েছে সেই ব্যাংক হতে ঘুরে আসি। একজন আবু সালেক বসে আছেন ম্যানেজার সাহেবের চেম্বারে। হাতে হরেক রকম কাগজপত্র। দুপক্ষ দরদাম করে চূড়ান্ত করেছে ১৮ কোটি টাকার শেষ গন্তব্য। ভাগবাটোয়ারার মুড অব আন্ডারষ্ট্যাংন্ডিও ফাইনাল। আর দশটা লুটের মত ১৮ কোটিও কোথাও কোন বাধার সন্মুখিন হয়নি। দিনশেষে যার যার পাওনা পকেটে পুরে কাহিনী মিশে গেছে জনারণ্যে। তবে সমস্যা বোধহয় রয়ে গিয়েছিল। লুটেরা গং ব্যাংকের সবাইকে যে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল বোধহয় তা নয়। কর্মকর্তা কর্মচারীদের কেউ বখরার অংকে সন্তুষ্ট না হয়ে হয়ত গোপন অভিসারে যান দুদকের দুয়ারে। দুদক সময় অপচয় না করে আবু সালেকের বিরুদ্ধে ঠুকে দেয় একাধিক মামলা। কেস গড়ায় কোর্ট পর্যন্ত। শীতের চমৎকার এক সকালে আবু সালেক, জড়িত ব্যাংকের ম্যানেজার, দুদক উকিল, পুলিশ আর আদালতের বিচারক সহ সংশ্লিষ্ট সবাই গোপন বৈঠকে বসেন। ঐ বৈঠকে তৈরি হয় নতুন একশন প্লান। আবু সালেক নিজের ভাণ্ডার খুলে দেন থানা-পুলিশ, দুদক আর বিচারকদের জন্যে। নতুন ভাগবাটোয়ারা, নতুন হিসাব...। জাহলামকে ফাঁসানোর বুদ্ধিটা বোধহয় পুলিশি ডেস্ক হতে উত্থাপিত হয়েছিল। বাকি সবাই নিশ্চয় তা একবাক্যে লুফে নিয়েছিল। অন্তত আমার দেখা বাংলাদেশ তাই বলে। তবে দুর্ভাগ্য জাহলামের! অনেকটা কুরবানির খাসি হয়ে তাকে আবু সালেক, থানার ওসি, দুদকের উকিল ও জনৈক বিচারকের পাপ মোচন করতে হয়েছিল। যেমনটা করেছিল এক কালের জজ মিয়া। আপনি বলবেন এসব নিয়ে আমার মত ম্যংগোদের এতো মাথা ব্যথা কেন! কারণ এ যে আদার বেপারি হয়ে জাহাজের খবর নেয়া! আমি আদার বেপারী সন্দেহ নাই। তবে বাংলাদেশ আগামী ক'বছর পর উন্নতির ডিঙ্গায় চড়ে আমেরিকাকেও পিছনে ফেলতে যঞ্চছে; এমন বায়বীয় উন্নতির মহাসমুদ্রে আমারও তো সাতার কাটতে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছাটাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া!