মনে আছে ইদি আমিনের কথা? না থাকলে চলুন আমার সাথে এবং ফিরে যাই ১৯৭১ সালে। জাতি হিসাবে আমরা তখন আমাদের স্বাধীনতার জন্যে লড়ছি। একই সময় দূরের মহাদেশ আফ্রিকার উগান্ডায় মঞ্চস্থ হচ্ছে অন্য এক নাটক। দেশটার প্রেসিডেন্ট মিল্টন ওবোটে সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ জেনারেল ইদি আমিন দাদা অউমিকে বরাদ্দকৃত অর্থ তসরুপের দায়ে গ্রেফতারের উদ্যোগ নিচ্ছেন। জেনারেলের কানে এ খবর পৌঁছামাত্র সিদ্ধান্ত নেন বিদ্রোহের। সেনাছাউনির সহায়তায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নিজকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা করেন। শুরু হয় বিশ্ব শাসনব্যবস্থার নতুন এক অধ্যায়। কলঙ্কিত অধ্যায়। এককালের পশ্চিমা-পন্থী বলে পরিচিত এই জেনারেল ক্ষমতা কুক্ষিগত করার দৌড়ে দ্রুতই খুঁজে নেন নতুন সব বন্ধু। এই তালিকায় যুক্ত হয় লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়ামার গাদ্দাফি, জায়েরের মবুতু সেসে সেকো এবং একনায়কতান্ত্রিক লৌহ-শাসনের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব জার্মানি।
আর দশটা স্বৈরশাসকের মত ইদি আমিনও অবৈধ শাসন পোক্ত করায় ব্রিটিশ তত্ত্ব 'ডিভাইড এন্ড রুল'এর পথে পা বাড়ান। এ পথেই সনাক্ত করেন উগান্ডার 'রাজাকার' স্থানীয় ভারতীয় অভিবাসীদের। ওরা সংখ্যায় ছিল ৮৫,০০০। কলোনিয়াল ব্রিটিশরা ভারত হতে এদের আমদানি করেছিল একই উদ্দেশ্যে, ভাগ করো এবং খাও। সংখ্যায় অল্প হলেও গুজরাটি ভারতীয়রা দেশটার অর্থনীতির একটা সিংহভাগ দখল করে নেয় নিজেদের বেনিয়া চরিত্রের গুণাবলি দিয়ে। ইদি আমিন এদের সবাইকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। বহিষ্কৃত এসব ভারতীয়দের সিংহভাগ ঠাঁই নেয় ব্রিটেনে। বাকিরা চলে যায় কানাডায়, প্রতিবেশী কেনিয়ায় এবং কিছু অংশ চলে যায় তাদের আদি-ভূমি ভারতে। ইদি আমিন ভারতীয়দের তাবৎ ব্যবসা-বাণিজ্য বিলিয়ে দেন স্থানীয়দের মাঝে। দেশটার জনগণ রাস্তায় নেমে নেচে-গেয়ে সেলিব্রেট করতে থাকে তাদের কুঁড়িয়ে পাওয়া সৌভাগ্য। ইদি আমিন হয়ে উঠেন তাদের সৃষ্টিকর্তা। একই সমান্তরালে জেনারেল আমিন তার একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের বিরোধীতাকারীদের সমূলে নির্মূল করার মিশনে নামেন। প্রকাশ্য-দিবালোকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়ে উঠে প্রতিশোধের সংস্কৃতি।
সমস্যা শুরু হয় অন্য জায়গায়। স্থানীয় অনভিজ্ঞ ও অশিক্ষিতদের হাতে দেশটার ব্যবসা-বাণিজ্য চলে যাওয়ায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় অর্থনীতিতে। নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের বাজারমূল্য চলে যায় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অভাব-অনটন গ্রাস করে নেয় সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা। যা স্বাভাবিক তাই ঘটতে শুরুকরে। অভাবগ্রস্ত মানুষ রাস্তায় নেমে লুটপাট শুরুকরে দেয়। এবার নতুন রাজাকারের সন্ধানে নামেন জেনারেল আমিন। এ কাজে খুব একটা সময় ব্যায় করতে হয়নি তাকে।
ইচ্ছাকৃত ভাবে পশ্চিমা দুনিয়াকে নিজ দেশের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে জনগণের ক্ষোভ অন্যদিকে সরিয়ে দেয়ার মাঝেই আবিষ্কার করেন নতুন রাজাকার। অদ্ভুত আচরণ শুরুকরে বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেন। ব্রিটেনের রানীকে জুতা উপহার পাঠানো হতে শুরু করে সদ্য ক্ষমতাহারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে এমন এক বার্তা পাঠান যা গোটা দেশটার জন্যে ছিল চরম অবমাননাকর। ১৯৭৭ সালে ব্রিটেন উগান্ডার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হয়। জেনারেল আমিন স্থানীয় তথ্য মাধ্যমে ঘোষণা দেন ব্রিটিশ রাজতন্ত্র জয়ের। নিজকে দেশটার আজীবন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা দিয়ে উপাধি নেন "His Excellency President for Life, Field Marshal Alhaji Dr. Idi Amin Dada, VC, DSO, MC, CBE". আবারও অশিক্ষিত, আধা-শিক্ষিত উগান্ডাবাসী রাস্তায় নেমে উল্লাসে মত্তহয় রাজাকার বধের। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইদি আমিনের শত্রু বাড়তে শুরুকরে জ্যামিতিক হারে। বিশেষকরে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধীদের প্রকাশ্যে ফাঁসি, সন্ত্রাসী সংগঠন 'Operation Entebbe'কে লালন-পালন করার জন্যে। পশ্চিমা দুনিয়া একঘরে করতে শুরু করে দেয় উগান্ডাকে। স্থবির হয়ে যায় দেশটার অর্থনীতি। বাড়তে শুরুকরে আভ্যন্তরীণ অসন্তোষ। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন হয়ে পরে নতুন রাজাকারের।
এ যাত্রায় নতুন রাজাকার হিসাবে সামনে আনেন প্রতিবেশী দেশ তাঞ্জানিয়াকে। এবং এখানেই পতনের বীজ বপন করেন জেনারেল আমিন। ১৯৭৮ সালে উগান্ডার সীমান্তবর্তী Kagera Region দখলের জন্যে তাঞ্জানিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। শেষবারের জন্যে দেশের জনগণ জেনারেল আমিনের সমর্থনে রাস্তায় নেমে আসে। বিজয়ের মিথ্যা খবর দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হন ক্ষমতা-লিপ্সু এই জেনারেল। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তাঞ্জানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নাইরেরে ঘোষণা দেন উগান্ডা দখলের। এবং বাস্তবেও ঘটে তাই। রাজধানী কাম্পালায় পা রাখে তাঞ্জানিয়ান বাহিনী। ইদি আমিন পালিয়ে যান। প্রথমে লিবিয়ায় ও পরে সৌদি আরব। এবং ওখানেই ২০০৩ সালের ১৬ই আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
এ লেখার বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নেই। তবে যুগে যুগে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতার পথ মসৃণ রাখতে রাজাকারদের প্রয়োজনীয়তাকে হাইলাইট করাই ছিল লেখার মূল তাগাদা। বাকিটা বুঝে নেয়ার ভার পাঠকদের উপরই ছেড়ে দিলা